ঠাকুরগাঁওয়ে বিনোদনের রসদ যোগায় ঐতিহ্যবাহী ধামের গান
- আপডেট টাইম : ১২:৫৬:৩৪ অপরাহ্ণ, মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৪
- / ৩২ ৫০০০.০ বার পাঠক
দেশের উত্তরের হিমালয়ের অদূরবর্তী জেলা ঠাকুরগাঁও। এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী কুলিক,পাথরাজ, নাগর, শুক ও টাঙ্গন নদীর অববাহিকায় লোকসংস্কৃতির মূল্যবান সম্পদ এ ধামের গান। গ্রামীণ সমাজে যা এখনো তুমুল জনপ্রিয়। ভাওয়াইয়া যেমন বৃহত্তর রংপুর-কোচবিহারের প্রধান সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ, তেমনি ধামের গানও এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ। তাই স্থানীয় ইতিহাসবিদরা লোকসংস্কৃতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন ধামের গানের। তাইতো ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রাম সহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের সব বয়সের মানুষের বিনোদনের রসদ যোগায় ঐতিহ্যবাহী ধামের গান।
প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরেও ঠাকুরগাঁওয়ে চলছে ধামের গানের আসর। একই কাতারে বসে হিন্দু মুসলিমসহ সকল ধর্মের নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ উপভোগ করছেন এসব গান ।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, লক্ষ্মীপূজার পর থেকে সদর উপজেলা সহ জেলার ৫টি উপজেলার ৫৩টি ইউনিয়নে পৃথকভাবে ২শ ধামের গানের মঞ্চ হয়েছে যা শেষ হবে শ্যামাপূজার (কালীপূজার) সময়।
ধামের গান আদতে দেশের উত্তরের এ অঞ্চলের স্থানীয় লোকনাট্যের একটি ধারা যা কালের বিবর্তেও হারিয়ে যায়নি। ধাম শব্দের অর্থ স্থান বা আশ্রয়স্থল। ধর্মীয়ভাবে বা কোনো অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য স্বীকৃত সমবেত হওয়ার জায়গায় কথোপকথন ও গানের মাধ্যমে উপস্থাপিত লোকজ নাট্যকেই ‘ধামের গান’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় যা এ অঞ্চলের লোকনাট্যের একটি বিশেষ প্রকরণ। মারাঘুরা গান, পালাটিয়া গান, হুলিগান, লক্ষ্মীর ধামের গান ছাড়াও এর আরও কয়েকটি নাম রয়েছে। গানের সংলাপ হয় সংক্ষিপ্ত আর ভাষা সম্পূর্ণ আঞ্চলিক। গানের আধিক্যের কারণেই এর নামের শেষে গান যুক্ত করা হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আসরে বিভিন্ন নারী চরিত্রে পুরুষরাই মহিলাদের কাপড় পরে, লম্বা চুলের ঝুঁটি, মাথায় খোঁপা, নাকে নাকফুল, কানে দুল পরে অভিনয় পরিবেশন করে। তাদের চেনা দায় হয়ে পড়ে। নানা অঙ্গভঙ্গিমায় অভিনয় ও বাদ্যের তালে সুর মিলেয়ে রাতভর দর্শক-শ্রোতাদের বিনোদন দিচ্ছেন তারা। আবার কখনো পরিবারের অভাব-অনটনের বিষয়টিও ফুটিয়ে তুলছেন করুণভাবে। এসব শিল্পীদের তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ থাকেনা। এরা আহামরি কোন পেশাদার অভিনেতাও নন। চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে এরা বর্গাচাষি, দিন মজুর, ভ্যানচালক, রাজমিস্ত্রীর জোগালি ইত্যাদি সাধারণ পেশার লোক। এসব গানের আসরের কোন পান্ডুলিপিও হয় না, থাকে না কোনো প্রম্পটার। প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনাবলী থেকেই নেওয়া হয় চরিত্রগুলো।
সদর উপজেলার সালন্দর সিংপাড়ায় গান করতে আসা নেকমরদ হাট থেকে ১৬ দলের সরদারনি নামে একটি দলের মাষ্টার জিতেন পাল প্রতিবেদককে বলেন, হামার গ্রামত যে ঘটনালা ঘটে সেই ঘটনালা দিয়া হামরা গান তৈরি করি। ছেলেরা মেয়ে সাজে অভিনয় করে। আর মানুষজন এইসব দেখে মজা পায়, আনন্দ করে।
আসরে ছেলে থেকে মেয়ে সেঁজে অভিনয় করা খগেণ পাল প্রতিবেদককে জানান, গতবছর যে জায়গুলোতে ধামের গান বসত সে গুলোর অনেক জায়গায় এবার গানের আসর বসেনি। সময়ের সাথে কমতে বসেছে এর জনপ্রিয়তা । আগে আমাদের যেমন চাহিদা ছিল ঠিক তেমনি পারিশ্রমিকও বেশি পেতাম। আমাদের অনেকেই এখন এ আসরে আর গান করতে আসেনা । হয়তো সংসার চালাতে আমাকেও একদিন ছাড়তে হবে এ আসর।
আকচা পালপাড়া গ্রামের ধামের গান কমিটির সভাপতি মহেন্দ্র পাল বলেন, আগে আমাদের এই আসরে দিন-রাত ২৪ ঘন্টাই ধামের গান হত এখন দিনে আর হয় না, শুধু রাতে হয়। আমরা প্রতিবছর গানের দল গুলো নিয়ে একটি প্রতিযোগীতার আয়োজন করতে থাকি। এবার যে দল প্রথম হবে তার জন্য প্রথম পুরষ্কার টিভি, দ্বিতীয় বাইসাইকেল, আর তৃতীয় পুরষ্কার হারমোনিয়াম।
স্থানীয়রা জানান, গ্রামাঞ্চলে বিনোদনের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। বছর ঘুরে গ্রামে গ্রামে ধামের গান অনুষ্ঠিত হয়, যা সবার কাছে প্রিয়। এ আয়োজনকে ঘিরে স্থানীয়দের উৎসাহ ও আনন্দটা অনেক বেশি। পরিবার-পরিজন নিয়ে অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন তারা।
জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা বলেন, ধামের গান অত্র এলাকার লোকজ সংস্কৃতির একটি অংশ। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে এ সংস্কৃতি আজ বিলুপ্তির মুখে। তাই সেটি রক্ষায় সরকারী ভাবে আমরা সাহায্য সহযোগীতা করবো। এর বিকাশে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসন সবসময় পাশে থাকবে।