ঢাকা ০৩:৩১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ২০ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo হবিগঞ্জ-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী ডা: শাখায়াত হাসান জীবন আজমিরীগঞ্জ বানিয়াচংয়ে উচ্ছ্বাস Logo পটুয়াখালী-২ আসনে এনসিপি-জামায়াতে উচ্ছ্বাস, বিএনপিতে বিষাদ Logo ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মাগুরা-২ আসনে ধানের শীষের কান্ডারী এ্যাড. নিতাই রায় চৌধুরী Logo ফরিদপুরে চেয়ারম্যানের শেল্টারে চায়না দুয়ারি জালের কারখানার রমরমা ব্যবসা, প্রশাসনের অভিযানে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা Logo রয়টার্সের প্রতিবেদন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সালিশের দ্বারস্থ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে আদানি গ্রুপ Logo টানা কমছে দেশের রপ্তানি আয়, সামনে আরও কমার আশঙ্কা Logo বিএনপির ফাঁকা রাখা ৬৩ আসনে অগ্রাধিকার পাবেন যারা Logo আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশ জারি জোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই ভোট করতে হবে Logo আশুলিয়া সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ৬ দলিল লেখক বরখাস্ত Logo সাভারে ট্রলি ভ্যানের ব্রেক ফেল আয়ারল্যান্ডের ওপরে এসে গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ

চরম বিপর্যয়ের মধ্যেও গোপনে সরকারি কর্মচারীদের বেতন দিচ্ছে হামাস

গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার প্রায় দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধের ফলে একদিকে যেমন হামাসের সামরিক ক্ষমতা বিপর্যস্ত হয়েছে, তেমনি তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বও তীব্র চাপের মুখে পড়েছে। তবু এই পুরো সময়জুড়ে হামাস এক গোপন পন্থায় প্রায় ৩০ হাজার সরকারি কর্মচারীর হাতে নগদ বেতন তুলে দিয়েছে—যার পরিমাণ প্রায় ৭০ লাখ মার্কিন ডলার।

বিবিসির সঙ্গে আলাপে তিনজন সরকারি কর্মচারী নিশ্চিত করেছেন যে তারা সম্প্রতি প্রায় ৩০০ ডলার করে পেয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এরা সেই হাজার হাজার কর্মচারীর একজন, যারা প্রতি ১০ সপ্তাহ অন্তর তাদের পুরনো বেতনের মাত্র এক-পঞ্চমাংশ বা তারও কম অর্থ পাচ্ছেন।

এই সামান্য আয়ের মধ্যেই গাজার কর্মচারীদের টিকে থাকতে হচ্ছে ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য সংকটের মুখে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এক কেজি আটার দাম ৮০ ডলারের কাছাকাছি, যা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি।

গাজায় কার্যকর কোনও ব্যাংকিং ব্যবস্থা না থাকায় নগদ বেতন গ্রহণ প্রক্রিয়াটিও জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, ইসরায়েল নিয়মিত হামাসের ‘বেতন বিতরণ কেন্দ্র’গুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে।

এই বেতন পৌঁছানো হয় কূটাভাষায় সংকেত পাঠিয়ে—যেখানে এনক্রিপট করা মেসেজে কর্মচারীদের বলা হয়, নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে ‘চা খেতে’ যেতে। সেখানে একজন পুরুষ, কিংবা মাঝে মাঝে নারী, কোনও কথা না বলেই হাতে একটি সিল করা খাম তুলে দিয়ে সরে যান। খামের মধ্যেই থাকে বেতনের অর্থ।

হামাসের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, ‘প্রতিবার যখন আমি বেতন নিতে বের হই, স্ত্রী-সন্তানকে শেষবারের মতো বিদায় জানিয়ে যাই। আমি জানি, হয়তো আর ফিরে আসতে পারব না। বহুবার ইসরায়েলি হামলায় বেতন বিতরণ কেন্দ্রগুলো ধ্বংস হয়েছে। একবার গাজা শহরের এক ব্যস্ত বাজারে এমন হামলা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে ফিরেছি।’

‘আলা’ নামের এক স্কুলশিক্ষক বলেন, তিনি প্রায় ৩০০ ডলার পেয়েছেন ছেঁড়া পুরোনো নোটে—যার বেশির ভাগই স্থানীয় দোকানিরা নিতে রাজি নন। ব্যবহারযোগ্য মাত্র ২০০ শেকেল, বাকিটুকু কিভাবে ব্যবহার করবেন তা নিয়ে তিনি হতাশ।

তিনি বলেন, ‘আড়াই মাস উপবাসের পর ওরা আমাদের হাতে তুলে দিল ছেঁড়া টাকা। আমি প্রায়ই সন্তানদের জন্য কিছু আটা আনতে খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রে যাই। কিন্তু বেশিরভাগ দিনই খালি হাতে ফিরি।’

চলতি বছরের মার্চে ইসরায়েল দাবি করে, তারা খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে হামাসের অর্থপ্রধান ইসমাইল বারহুমকে হত্যা করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে সংগঠনের সামরিক শাখায় অর্থ সরবরাহের অভিযোগ ছিল।

গাজার প্রশাসনিক কাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পরও কীভাবে হামাস এই বিপুলসংখ্যক কর্মচারীর বেতন নিশ্চিত করছে, তা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। সংগঠনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের আগেই হামাস ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের মাধ্যমে প্রায় ৭০ কোটি ডলার এবং কয়েক শ মিলিয়ন শেকেল মজুত করেছিল। এই অর্থ সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার ও তাঁর ভাই মোহাম্মদ, যাঁরা দুজনেই ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।

গাজায় দীর্ঘদিন ধরে আরোপিত আমদানি শুল্ক ও কর হামাসের অর্থের প্রধান উৎস। এছাড়াও কাতার থেকে আসা অনুদান এবং ইরানের অর্থায়নে পরিচালিত কাসাম ব্রিগেডের জন্য রয়েছে আলাদা বাজেট ব্যবস্থা। এমনকি মুসলিম ব্রাদারহুডও তাদের বাজেটের ১০ শতাংশ হামাসকে সরবরাহ করত বলে জানিয়েছে ওই সংগঠনের এক কর্মকর্তা।

যুদ্ধকালেও হামাস বিভিন্ন ব্যবসার ওপর কর আদায় অব্যাহত রেখেছে। এক খাপ সিগারেট যা আগে ৫ ডলারে বিক্রি হতো, এখন তা ১৭০ ডলারের বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা।

হামাস তাদের সদস্যদের নগদ অর্থের পাশাপাশি স্থানীয় ‘জরুরি কমিটির’ মাধ্যমে খাবার পাঠাচ্ছে। তবে ইসরায়েলি হামলায় কমিটির নেতৃত্বে ঘন ঘন পরিবর্তন ঘটছে।

এছাড়া হামাসের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও রয়েছে যে, তারা কেবল নিজেদের অনুগতদের মধ্যেই সাহায্য বিতরণ করছে। অনেক সাধারণ গাজাবাসী এ নিয়ে ক্ষুব্ধ। বিধবা নারী নিসরিন খালেদ বলেন, ‘আমার সন্তানরা শুধু ক্ষুধার জন্য কাঁদে না, পাশের বাসার হামাস সমর্থকদের খাবার পেতে দেখেও কাঁদে। আমাদের দুর্ভোগের দায় কি হামাসের নয়? কেন তারা ৭ অক্টোবরের আগেই কিছু খাবার, পানি, ওষুধ মজুত করেনি?’


প্রিন্ট
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

হবিগঞ্জ-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী ডা: শাখায়াত হাসান জীবন আজমিরীগঞ্জ বানিয়াচংয়ে উচ্ছ্বাস

চরম বিপর্যয়ের মধ্যেও গোপনে সরকারি কর্মচারীদের বেতন দিচ্ছে হামাস

আপডেট সময় ১২:৩০:২৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ অগাস্ট ২০২৫

গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার প্রায় দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধের ফলে একদিকে যেমন হামাসের সামরিক ক্ষমতা বিপর্যস্ত হয়েছে, তেমনি তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বও তীব্র চাপের মুখে পড়েছে। তবু এই পুরো সময়জুড়ে হামাস এক গোপন পন্থায় প্রায় ৩০ হাজার সরকারি কর্মচারীর হাতে নগদ বেতন তুলে দিয়েছে—যার পরিমাণ প্রায় ৭০ লাখ মার্কিন ডলার।

বিবিসির সঙ্গে আলাপে তিনজন সরকারি কর্মচারী নিশ্চিত করেছেন যে তারা সম্প্রতি প্রায় ৩০০ ডলার করে পেয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এরা সেই হাজার হাজার কর্মচারীর একজন, যারা প্রতি ১০ সপ্তাহ অন্তর তাদের পুরনো বেতনের মাত্র এক-পঞ্চমাংশ বা তারও কম অর্থ পাচ্ছেন।

এই সামান্য আয়ের মধ্যেই গাজার কর্মচারীদের টিকে থাকতে হচ্ছে ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য সংকটের মুখে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এক কেজি আটার দাম ৮০ ডলারের কাছাকাছি, যা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি।

গাজায় কার্যকর কোনও ব্যাংকিং ব্যবস্থা না থাকায় নগদ বেতন গ্রহণ প্রক্রিয়াটিও জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, ইসরায়েল নিয়মিত হামাসের ‘বেতন বিতরণ কেন্দ্র’গুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে।

এই বেতন পৌঁছানো হয় কূটাভাষায় সংকেত পাঠিয়ে—যেখানে এনক্রিপট করা মেসেজে কর্মচারীদের বলা হয়, নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে ‘চা খেতে’ যেতে। সেখানে একজন পুরুষ, কিংবা মাঝে মাঝে নারী, কোনও কথা না বলেই হাতে একটি সিল করা খাম তুলে দিয়ে সরে যান। খামের মধ্যেই থাকে বেতনের অর্থ।

হামাসের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, ‘প্রতিবার যখন আমি বেতন নিতে বের হই, স্ত্রী-সন্তানকে শেষবারের মতো বিদায় জানিয়ে যাই। আমি জানি, হয়তো আর ফিরে আসতে পারব না। বহুবার ইসরায়েলি হামলায় বেতন বিতরণ কেন্দ্রগুলো ধ্বংস হয়েছে। একবার গাজা শহরের এক ব্যস্ত বাজারে এমন হামলা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে ফিরেছি।’

‘আলা’ নামের এক স্কুলশিক্ষক বলেন, তিনি প্রায় ৩০০ ডলার পেয়েছেন ছেঁড়া পুরোনো নোটে—যার বেশির ভাগই স্থানীয় দোকানিরা নিতে রাজি নন। ব্যবহারযোগ্য মাত্র ২০০ শেকেল, বাকিটুকু কিভাবে ব্যবহার করবেন তা নিয়ে তিনি হতাশ।

তিনি বলেন, ‘আড়াই মাস উপবাসের পর ওরা আমাদের হাতে তুলে দিল ছেঁড়া টাকা। আমি প্রায়ই সন্তানদের জন্য কিছু আটা আনতে খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রে যাই। কিন্তু বেশিরভাগ দিনই খালি হাতে ফিরি।’

চলতি বছরের মার্চে ইসরায়েল দাবি করে, তারা খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে হামাসের অর্থপ্রধান ইসমাইল বারহুমকে হত্যা করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে সংগঠনের সামরিক শাখায় অর্থ সরবরাহের অভিযোগ ছিল।

গাজার প্রশাসনিক কাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পরও কীভাবে হামাস এই বিপুলসংখ্যক কর্মচারীর বেতন নিশ্চিত করছে, তা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। সংগঠনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের আগেই হামাস ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের মাধ্যমে প্রায় ৭০ কোটি ডলার এবং কয়েক শ মিলিয়ন শেকেল মজুত করেছিল। এই অর্থ সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার ও তাঁর ভাই মোহাম্মদ, যাঁরা দুজনেই ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।

গাজায় দীর্ঘদিন ধরে আরোপিত আমদানি শুল্ক ও কর হামাসের অর্থের প্রধান উৎস। এছাড়াও কাতার থেকে আসা অনুদান এবং ইরানের অর্থায়নে পরিচালিত কাসাম ব্রিগেডের জন্য রয়েছে আলাদা বাজেট ব্যবস্থা। এমনকি মুসলিম ব্রাদারহুডও তাদের বাজেটের ১০ শতাংশ হামাসকে সরবরাহ করত বলে জানিয়েছে ওই সংগঠনের এক কর্মকর্তা।

যুদ্ধকালেও হামাস বিভিন্ন ব্যবসার ওপর কর আদায় অব্যাহত রেখেছে। এক খাপ সিগারেট যা আগে ৫ ডলারে বিক্রি হতো, এখন তা ১৭০ ডলারের বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা।

হামাস তাদের সদস্যদের নগদ অর্থের পাশাপাশি স্থানীয় ‘জরুরি কমিটির’ মাধ্যমে খাবার পাঠাচ্ছে। তবে ইসরায়েলি হামলায় কমিটির নেতৃত্বে ঘন ঘন পরিবর্তন ঘটছে।

এছাড়া হামাসের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও রয়েছে যে, তারা কেবল নিজেদের অনুগতদের মধ্যেই সাহায্য বিতরণ করছে। অনেক সাধারণ গাজাবাসী এ নিয়ে ক্ষুব্ধ। বিধবা নারী নিসরিন খালেদ বলেন, ‘আমার সন্তানরা শুধু ক্ষুধার জন্য কাঁদে না, পাশের বাসার হামাস সমর্থকদের খাবার পেতে দেখেও কাঁদে। আমাদের দুর্ভোগের দায় কি হামাসের নয়? কেন তারা ৭ অক্টোবরের আগেই কিছু খাবার, পানি, ওষুধ মজুত করেনি?’


প্রিন্ট