প্রতীকী ছবি
হালিশহরের বাসিন্দা আতিকুর রহমান। চট্টগ্রাম মেট্রো এলাকায় চালানোর ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে স্ত্রী নাসরিন ইসলামের নামে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিনেছিলেন তিনি। জেডএইচ এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা এ অটোরিকশার টাকা কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধ করে এ দম্পতি। তাদের দেওয়া হয় এনওসিও।
ওই অটোরিকশার টাকা পরিশোধের পর নিজ গ্রামে একটি তিন চাকার যান নামানোর আবেদন করেন আতিকুর। কিন্তু তাকে গাড়ি দেওয়া হয়নি। তবে এখন দেখছেন তার নামে হিসাব খুলে তিনটি গাড়ির ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে। ঋণ পরিশোধে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে চিঠিও দিয়েছে। চিঠি পেয়েই তিনি হতবাক হয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন, জেডএইচ এন্টারপ্রাইজের মালিক জহিরুল ইসলাম ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তার নামে হিসাব খুলে টাকা তুলে নিয়েছে।
একই অবস্থা কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার শাহারবিল গ্রামের বাসিন্দা মনির উদ্দিনের। একটি অটোরিকশার জন্য ২০২০ সালের ২২ জুন আবেদন করেছিলেন তিনি। তবে, আবেদনের পর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মনির মারা যান। তিনি বা তার পরিবার সিএনজি অটোরিকশা না পেলেও তার নামে ঠিকই আড়াই লাখ টাকা ঋণ মঞ্জুর করে ব্যাংক। বর্তমানে সেই টাকা পরিশোধে ব্যাংক থেকে মনিরের পরিবারের কাছে দেওয়া হচ্ছে চিঠি।
আতিকুর, মনিরের মতো ৩৬৫ জনের নামে ঋণ মঞ্জুর করে ১০ কোটি দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছে জেডএইচ এন্টারপ্রাইজ ও আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার কিছু অসাধু কর্মকর্তা। চট্টগ্রামে সিএনজিচালিত অটোরিকশার ব্যবসার নামে এসব ঋণ নেওয়া হয়।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অটোরিকশার বিপরীতে বিপুল অঙ্কের ঋণ মঞ্জুরের কিছুই জানেন না তারা। এমনকি তারা টাকাও পাননি, গাড়িও পাননি। অথচ, এখন ঋণ পরিশোধে তাদের কাছে যাচ্ছে ব্যাংকের চিঠি। এ তালিকায় রয়েছেন প্রবাসী থেকে শুরু করে মৃত ব্যক্তিও।
তাদের দাবি, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে জেডএইচ এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান, গ্রাহকের নামে ভুয়া কাগজপত্র জমা দিয়ে ভয়াবহ এ প্রতারণা করে। ২০১৯-২০ সালে এ ঘটনা ঘটেছে।
জানা গেছে, ভিআইপি টাওয়ারে অবস্থিত জেডএইচ এন্টারপ্রাইজ অটোরিকশা কেনাবেচার ব্যবসা শুরু করে। এ প্রতিষ্ঠানের যৌথ মালিক ছিলেন মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ নামে দুই ব্যক্তি। ব্যবসায় বিনিয়োগ করে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, আগ্রাবাদ করপোরেট শাখা। অর্থাৎ জেডএইচ এন্টারপ্রাইজ বিভিন্নভাবে গাড়ির ক্রেতা ঠিক করে। সেই ক্রেতা বা গ্রাহকের নামে হিসাব নম্বর খুলে নির্ধারিত ঋণ প্রদান করে ব্যাংক। এ ঋণের জিম্মাদারি নেয় জেডএইচ এন্টারপ্রাইজ।
সূত্র জানায়, মেট্রো অটোরিকশার বিপরীতে ঋণ দেওয়া হয় তিন লাখ টাকা। ২৪ কিস্তিতে এ টাকা পরিশোধের শর্ত ছিল। একইভাবে গ্রাম্য এলাকার গাড়ির ক্ষেত্রে প্রতিটির বিপরীতে ঋণ দেওয়া হয় দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা করে।
জেডএইচ এন্টারপ্রাইজ ৮০১টি গ্রাম গাড়ির মধ্যে ৪০০টি যথাযথ প্রক্রিয়ায় ক্রেতার কাছে ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয়। ক্রেতারা সেই গাড়ির কিস্তিও পরিশোধ করেন। কিন্তু সেই একই ক্রেতার কারও কারও নামে আরও এক বা একাধিক গাড়ির আবেদন দেখিয়ে ৪০১টি গাড়ির বিপরীতে ব্যাংক থেকে ১০ কোটি দুই লাখ ৫০ হাজার টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয়। আর এখানেই ঘটে জালিয়াতির ঘটনা।
চট্টগ্রামের বন্দরটিলা এলাকার বাসিন্দা তারেকুল ইসলাম জানান, তার নামে তিনটি গাড়ির আবেদন দেখিয়ে সাড়ে সাত লাখ টাকা ঋণ মঞ্জুর করা হয়। ব্যাংকে গিয়ে দেখতে পান তার আবেদনে যে কমিশনার সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে সেটি জাল। আবেদনে তার যে স্বাক্ষর দেওয়া হয়েছে সেটিও জাল। মোবাইল নম্বরটিও ভুল।
শাহীন উদ্দিন ভুঁইয়া নামে হালিশহর বি-ব্লক ১১ নম্বর লেনের এক বাসিন্দা দুটি গাড়ির জন্য আবেদন করেছিলেন। গাড়ি না পেয়ে তিনি চলে যান বিদেশে। কিন্তু সেই প্রবাসীর নামেও দুটি হিসাব খুলে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেডএইচ এন্টারপ্রাইজের মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, জহিরুল ইসলামই আমাকে এ ব্যবসায় নামিয়েছিলেন। ৪০০ গাড়ি ঠিকমতো গ্রাহকের হাতে তুলে দেওয়া হয় ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে। তারা ঠিকঠাক মতো কিস্তিও পরিশোধ করেছেন। কিন্তু বাকি ৪০১ গাড়ির বিপরীতে জাল-জালিয়াতি ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে ৩৬৫ গ্রাহকের বিপরীতে ১০ কোটি দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ মঞ্জুর করে তা আত্মসাৎ করেছেন জহিরুল।
তিনি আরও বলেন, আমি ২০২০ সালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ি। সুস্থ হয়ে হজে যায়। এ সুযোগে এসব অপকর্ম করেছে জহিরুল।
এ ব্যবসায়ী বলেন, বিভিন্ন গ্রাহকের নামে ঋণ মঞ্জুর করা হলেও সেই টাকা ব্যাংকে পরিশোধ করা হচ্ছে ধীরে ধীরে। তবে সেই টাকা কারা তুলেছেন বা কারা ব্যবহার করছেন, কারা ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করছেন সে বিষয়ে কোনো সদুত্তর দেননি তিনি। তবে তিনি বলেন, এ ঘটনার জন্য জেডএইচ এন্টারপ্রাইজের মালিক হিসাবে তিনি যদি দায়ী হন তবে অপর অংশীদার হাবিব উল্লাহও দায়ী।
আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ করপোরেট শাখার ইনভেস্টমেন্ট ইনচার্জ ইফতেখার উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ৪০১ গাড়ির বিপরীতে যাদের নামে ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে তারা যে গাড়ি পাননি-এমন অভিযোগ তাদের কাছে কেউ করেনি। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেকে কিস্তির টাকা শোধ করতে পারছেন না। ঋণ পরিশোধের জন্য সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে চিঠি দেওয়া হচ্ছে।
জাল-জালিয়াতির হয়েছে কি না তা খোঁজ নিয়ে জানাতে হবে বলে জানান এই ব্যাংক কর্মকর্তা।
প্রিন্ট