ঢাকা ০২:৫০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ২০ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo ফরিদপুরে চেয়ারম্যানের শেল্টারে চায়না দুয়ারি জালের কারখানার রমরমা ব্যবসা, প্রশাসনের অভিযানে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা Logo রয়টার্সের প্রতিবেদন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সালিশের দ্বারস্থ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে আদানি গ্রুপ Logo টানা কমছে দেশের রপ্তানি আয়, সামনে আরও কমার আশঙ্কা Logo বিএনপির ফাঁকা রাখা ৬৩ আসনে অগ্রাধিকার পাবেন যারা Logo আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশ জারি জোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই ভোট করতে হবে Logo আশুলিয়া সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ৬ দলিল লেখক বরখাস্ত Logo সাভারে ট্রলি ভ্যানের ব্রেক ফেল আয়ারল্যান্ডের ওপরে এসে গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ Logo তৌহিদুল ইসলাম এর বিরুদ্ধে ঘুষ বানিজ্যের অভিযোগ Logo ৪৮ তম বিসিএস পরীক্ষায় উওীর্ণদের নিয়োগ এর দাবি তে মানববন্ধন Logo বিএনপির প্রার্থী তালিকায় নেই রুমিন ফারহানার পদত্যাগ করেন

ওষুধ কোম্পানির উপঢৌকনে সর্বনাশ হচ্ছে রোগীর

  • নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০৯:২৯:২৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই ২০২৫
  • ১০৪ ১০.০০০ বার পড়া হয়েছে

ফলো করুন

চিকিৎসকদের প্রতিযোগিতা করে উপঢৌকন দিচ্ছে ওষুধ কোম্পানিগুলো। এক্ষেত্রে নিজেদের তৈরি ওষুধ, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্য, বিদেশ সফর, নানা সামগ্রীসহ নগদ অর্থও দেওয়া হচ্ছে। ফলে অধিকাংশ ডাক্তার নির্দিষ্ট কোম্পানির, এমনকি মানহীন ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধও লিখছেন। ফলে পকেট কাটা যাচ্ছে রোগীদের। শুধু বাড়তি অর্থ যে যাচ্ছে তাই নয়, এর সঙ্গে জনস্বাস্থ্যও পড়ছে হুমকির মুখে। স্বাস্থ্য খাতে এ অরাজকতা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব ডাক্তারই যে এটা করছেন তা নয়, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমনটা হয়ে থাকে। এটা অবশ্যই ডাক্তারদের নীতি-নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কারণ, একজন রোগী বিপদে পড়ে বিশ্বাস নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যান। আর সেই বিশ্বাস নিয়ে খেলা করা সভ্যসমাজে চলতে দেওয়া যায় না। কেননা অনৈতিক এই চর্চার কারণে রোগীদের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যয় বেড়ে যায়। এদিকে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব বলছেন, সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে স্বল্প মেয়াদে দুই মাসের অ্যাকশন প্ল্যান নিতে আগামী সপ্তাহে বৈঠক করা হবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে যেভাবে ওষুধের মার্কেটিং করা হয়, সেটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে মেলে না। বিদেশে নতুন ওষুধ তৈরি হলে বিজ্ঞাপন দেয়। কিন্তু এখানে মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে বলে সেটি হয় না। রিপ্রেজেনটেটিভের মাধ্যমে সরাসরি বিজ্ঞাপন করা হয়। এতে দেখা যায়, অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিংয়ের কারণে ক্ষেত্রবিশেষে ওষুধ উৎপাদনের খরচ ৫০-৭০ শতাংশ বেড়ে যায়। ফলে এর প্রভাব পড়ে ওষুধের দাম ও মানের ওপর। সাধারণত শীর্ষ কোম্পানিগুলোর চেয়ে অখ্যাত কোম্পানিগুলো বেশি কমিশন দিচ্ছে। এ কারণে গ্রামগঞ্জসহ সারা দেশে গ্রাম্য চিকিৎসক, ফার্মেসি কর্মী-দোকানদাররা নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি করতে উৎসাহ দেখান। ফলে মানুষ দুইদিক দিয়ে ঠকছে। এক হচ্ছে বেশি টাকা খরচ, দুই মানহীন ওষুধ নিতে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে মানুষ প্রয়োজনের বেশি ওষুধ সেবন করছেন। কেননা আমাদের দেশে কী পরিমাণ ওষুধের প্রয়োজন এবং উৎপাদন কী পরিমাণ হচ্ছে, সেটির হিসাব সরকারের কাছে নেই। ফলে উৎপাদিত ওষুধ নিয়ে কোম্পানিগুলো অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং করে থাকে। এ ধরনের মার্কেটিং অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওষুধ কোম্পানির মেডিকেল প্রমোশন অফিসাররা দায়িত্বরত ডাক্তারদের নানা কৌশলে খামের ভেতরে করে দিচ্ছেন তার প্রাপ্য কমিশন। আবার কেউ দিচ্ছেন দামি মোবাইল ফোন, কেউবা দিচ্ছেন দামি উপহার। এভাবে ডাক্তাররা ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি বা মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। উপহারের মধ্যে রয়েছে বিদেশে যাওয়ার যাবতীয় খরচ, ঘরের ফার্নিচার, এসি, ফ্রিজ, টেলিভিশন, ল্যাপটপ, দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে সেমিনারের নামে ট্যুরের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন জিনিস। এমন চিকিৎসকও রয়েছেন, যারা নিজেদের ছেলেমেয়ের বিয়ের খাবারের সম্পূর্ণ খরচ নিয়ে থাকেন বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে। এসব কারণেই ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা হয়ে উঠছেন বেপরোয়া। তারা কোথাও কোনো নিয়মনীতি মানছেন না। যখন-তখন ডাক্তারদের কক্ষে ঢুকে দীর্ঘ সময় অবস্থান করছেন। এ কারণে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে রোগীদের। আবার রোগীরা ডাক্তার দেখিয়ে বাইরে এলেই তাদের প্রেসক্রিপশন নিয়ে চলে টানাটানি। এমন চিত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ দেশের প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের। এমনকি গ্রামে পল্লিচিকিৎসক, রুরাল মেডিকেল প্র্যাকটিশনার (আরএমপি) এবং ফার্মেসির মালিক ও কর্মীদেরও উপঢৌকন দেওয়া হচ্ছে। কারণ, দেশের ফার্মেসিগুলো থেকেও প্রেসক্রিপশন ছাড়া অনেক মানুষ রোগের উপসর্গ বলে ওষুধ নিয়ে থাকেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওষুধ কোম্পানির একজন প্রতিনিধি জানান, আগে তো প্যাড, কলম ও নিজস্ব উৎপাদিত ওষুধ স্যাম্পল হিসাবে দিলেই হতো। এখন দিন বদলেছে-বড় বড় ইলেকট্রনিক্স পণ্য, নগদ টাকাসহ কমিশন পর্যন্ত দাবি করা হয়। আমরাও বাধ্য হয়ে তাদের দাবি পূরণে কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা করি। একজন চিকিৎসক বলেন, এমন উপহার বা উপঢৌকন অবশ্যই চিকিৎসকদের নেওয়া ঠিক নয়। কেননা এই টাকাটা শেষ পর্যন্ত রোগীর ঘাড়ে গিয়ে বর্তায়। আমরা চাইব নজরদারি করার দায়িত্ব যাদের, তারা যদি তাদের কাজ জোরদার করে, তাহলে এগুলো কমে আসবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম সোমবার যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের কার্যক্রম কোনো ক্রমেই কাম্য নয়। মেডিকেল এথিকস এ ধরনের কাজ কখনই সমর্থন করে না। তবে আমরা এ ধরনের অনৈতিক কাজ বন্ধ করতে পারব না। আমাদের সে ধরনের ম্যাকানিজমও নেই। আমরা যেটা করতে পারি-কেউ যদি সুনির্দিষ্টভাবে কোনো চিকিৎসকের নামে কোম্পানির কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে ওষুধ লেখার অভিযোগ করেন, তখন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে তদন্ত করে দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। আবার গুরুতর অপরাধ হলে ওই চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন সনদ বাতিল কিংবা স্থগিতও করা যাবে।

রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ফুটপাতে বসেছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়তি উপহারসামগ্রীর বাজার। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কোম্পানি চিকিৎকদের দেওয়া এসি, ফ্রিজ, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্য, সাবান, ডায়েরি, প্যাড, কলম, চকলেট, সিরামিকসহ নানা ধরনের পণ্য। বিক্রেতা বলছেন, ডাক্তারদের যখন অনেক উপহার জমা হয়, তখন তারা ফোনে কল দিলে সেগুলো সংগ্রহ করেন এই দোকানিরা। এগুলো কিছুটা স্বল্পমূল্যেও কিনছেন ক্রেতারা। ফলে বিক্রিও হচ্ছে ভালো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বিক্রেতা বলেন, একজন ডাক্তার কতগুলো পণ্য ব্যবহার করতে পারেন। আমাদের দেশে ৩০০টির মতো ওষুধ কোম্পানির প্রায় সবাই ডাক্তারদের উপহার দেয়। ফলে আমরা সেগুলো কিনে এনে বিক্রি করি। এতে ডাক্তারদের যেমন লাভ হয়, তেমনই ক্রেতাদেরও লাভ হয়।

সূত্র জানায়, কোম্পানিগুলোর অশুভ মার্কেটিং প্রতিযোগিতার কারণে অনেক বিদেশি কোম্পানি এদেশ থেকে তাদের ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হয়েছে।

যেমন: গ্লাক্সো স্মিথ ও স্যানোফির মতো বিদেশি কোম্পানি চলে গেছে। কেননা তারা একটা ইন্টারন্যাশনাল নমস ফলো করে। ফলে দেশীয় একটি কোম্পানি অনৈতিক যে চর্চা করে, সেটি বিদেশি কোম্পানিগুলো করতে পারে না। এতে ডাক্তাররা মানের হিসাব না করে উপহার না পাওয়ায় ভালো কোম্পানি হলেও তাদের ওষুধ লেখেন না। ফলে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় তারা টিকতে পারেন না। এসব কারণে ওষুধশিল্পে বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছে।

স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান বলেন, এমন অনৈতিক চর্চা অবশ্যই কাম্য নয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার নিয়ে আমরা মন্ত্রণালয় থেকে স্বল্প মেয়াদে দুই মাসের একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরির জন্য আগামী সপ্তাহে বৈঠক করব। পরে দীর্ঘ মেয়াদে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে পরিকল্পনা করা হবে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধে চিন্তাভাবনা চলছে।


প্রিন্ট
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

ফরিদপুরে চেয়ারম্যানের শেল্টারে চায়না দুয়ারি জালের কারখানার রমরমা ব্যবসা, প্রশাসনের অভিযানে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা

ওষুধ কোম্পানির উপঢৌকনে সর্বনাশ হচ্ছে রোগীর

আপডেট সময় ০৯:২৯:২৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই ২০২৫

ফলো করুন

চিকিৎসকদের প্রতিযোগিতা করে উপঢৌকন দিচ্ছে ওষুধ কোম্পানিগুলো। এক্ষেত্রে নিজেদের তৈরি ওষুধ, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্য, বিদেশ সফর, নানা সামগ্রীসহ নগদ অর্থও দেওয়া হচ্ছে। ফলে অধিকাংশ ডাক্তার নির্দিষ্ট কোম্পানির, এমনকি মানহীন ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধও লিখছেন। ফলে পকেট কাটা যাচ্ছে রোগীদের। শুধু বাড়তি অর্থ যে যাচ্ছে তাই নয়, এর সঙ্গে জনস্বাস্থ্যও পড়ছে হুমকির মুখে। স্বাস্থ্য খাতে এ অরাজকতা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব ডাক্তারই যে এটা করছেন তা নয়, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমনটা হয়ে থাকে। এটা অবশ্যই ডাক্তারদের নীতি-নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কারণ, একজন রোগী বিপদে পড়ে বিশ্বাস নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যান। আর সেই বিশ্বাস নিয়ে খেলা করা সভ্যসমাজে চলতে দেওয়া যায় না। কেননা অনৈতিক এই চর্চার কারণে রোগীদের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যয় বেড়ে যায়। এদিকে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব বলছেন, সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে স্বল্প মেয়াদে দুই মাসের অ্যাকশন প্ল্যান নিতে আগামী সপ্তাহে বৈঠক করা হবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে যেভাবে ওষুধের মার্কেটিং করা হয়, সেটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে মেলে না। বিদেশে নতুন ওষুধ তৈরি হলে বিজ্ঞাপন দেয়। কিন্তু এখানে মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে বলে সেটি হয় না। রিপ্রেজেনটেটিভের মাধ্যমে সরাসরি বিজ্ঞাপন করা হয়। এতে দেখা যায়, অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিংয়ের কারণে ক্ষেত্রবিশেষে ওষুধ উৎপাদনের খরচ ৫০-৭০ শতাংশ বেড়ে যায়। ফলে এর প্রভাব পড়ে ওষুধের দাম ও মানের ওপর। সাধারণত শীর্ষ কোম্পানিগুলোর চেয়ে অখ্যাত কোম্পানিগুলো বেশি কমিশন দিচ্ছে। এ কারণে গ্রামগঞ্জসহ সারা দেশে গ্রাম্য চিকিৎসক, ফার্মেসি কর্মী-দোকানদাররা নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি করতে উৎসাহ দেখান। ফলে মানুষ দুইদিক দিয়ে ঠকছে। এক হচ্ছে বেশি টাকা খরচ, দুই মানহীন ওষুধ নিতে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে মানুষ প্রয়োজনের বেশি ওষুধ সেবন করছেন। কেননা আমাদের দেশে কী পরিমাণ ওষুধের প্রয়োজন এবং উৎপাদন কী পরিমাণ হচ্ছে, সেটির হিসাব সরকারের কাছে নেই। ফলে উৎপাদিত ওষুধ নিয়ে কোম্পানিগুলো অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং করে থাকে। এ ধরনের মার্কেটিং অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওষুধ কোম্পানির মেডিকেল প্রমোশন অফিসাররা দায়িত্বরত ডাক্তারদের নানা কৌশলে খামের ভেতরে করে দিচ্ছেন তার প্রাপ্য কমিশন। আবার কেউ দিচ্ছেন দামি মোবাইল ফোন, কেউবা দিচ্ছেন দামি উপহার। এভাবে ডাক্তাররা ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি বা মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। উপহারের মধ্যে রয়েছে বিদেশে যাওয়ার যাবতীয় খরচ, ঘরের ফার্নিচার, এসি, ফ্রিজ, টেলিভিশন, ল্যাপটপ, দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে সেমিনারের নামে ট্যুরের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন জিনিস। এমন চিকিৎসকও রয়েছেন, যারা নিজেদের ছেলেমেয়ের বিয়ের খাবারের সম্পূর্ণ খরচ নিয়ে থাকেন বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে। এসব কারণেই ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা হয়ে উঠছেন বেপরোয়া। তারা কোথাও কোনো নিয়মনীতি মানছেন না। যখন-তখন ডাক্তারদের কক্ষে ঢুকে দীর্ঘ সময় অবস্থান করছেন। এ কারণে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে রোগীদের। আবার রোগীরা ডাক্তার দেখিয়ে বাইরে এলেই তাদের প্রেসক্রিপশন নিয়ে চলে টানাটানি। এমন চিত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ দেশের প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের। এমনকি গ্রামে পল্লিচিকিৎসক, রুরাল মেডিকেল প্র্যাকটিশনার (আরএমপি) এবং ফার্মেসির মালিক ও কর্মীদেরও উপঢৌকন দেওয়া হচ্ছে। কারণ, দেশের ফার্মেসিগুলো থেকেও প্রেসক্রিপশন ছাড়া অনেক মানুষ রোগের উপসর্গ বলে ওষুধ নিয়ে থাকেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওষুধ কোম্পানির একজন প্রতিনিধি জানান, আগে তো প্যাড, কলম ও নিজস্ব উৎপাদিত ওষুধ স্যাম্পল হিসাবে দিলেই হতো। এখন দিন বদলেছে-বড় বড় ইলেকট্রনিক্স পণ্য, নগদ টাকাসহ কমিশন পর্যন্ত দাবি করা হয়। আমরাও বাধ্য হয়ে তাদের দাবি পূরণে কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা করি। একজন চিকিৎসক বলেন, এমন উপহার বা উপঢৌকন অবশ্যই চিকিৎসকদের নেওয়া ঠিক নয়। কেননা এই টাকাটা শেষ পর্যন্ত রোগীর ঘাড়ে গিয়ে বর্তায়। আমরা চাইব নজরদারি করার দায়িত্ব যাদের, তারা যদি তাদের কাজ জোরদার করে, তাহলে এগুলো কমে আসবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম সোমবার যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের কার্যক্রম কোনো ক্রমেই কাম্য নয়। মেডিকেল এথিকস এ ধরনের কাজ কখনই সমর্থন করে না। তবে আমরা এ ধরনের অনৈতিক কাজ বন্ধ করতে পারব না। আমাদের সে ধরনের ম্যাকানিজমও নেই। আমরা যেটা করতে পারি-কেউ যদি সুনির্দিষ্টভাবে কোনো চিকিৎসকের নামে কোম্পানির কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে ওষুধ লেখার অভিযোগ করেন, তখন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে তদন্ত করে দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। আবার গুরুতর অপরাধ হলে ওই চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন সনদ বাতিল কিংবা স্থগিতও করা যাবে।

রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ফুটপাতে বসেছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়তি উপহারসামগ্রীর বাজার। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কোম্পানি চিকিৎকদের দেওয়া এসি, ফ্রিজ, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্য, সাবান, ডায়েরি, প্যাড, কলম, চকলেট, সিরামিকসহ নানা ধরনের পণ্য। বিক্রেতা বলছেন, ডাক্তারদের যখন অনেক উপহার জমা হয়, তখন তারা ফোনে কল দিলে সেগুলো সংগ্রহ করেন এই দোকানিরা। এগুলো কিছুটা স্বল্পমূল্যেও কিনছেন ক্রেতারা। ফলে বিক্রিও হচ্ছে ভালো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বিক্রেতা বলেন, একজন ডাক্তার কতগুলো পণ্য ব্যবহার করতে পারেন। আমাদের দেশে ৩০০টির মতো ওষুধ কোম্পানির প্রায় সবাই ডাক্তারদের উপহার দেয়। ফলে আমরা সেগুলো কিনে এনে বিক্রি করি। এতে ডাক্তারদের যেমন লাভ হয়, তেমনই ক্রেতাদেরও লাভ হয়।

সূত্র জানায়, কোম্পানিগুলোর অশুভ মার্কেটিং প্রতিযোগিতার কারণে অনেক বিদেশি কোম্পানি এদেশ থেকে তাদের ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হয়েছে।

যেমন: গ্লাক্সো স্মিথ ও স্যানোফির মতো বিদেশি কোম্পানি চলে গেছে। কেননা তারা একটা ইন্টারন্যাশনাল নমস ফলো করে। ফলে দেশীয় একটি কোম্পানি অনৈতিক যে চর্চা করে, সেটি বিদেশি কোম্পানিগুলো করতে পারে না। এতে ডাক্তাররা মানের হিসাব না করে উপহার না পাওয়ায় ভালো কোম্পানি হলেও তাদের ওষুধ লেখেন না। ফলে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় তারা টিকতে পারেন না। এসব কারণে ওষুধশিল্পে বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছে।

স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান বলেন, এমন অনৈতিক চর্চা অবশ্যই কাম্য নয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার নিয়ে আমরা মন্ত্রণালয় থেকে স্বল্প মেয়াদে দুই মাসের একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরির জন্য আগামী সপ্তাহে বৈঠক করব। পরে দীর্ঘ মেয়াদে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে পরিকল্পনা করা হবে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধে চিন্তাভাবনা চলছে।


প্রিন্ট