প্রতিষ্ঠানটির খুঁটির জোর নিয়ে প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের চুক্তিভঙ্গ করেও বহাল তবিয়তে সহজ
- আপডেট টাইম : ০৯:০৪:৫৩ পূর্বাহ্ণ, শুক্রবার, ১৭ জুন ২০২২
- / ১৯৩ ৫০০০.০ বার পাঠক
পদে পদে চুক্তিভঙ্গ করলেও সহজ ডটকমের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
উল্টো সহজের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভয়ে অনেকটা তটস্থ থাকে রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা। বারবার সময় নিয়েও রেলের টিকিট কাটার সবচেয়ে জরুরি মাধ্যম ‘মোবাইল অ্যাপ’ চালু করতে পারেনি সহজ।
এক্ষেত্রে জরিমানা গোনার কথা থাকলেও সেটিও দেয়নি তারা। দেশের বিভিন্ন স্টেশনে টিকিট বিক্রির কার্যক্রমেও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া টিকিট সংক্রান্ত বিভিন্ন রিপোর্টও পেশ করতে পারেনি।
এতে আর্থিক হিসাব-নিকাস স্পষ্ট করতে পারছে না রেল, রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এতকিছুর পরও সহজ বহাল তবিয়তে থাকায় প্রতিষ্ঠানটির খুঁটির জোর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, আকণ্ঠ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ায় গত বছর বাদ দেয়া হয় পুরনো টিকিটিং সংস্থা সিএনএস বিডিকে। পরে চুক্তি করা হয় সহজ ডটকমের সঙ্গে। কিন্তু যাত্রীদের অবস্থা অনেকটা ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়ার মত। সহজ দায়িত্ব নেয়ার পর বরং এখন আরও জটিল হয়েছে রেলের টিকিটিং। এর ফলে ঈদুল ফিতরের মতো এবার কুরবানীর ঈদেও টিকিট কাটায় যাত্রীদের চরম ভোগান্তির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে হঠাৎ করেই ট্রেনের সব টিকিট অনলাইনে বিক্রির পাঁয়তারা করছে সহজ। তাদের আগ্রহে ইতোমধ্যে সাড়া দিয়েছে রেলও। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে যাত্রীদের ভোগান্তি চরমে উঠবে। অভিযোগ উঠেছে, রেলওয়ে অপারেশন দপ্তরের সাবেক দুই কর্মকর্তা সহজের হয়ে অধিকাংশ কাজ সম্পন্ন করে গেছেন। প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতা কতটুকু রয়েছে, তা আমলে নেয়া হয়নি। এ কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সহজের সঙ্গে রেলওয়ের চুক্তি হয়। ওই বছরের ২১ মার্চের মধ্যে অ্যাপ চালুসহ টিকিট বিক্রয়ের পুরো কার্যক্রম যথাযথভাবে নিশ্চিত করে শতভাগ সেবা প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে চুক্তিতে। চুক্তি অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি সহজ। পরে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত অতিরিক্ত সময় দেয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। এসময় চুক্তিতে বলা হয়, ১৯ এপ্রিলের মধ্যে বিশেষ অ্যাপ এবং টিকিট বিক্রিয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতে না পারলে ২০ এপ্রিল অটোমেটিক (স্বয়ংক্রিভাবে) সহজ ডটকমের সঙ্গে চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে। এছাড়া ২১ মার্চ থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিন ৫ হাজার টাকা করে সহজ জরিমানা প্রদান করবে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ১৯ এপ্রিলের মধ্যেও সহজ তাদের সিস্টেম কার্যক্রম নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ২০ এপ্রিল থেকে সহজের কার্যক্রম অবৈধ হয়ে যায়। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক কর্মকর্তা জানান, চুক্তি ভঙ্গ করলেও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ‘অদৃশ্য’ এক নির্দেশনায় (অলিখিত) আরও প্রায় ২ মাস বাড়িয়ে ১০ জুন পযর্ন্ত সময় দেয়া হয় সহজকে। কিন্তু ১০ জুনের মধ্যেও সহজ নির্দিষ্ট অ্যাপ তৈরি করতে পারেনি।
রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য, সহজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রেল ও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কোনো নির্দেশনারই প্রয়োজন নেই। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, তারা এখন অবৈধ। প্রতিষ্ঠানটি বাড়তি সময়ে জরিমানাও দেয়নি বলেও জানান তারা। অভিযোগ উঠেছে, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে লাভবান করতে রেল ও মন্ত্রণালয়ের কিছু ‘কর্মকর্তা’ সহজের হয়ে কাজ করছে। আবার রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একটি অংশ বলছেন, সহজ চুক্তি ভঙ্গ করে বর্তমানে অবৈধভাবে কাজ করলেও তাদের কিছুই করার নেই।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, অনলাইনে টিকিট বিক্রি করলে মুনাফা হবে অপারেটরের। এ কারণেই তারা সব টিকিট অললাইনে বিক্রি করতে চাইছে। অনলাইনে টিকিট কাটা হলে অতিরিক্ত ২০ টাকা চার্জের মধ্যে ৪ টাকা ১০ পয়সা পায় সরকার। বাকি ১৫ টাকা ৯০ পয়সা পায় ভেন্ডর। অন্যদিকে কাউন্টারে টিকিট বিক্রিতে সহজ পায় মাত্র ২৫ পয়সা।
সূত্রমতে, রেলওয়ের সঙ্গে সহজের চুক্তি হয়েছে টিকিটপ্রতি ২৫ পয়সা দেয়া হবে। ৫ বছরে ২০ কোটি টিকিট বিক্রির পরিকল্পনা রয়েছে। সে হিসাবে সহজকে ৫ কোটি টাকা দেবে রেলওয়ে। সহজ তাদের দর প্রস্তাবের সঙ্গে ৫ বছরে ২৫ কোটি টাকা রেলের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন বাবদ আয়ের শর্ত উল্লেখ করেছে। অথচ দরপত্রে রেল এ ধরনের কোনো অপশনই রাখেনি। বিজ্ঞাপনের সুযোগ দরপত্রে রাখলে ৫ কোটি টাকা অপারেটরকে না দিয়ে উল্টো ১৪ কোটি টাকা রাজস্ব খাতে পেত রেল।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত ঈদুল ফিতরে ৩ দিন টিকিট বিক্রি কার্যক্রমে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ সময় বহু যাত্রী অনেক চেষ্টা করেও টিকিট পাননি। এর আগে ২৫ থেকে ২৮ মার্চে পুরো সার্ভার ডাউনের কারণে যাত্রীরা টিকিট কাটতে পারেননি। ওই সময়ে প্রায় ৩ কোটি টাকার টিকিট অবিক্রিত থেকে যায়। চলতি বছরের ৪ এপ্রিল সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা-১ এর পক্ষে হামিদুল ইসলাম পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা বরাবর লিখিতভাবে জানান, উল্লেখিত সময়ে সার্ভার ক্রটির কারণে অধিকাংশ টিকিট বিক্রি হয়নি। এতে রেলে রাজস্ব আয় বঞ্চিতসহ চরমভাবে ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার বিকালে রেলপথ মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন যুগান্তরকে বলেন, সহজের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। আমরা অভিযোগগুলো আমলে নিচ্ছি। চুক্তির শর্ত ভঙ্গসহ তাদের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে অনিয়ম-ত্রুুটির প্রমাণ পাওয়া গেলে নিশ্চয়ই যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। সামনে ঈদুল আজহা, আমরা যাত্রীদের কাছে টিকিট বিক্রয়ে সর্ব উত্তম ব্যবস্থা করতে চাচ্ছি। এখানে সহজ কিংবা সংশ্লিষ্টদের ত্রুটি হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। সহজ বলছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের করা মোবাইল অ্যাপস চালু করা হবে।
চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অ্যাপস কেন তৈরি করতে পারেনি-এমন প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, তারা কি করছে, কি করতে পারছে না-সবই লিখিত রয়েছে। প্রতিটি বিষয়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। তবে তারা বলেছে আগামী ঈদের আগে অ্যাপস চালু করবে।
রেলপথ সচিব ড. হুমায়ুন কবির যুগান্তরকে বলেন, গণমাধ্যমে সহজের চুক্তি ভঙ্গ-অনিয়মের সংবাদ উঠে আসছে। রেলওয়ের পক্ষ থেকে আমাকে এখনও লিখিতভাবে কিছু জানানো হয়নি। চুক্তির বাইরে সহজ কিছু করার অধিকার রাখে না। আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাবছি, চুক্তি ভঙ্গ হলে সহজসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রেলওয়ের বক্তব্য:
এ বিষয়ে রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী যুগান্তরকে বলেন, সহজের চুক্তি ভঙ্গ বারবারই হচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী বিশেষ অ্যাপ এখনও করা হয়নি। আমরা প্রতিনিয়তই সহজের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাচ্ছি। গত ঈদে বেশ কয়েকদিন টিকিট বিক্রি করা যায়নি, এতে রেলের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এমন অবস্থায় আসছে ঈদে টিকিট বিক্রয়ে যাত্রীদের ভোগান্তি হলে-রেলের পুরো সেবা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। চুক্তি অনুযায়ী, সহজ কাজ করছে না, বরং চুক্তি ভঙ্গ করছে। বিষয়টি আমরা উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাচ্ছি। নিশ্চয় যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা যাত্রীদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে চাই।
সহজের বক্তব্য:
এ বিষয়ে বুধবার সন্ধ্যায় সহজ ডটকম লিমিটেডের জনসংযোগ কর্মকর্তা ফরহাত হোসেন বলেন, আমরা এখনও অ্যাপস চালু করতে পারিনি।
তবে অ্যাপস তৈরি করে গুগুলে দেয়া হয়েছে। ওখান থেকে নিশ্চিত হলেই কার্যক্রম চালু করা যাবে। আমরা কোনো চুক্তি ভঙ্গ করিনি, যা করছি রেলপথ মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানেন।
চুক্তি ভঙ্গ যেহেতু হয়নি- তাই জরিমাও দেয়া হয়নি। আর শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রির বিষয়টি খোদ রেলপথ মন্ত্রী বলেছেন পঞ্চগড়ের একটি সভায়। তবে, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকে আমরা অনলাইনে শতভাগ টিকিট বিক্রির বিষয়ে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেছি।