গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয় শিক্ষার্থী নির্যাতনে চাপ উচ্ছৃঙ্খল পুলিশের বিদায়ি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে
- আপডেট টাইম : ০৮:১১:২৯ অপরাহ্ণ, বুধবার, ৭ আগস্ট ২০২৪
- / ৬৩ ৫০০০.০ বার পাঠক
ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিআইজি হারুন অর রশীদ, অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব সরকার, সুদীপ চক্রবর্তী, নুরুন্নবী, মেহেদী হাসানসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের আশ্বাসে বেপরোয়া পদক্ষেপ
নেসারুল হক খোকন।
কোটা আন্দোলন নিয়ে ছাত্রদের ওপর দমন-পীড়ন ও জোরজবরদস্তি না চালাতে সতর্ক করা হয়েছিল বিদায়ি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে চলমান আন্দোলন দমন করতে গেলে নানা ধরনের নেতিবাচক অবস্থা তৈরির আশঙ্কার কথাও বলা হয়। এমনকি কোটা পদ্ধতি বাতিল না করলে দীর্ঘ মেয়াদে সরকারের ওপর প্রভাব পড়বে বলেও জানানো হয়। তাই শুরু থেকেই শক্তি প্রয়োগ না করে যৌক্তিক সংস্কার করে ছাত্রদের ঘরে ফেরাতে উদ্যোগ নিতে সতর্ক করা হয়। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) গোয়েন্দাদের পাঠানো এমন সতর্কতামূলক প্রতিবেদনকে গুরুত্ব দেননি বিদায়ি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাস্তবে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পরামর্শ অনুসরণ করা হয়নি। কিছু উচ্ছৃঙ্খল পুলিশ কর্মকর্তার চাপে শিক্ষার্থীদের ওপর বল প্রয়োগ করা হয়। তাদের নির্দেশেই আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো হয়। এতেই বিস্ফোরণ ঘটে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অভিভাবক ও বিক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায় নেমে আসেন। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়।
যে ছাত্রলীগ দিয়ে আন্দোলনকারীদের রাজপথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য হামলা চালানো হয়, সেই ছাত্রলীগের বড় একটি অংশ কোটা আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয় গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।
এমন প্রতিবেদন পাঠানোর পরও কেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানো হলো-জানতে চাইলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন একাধিক উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা। বুধবার তারা আলাদাভাবে যুগান্তরকে বলেন, শেখ হাসিনা সদ্যবিদায়ি ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল কর্মকর্তার পরামর্শে হার্ডলাইনে যাওয়ার পথে অগ্রসর হন, যা পুরো পুলিশবাহিনীর অন্তত ২শ বছরের ইতিহাসে ক্ষত সৃষ্টি করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাইছেন না। তাই নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, নিউমার্কেট, শাহবাগ, মতিঝিল, পল্টন, শ্যামপুর, ভাটারা ও উত্তরার দুই থানা এলাকার দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে বেশি হতাহত হন ছাত্র-জনতা। এ হতাহতের সংখ্যা কয়েকজন থেকে শত শত হওয়ার ঘটনা পুলিশকে জনবিচ্ছিন্ন করে দেয়। এভাবেই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আক্রোশ বাড়তে থাকে। যে কারণে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এই ছাত্র-জনতা হতাহতের পর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অভিভাবক ও সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়তে থাকে। এরপর সবকিছু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
এক প্রশ্নের জবাবে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আত্মগোপনে থাকা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে প্রতিদিনের গোপন মিটিং বাস্তবায়ন করেছেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। তার সঙ্গে সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ডিআইজি হারুন অর রশীদ, ডিবির জয়েন কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার অতিরিক্ত ডিআইজি মেহেদী হাসান, অতিরিক্ত ডিআইজি সুদীপ চক্রবর্তীসহ বেশ কয়েকজন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সারা দেশ নিয়ন্ত্রণ করেছেন বিদায়ি আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) মো. আতিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত আইজিপি কৃষ্ণপদ রায়, পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন্স) আনোয়ার হোসেন, ডিআইজি ক্রাইম জয়দেব কুমার ভদ্রসহ কয়েকজন। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে আন্দোলনকারীদের কঠোর হস্তে দমনের নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করেন রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ সুপাররা। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর মাঠ পর্যায়ের প্রায় সবাই নিজেদের আড়াল করে নেন। মাঠে ছিল থানা পুলিশ, রায়ট, রিজার্ভ ফোর্সের কনস্টেবল, এসআই ও এএসআই। যারা ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের প্রতিহত করার সব ব্যবস্থা নিয়ে হতাহত হন। এ হতাহত সংখ্যার মধ্যে অন্তত ৯৮ ভাগ অধস্তন (কনস্টেবল, এএসআই, এসআই ও ইনস্পেকটর) পর্যায়ের। এ কারণে দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন অন্তত ৪০ হাজার এসআই। নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকারও ঘোষণা দেন। বিক্ষোভ করেছেন বুধবার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে থাকা পুলিশ সদস্যরাও। তাদের প্রত্যেকেই এখন অস্ত্র চালানোর হুকুমদাতাদের বিচার চান। আলোচিত-সমালোচিত এসব পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার জন্য যুগান্তরের পক্ষ থেকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। অফিসে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু অফিসে কাউকে পাওয়া যায়নি, কেউ টেলিফোনও ধরেননি।
বুধবার নবনিযুক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ময়নুল ইসলাম সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে নিহত পুলিশ সদস্যদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে পুলিশ সদস্যদের কাছে ৫ মিনিট ২১ সেকেন্ডের একটি অডিও বার্তা পাঠান। সেখানেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিচ্যুতি, কিছুটা সিদ্ধান্তহীনতা, বিশৃঙ্খল দিশেহারা অপরেশনাল দিকনির্দেশনাকে দায়ী করা হয়। এ প্রসঙ্গে আইজিপি বলেন, যে অবর্ণনীয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে ডিউটিরত অবস্থায় অনেক তাজা প্রাণ অকালে ঝরে গেছে, তার বেদনা প্রকাশের কোনো ভাষা নেই। আইনগত ও সামাজিকভাবে পুলিশের শক্তি, মর্যাদা ও মানুষের কল্যাণ করার ক্ষমতা নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়। সাময়িক ভুলত্রুটি কিংবা ব্যক্তিবিশেষের ত্রুটিবিচ্যুতি যে কোনো পদমর্যাদার মানুষের ক্ষোভের কারণে পুলিশের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের গৌরব ধূলায় মিশিয়ে যাবে-এমনটি করতে দিলে তার ফসল আমাদের যারা স্বভাবগত প্রতিপক্ষ, সেই অপরাধীগোষ্ঠী আনন্দে ডুগডুগি বাজাবে। ফসল তাদেরই গোলা পূর্ণ করবে। যে দুর্যোগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ এখন যাচ্ছে, এর উদাহরণ ২০০ বছরের ইতিহাসে সম্ভবত নেই।
ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততা : পুলিশের বিশেষ শাখার গোপন প্রতিবেদনে সরকারকে সতর্ক করে বলা হয়, কোটা বাতিলের পক্ষে শুধু মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ছাড়া সব ছাত্রছাত্রীর সমর্থন রয়েছে। সাধারণ ছাত্র ছাড়াও ছাত্রলীগ ব্যতীত সব ছাত্র সংগঠনের এই আন্দোলনে প্রকাশ্য সমর্থন রয়েছে। ছাত্রলীগের বড় অংশেরও এই আন্দোলনের প্রতি নীরব সমর্থন রয়েছে। ফলে প্রতিদিনই ‘বৈষম্যবিরোধী’ ছাত্র আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ডিগ্রি কলেজগুলোয়ও এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে। রাজশাহী ও ময়মনসিংহ, সিলেট, বরিশাল, রংপুরে ছাত্ররা রাজপথের পাশাপাশি রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। একটা ক্ষুদ্র অংশ আন্দোলনকারীদের সমালোচনা করলেও সিংহভাগ মানুষ চলমান সংকটের জন্য সরকারকে দোষারোপ করছে। এই সংকট নিরসনে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছে।
প্রতিবেদনে সুপারিশ করে বলা হয়, কোটা বাতিলের বিষয়টি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন বিধায় সরকারের সরাসরি করণীয় নেই। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস দুটি বিষয়ে আদালতের হস্তক্ষেপ কামনা করতে পারে। (ক) হাইকোর্টের রায় স্থগিত করে আপিল বিভাগ কর্তৃক শুনানি অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টা গ্রহণ। (খ) আদালত কর্তৃক সরকারকে একটি কমিশন গঠনের নির্দেশ প্রদান। যে কমিশন কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সুপারিশ পেশ করবে।
এ প্রতিবেদনে বলা হয়, শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে চলমান আন্দোলন দমন করতে গেলে নানা ধরনের নেতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে (৯-১৩) ৫৬ ভাগ কোটা এবং ৪৪ ভাগ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হতো। এরপর কোটা বাতিলের দাবিতে তীব্র ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। ফলে সরকার এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাপ্রথা বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ পদ্ধতি চালু করে। ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের পক্ষ থেকে কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়। গত ৫ জুন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন বাতিল করে রায় দেন। হাইকোর্টের রায়ের পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঈদুল আজহার ছুটি থাকায় আন্দোলনের গতি তেমন ছিল না। সরকার ইতোমধ্যে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করে। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেই পূর্ণাঙ্গ আপিল দায়ের করার পরামর্শ দেন। সরকার হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি প্রাপ্তি সাপেক্ষে ১০ জুলাই আপিল দিন ধার্য ছিল। এর মধ্যেই ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনের অনুকরণে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে একটি প্ল্যাটফরম গড়ে তোলা হয়। ১ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল, অবস্থান কর্মসূচি ও ‘ব্লক’ চলছিল।