এবার কোরবানির রপ্তানি আয় বাড়লেও কাঁচা চামড়ার মূল্যে লস
- আপডেট টাইম : ০৫:০৮:০৫ অপরাহ্ণ, বুধবার, ১৯ জুন ২০২৪
- / ৪৮ ৫০০০.০ বার পাঠক
প্রতিবছরের মতো এবারও যৌক্তিক মূল্যে কেনাবেচা হয়নি কুরবানির পশুর কাঁচা চামড়া। দেশের বিভিন্ন স্থানে সিন্ডিকেট করে চামড়ার বাজার ধস নামানোর অভিযোগ উঠেছে। বাজার ধসের কারণে মৌসুমি বিক্রেতারা লাভের মুখ দেখেননি। অধিকাংশ স্থানে ছাগলের চামড়ার দামই মেলেনি। কুরবানিদাতার কেউ কেউ রাগে-ক্ষোভে ছাগলের চামড়া নদীতে ফেলছেন। প্রায় ১০ হাজার পিস পশুর চামড়া ফেলে দেওয়া হয় রাস্তায়। অথচ ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এ শিল্পে বেড়েছে রপ্তানি আয়।
এদিকে ঈদের তৃতীয় দিনেও সাভার ট্যানারি শিল্পনগরীতে চামড়া আসছে। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) দাবি ট্যানারিগুলোতে এরই মধ্যে ৫ লাখ পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। এ বছর তাদের প্র্রায় ৮০ লাখ পিস কুরবানির চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার প্রতিরোধে জয়পুর হিলি সীমান্তসহ দেশের বিভিন্ন পয়েন্টে সতর্কাবস্থান নিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
রাজধানীজুড়ে কুরবানির পশুর চামড়ার বড় অংশ বিক্রি হয় পুরান ঢাকার পোস্তায়। ঈদের দিন দুপুরের পর থেকে এ এলাকায় আসতে শুরু করে পশুর চামড়া। সাভারের হেমায়েতপুরে তৈরি হয়েছে আরেকটি ট্যানারি শিল্প এলাকা। গত কয়েক বছরে সেখানেও বেড়েছে বেচাকেনা।
এ বছর নির্ধারিত দামের চেয়ে একটি চামড়া গড়ে ২৭৫-৩০০ টাকা কমে মৌসুমি বিক্রেতাদের কাছ থেকে কিনছেন আড়ত মালিকরা। অন্যদিকে ছাগলের চামড়া কিনতে অনীহা ছিল। সর্বোচ্চ ১০ টাকা মূল্য দেওয়া হয় একটি ছাগলের চামড়ার। সাধারণত বড় আকারের গরুর চামড়া ৩১-৪০ বর্গফুট, মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ২১-৩০ এবং ছোট আকারের গরুর চামড়া ১৬-২০ বর্গফুটের হয়। নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, ঢাকায় মাঝারি আকারের গরুর ২৫ বর্গফুটের একটি লবণযুক্ত চামড়ার দাম হওয়ার কথা ১ হাজার ৩৭৫ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। এই হিসাব থেকে লবণ, মজুরি ও অন্যান্য খরচ বাবদ গড়ে ২৯০ টাকা বাদ দিলে ওই চামড়ার আনুমানিক মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ৮৫ টাকা থেকে ১২১০ টাকা।
সেখানে ঈদের দিন বড় ও মাঝারি আকারের গরুর কাঁচা চামড়া সর্বোচ্চ ৮০০-৯০০ টাকায় বিক্রি হয়। রাজধানীর হাজারীবাগ বাজার এবং সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে বড় ও মাঝারি আকারের চামড়া ৭০০-৮৫০ টাকায় বিক্রি হয়। বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী এবার পোস্তায় এক লাখ পিস পশুর চামড়া কেনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
মূল্যহীন ছাগলের চামড়া এবং বেঁধে দেওয়া থেকে কম মূল্যে গরুর চামড়া কেনার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মাচের্ন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আবতাব খান বুধবার যুগান্তরকে জানান, ৪২টি ছাগলের চামড়া শিল্প থেকে এখন ৪ থেকে ৫টিতে নেমে আসছে। এছাড়া ছাগলের চামড়া কুরবানিদাতা নিজেই মাংস থেকে পৃথক করে থাকেন। এতে চামড়ার প্রকৃত সাইজ কমে যায়। মূলত এই তিন কারণেই ছাগলের চামড়ার মূল্য কমছে। তিনি আরও বলেন, লবণযুক্ত চামড়ার মূল্য সরকার বেঁধে দিয়েছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কেনাবেচা করবেন বেঁধে দেওয়া মূল্যের নিচে। বিশেষ করে লবণ মেশানোসহ অন্যান্য প্রক্রিয়ায় প্রতিটি চামড়ার বেঁধে দেওয়া মূল্য থেকে ২৯০ টাকা কমে কেনাবেচা করতে হবে। সেটি করলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়বেন।
তিনি আরও বলেন, চলতি বছর চামড়ার সরবরাহ ভালো। আমরা পোস্তার ব্যবসায়ীরা ১ লাখ ৬০ হাজার কাঁচা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়েছিলাম। আশা করছি, সেই পরিমাণ চামড়া কিনতে পেরেছি।
হাজারীবাগ সনাতনগড়ের তানভির আহমেদ নামে এক মৌসুমি ক্রেতা জানান, বড় গরুর চামড়া প্রতিটি ৮০০-৯০০ টাকা, মাঝারি ৬০০-৭০০ টাকা এবং ছোট গরুর চামড়া ২০০-৩০০ টাকায় কিনছেন। কুরবানিদাতা মাহফুজুর রহমান জানান, দেড় লাখ টাকায় কেনা গরুর চামড়া মাত্র ৬০০ টাকা দিয়েছে মৌসুমি ক্রেতা।
এদিকে পুরান ঢাকার পোস্তায় খাসির চামড়া ১০ টাকা করে কেনাবেচা হয়। ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৫৫-৬০ টাকা এবং মফস্বলের জন্য ৫০-৫৫ টাকা মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এ মূল্য গত বছরের তুলনায় প্রতি বর্গফুটে ৫ টাকা বেশি। এছাড়া খাসির চামড়ার ক্রয়মূল্য প্রতি বর্গফুট ২০-২৫ টাকা এবং বকরি ১৮-২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। গত বছর খাসির চামড়ার ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয় প্রতি বর্গফুট ১৮-২০ টাকা এবং বকরির ১২-১৪ টাকা। চামড়া খাতের একাধিক বাণিজ্য সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে কুরবানির পশুর চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বিটিএর সংবাদ সম্মেলন : ঈদের প্রথম ২ দিনে প্রায় ৫ লাখ পিস কুরবানির পশুর কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। বুধবার ধানমন্ডি কনভেনশন হলে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়িশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ। তার দাবি আমরা ভালোমানের কাঁচা চামড়া সরকার নির্ধারিত দামে কিনছি। তিনি আরও জানান, সময়মতো কাঁচা চামড়ায় লবণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। এতে কাঁচা চামড়ার গুণগত মান দীর্ঘদিন ভালো থাকবে। প্রতিবছরের সংগৃহীত কাঁচা চামড়ার প্রায় অর্ধেকই আসে ঈদুল আজহার সময়।
চট্টগ্রাম : কুরবানির পশুর চামড়ার দাম নিয়ে নজিরবিহীন কারসাজির ঘটনা ঘটেছে। আড়তদাররা ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করে পানির দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য করেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। বাজার নিয়ন্ত্রণ করে আড়তদার সিন্ডিকেট কোটি কোটি টাকার চামড়া হাতিয়ে নিয়েছে। ছোট ও বড় গরুর প্রতিটি চামড়া গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় কিনে নিয়েছেন তারা। দাম না পেয়ে ১০ হাজার চামড়া নগরীতে ফেলে দিয়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। সেই চামড়া পরিষ্কার করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা টিম।
আড়তদাররা সরকার নির্ধারিত মূল্যে বর্গফুট হিসাবে চামড়া না কিনে গড়পড়তা প্রতি পিস চামড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দরে বিক্রি করতে বাধ্য করেছেন। এ অবস্থায় চামড়ার দাম না পেয়ে আড়তে না গিয়ে অনেকেই নগরীর বিভিন্ন স্থানে ১০ হাজারেরও বেশি কাঁচা চামড়া সড়কে ফেলে দিয়ে যান। সোমবার রাতে ডবলমুরিং থানার চৌমুহনী কর্ণফুলী মার্কেট, বিবিরহাট গরু বাজারের সামনে আতুরার ডিপো, মুরাদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় এসব ফেলে দেওয়া হয়। পরে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা টিম এসব চামড়া কুড়িয়ে নিয়ে তাদের ভাগাড়ে ডাম্পিং করে।
Advertisement
চামড়ার খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, প্রথম পর্যায়ে বড় গরুর চামড়া ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হলেও সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পর চট্টগ্রামের চামড়ার বড় বড় আড়তদার কারসাজি শুরু করেন। সাড়ে ৭টার পরপরই আড়তদাররা চামড়া কেনা কমিয়ে দেন। পাশাপাশি মাঠপর্যায় থেকে আড়তদারদের প্রতিনিধিরা হঠাৎ উধাও হয়ে যান। এ কারণে বিপাকে পড়েন চামড়ার মৌসুমি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।
তবে বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সভাপতি মুসলিম উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ‘চামড়া নিয়ে কোনো ধরনের কারসাজি হয়নি। বড় গরুর চামড়া বেশি দামে কেনা হয়েছে। ছোট গরুর চামড়া কম দামে কেনা হয়েছে। চট্টগ্রামে আড়াই লাখ চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। দেড় লাখের মতো চামড়া বিভিন্ন উপজেলায় মজুত রয়েছে।’
এদিকে মেহেরপুর সংবাদদাতা জানান, কুরবানির গরু-ছাগলের চামড়ার দাম না থাকায় অনেকেই ছাগলের চামড়া ফেলে দিয়েছেন। ফেলে দেওয়া চামড়া কুড়িয়ে নিয়ে গেছেন মাদ্রাসার লোকজন।
বগুড়া ব্যুরো অফিস জানায়, আড়ানীর চামড়া আড়তদার আশরাফুল ইসলাম বলেন, চাহিদা না থাকায় চামড়া কম দামে নিতে হচ্ছে। এ চামড়া কিনেও লাভ হবে কিনা জানা নেই। এরপরও কিনেছি। ফড়িয়াদের কাছে দু-এক টাকা বেশি দিয়ে চামড়া কিনেছি। এছাড়াও সমাজ প্রধানের প্রতিনিধিরা চামড়া নিয়ে আসছেন। তাদের কাছে থেকে ফড়িয়াদের মতো দাম দিয়ে কিনেছি।
রাজশাহী ব্যুরো অফিস জানায়, ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে পানির দামে। এক বা দুই লাখ টাকার একটি বড় গরুর চামড়া এবার রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে একেকটি ছাগলের চামড়ার বিক্রি হয়েছে ৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০ টাকা দামে।
রাজশাহী চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, চামড়ার দাম গত বছরের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। এবার এক হাজার টাকাতেও গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে। যা গত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি। গত বছর আমরা ৩০০ টাকাতেও গরুর চামড়া কিনেছি। সে তুলনায় এবার দাম ভালোই বলতে হবে।
যশোর ব্যুরো অফিস জানায়, দাম না পেয়ে শত শত মৌসুমি ব্যবসায়ী ছাগলের চামড়া ফেলে গেছেন যশোরের রাজারহাট চামড়া মোকামে। সেই চামড়া কুড়িয়ে মোকামের শ্রমিকরা লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করছেন শনিবারের হাটে বিক্রির আশায়। ঈদের পরদিন রাজার হাট চামড়ার মোকামে গিয়ে এ চিত্র দেখা গেছে।
হাটের শ্রমিক লিয়াকত খান বলেন, ঈদের দিন বিকালে বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে হুজুরেরা ছাগলের চামড়া বিক্রি করতে হাটে আসেন। প্রতিটা চমড়ার দাম ৫ থেকে ১০ টাকার বেশি কেউ বলেনি। এতে তাদের রিকশা ভাড়াও উঠছে না দেখে রাগে-ক্ষোভে তারা চামড়া হাটে ফেলে গেছেন। অন্তত হাজারখানেক ছাগলের চামড়া কাল পড়েছিল। সেখান থেকে ২০০ চামড়া আমি কুড়িয়ে আজ লবণ মাখিয়ে রেখেছি। শনিবার হাটের দিন বিক্রির আশায় রয়েছি।