গণমাধ্যম দিবস: কলম হোক সত্য ও স্বাধীনতার প্রতীক

- আপডেট টাইম : ০৮:৩৬:৩৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩ মে ২০২৫
- / ৩ ১৫০০০.০ বার পাঠক
বিশ্ব গণমাধ্যম দিবস-গণতন্ত্র, ন্যায় ও মানবাধিকারের রক্ষায় স্বাধীন সাংবাদিকতা অপরিহার্য। ৩ মে বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা দিবস, একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন যা শুধু সংবাদপত্র বা টেলিভিশনের জন্য নয় বরং প্রতিটি নাগরিক, রাষ্ট্র এবং সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনটি সাংবাদিকদের পেশাগত কর্তব্য পালনে স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও মর্যাদার গুরুত্ব তুলে ধরে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মানেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, যা একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক গণতন্ত্রের মূলোৎস।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যমকর্মীরা নানা ধরনের নিপীড়ন, নির্যাতন এবং হুমকির মুখোমুখি হচ্ছেন। কখনো সরকারি সেন্সরশিপ, কখনো রাজনৈতিক হুমকি, আবার কখনো সন্ত্রাসী হামলা কিংবা আইনগত জটিলতা সাংবাদিকদের নিরপেক্ষ ও মুক্তচিন্তার সাংবাদিকতা করতে নিরুৎসাহিত করছে। দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বের নানা প্রান্তে বহু সাংবাদিক হত্যা, গুম কিংবা জেলে পাঠানোর ঘটনা ঘটেছে। এই বাস্তবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, গণমাধ্যম আজও বহুক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হিসেবে টিকে আছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও আমরা দেখছি, কিছু অর্জনের পাশাপাশি অনেক চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে। যদিও ডিজিটাল প্রযুক্তি গণমাধ্যমকে ব্যাপক প্রসার ও সহজতর করেছে, তথাপি সাইবার আইনের অপব্যবহার, মামলা ও হয়রানির সংস্কৃতি, রাজনৈতিক চাপ এবং মেধাবী সাংবাদিকদের আর্থিক অনিশ্চয়তা একটি স্বাধীন গণমাধ্যমচর্চাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মফস্বল সাংবাদিকদের অবস্থা আরও করুণ। সেখানে নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, নেই প্রশিক্ষণ, নেই ন্যায্য পারিশ্রমিক আছে শুধুই অগণিত ঝুঁকি আর প্রত্যাখ্যাত স্বপ্ন।
এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র যদি গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, গণমাধ্যমই একমাত্র শক্তি, যা সরকারের কাজকর্ম, দুর্নীতি, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের চিত্র জনসম্মুখে তুলে ধরে। একটি কার্যকর গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হল, এমন একটি গণমাধ্যমব্যবস্থা, যেখানে সাংবাদিকরা ভয়ভীতি, হুমকি বা চাপমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন।
কিন্তু স্বাধীনতা শুধু মৌখিক ঘোষণায় সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। সাংবাদিকদের জন্য নিরপেক্ষ ও কার্যকর আইন, বেতন কাঠামো, পেশাগত প্রশিক্ষণ, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। সম্পাদক’দের স্বাধীনতাও আজ প্রশ্নবিদ্ধ, বিশেষ করে ব্যবসায়িক মালিকানার প্রভাবে অনেক সময় সত্যের বদলে বিজ্ঞাপন-নির্ভর নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। ফলে গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ।
এছাড়া সাংবাদিকদের সামাজিক মর্যাদাও পুনর্গঠন করতে হবে। অনেক সময়ই দেখা যায়, রাষ্ট্র সাংবাদিকদের কেবল “তথ্যদাতা” হিসেবে দেখে, অথচ তারা সমাজের বিবেক। সাংবাদিকরা কেবল খবর সংগ্রহ করেন না, বরং সত্য উদঘাটনের মাধ্যমে ইতিহাসের ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করেন। তারা সমাজের অসঙ্গতি, বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে কলম ধরেন, যা অন্য কোনো পেশা করতে পারে না।
বিশ্ব গণমাধ্যম দিবসে আমরা এ কথাও মনে করিয়ে দিতে চাই যে, শুধু সাংবাদিকদের অধিকার নয়, পাঠকেরও অধিকার আছে নির্ভরযোগ্য ও সত্যনিষ্ঠ তথ্য পাওয়ার। যখন একটি সংবাদমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করে, তখন কেবল সাংবাদিক নয় পাঠক, দর্শক ও শ্রোতাও উপকৃত হন। কারণ, তথ্যের উপর ভিত্তি করেই মানুষ মতামত গঠন করে, সিদ্ধান্ত নেয়, রাজনীতি ও সমাজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়।
অতএব, একটি রাষ্ট্র যদি সত্যিই উন্নত, মানবিক ও গণতান্ত্রিক হতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই সাংবাদিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং পেশাগত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। সংবাদপত্রে কাজ করা সাংবাদিক হোক কিংবা অনলাইন মিডিয়ার প্রতিবেদক প্রত্যেকের নিরাপত্তা, ন্যায্যতা ও মর্যাদা দিতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে হয়রানি, গ্রেফতার, দমনমূলক মামলা ও দুঃসহ বাস্তবতা রোধে রাষ্ট্রকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
একই সঙ্গে আমাদের গণমাধ্যমকেও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে শুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাতে হবে। সাংবাদিকতার নৈতিকতা, সত্যনিষ্ঠতা ও বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। যারা হলুদ সাংবাদিকতার মাধ্যমে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন কিংবা রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের মাধ্যমে পাঠকের আস্থা হারান, তাদেরও প্রতিহত করতে হবে সাংবাদিক সমাজের ভেতর থেকেই।
এই বিশ্ব গণমাধ্যম দিবসে আমরা প্রত্যাশা করি—রাষ্ট্র, সমাজ এবং সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত চেষ্টায় গড়ে উঠবে একটি সাহসী, সত্যনিষ্ঠ ও জনগণের পাশে থাকা গণমাধ্যম। যেখানে কলম হবে নিপীড়িতের ভাষা, ক্যামেরা হবে সত্যের প্রতিচ্ছবি, এবং সংবাদ হবে জনগণের আস্থা ও শক্তির প্রতীক।
তথ্যই শক্তি এই বার্তাকে হৃদয়ে ধারণ করে, চলুন আমরা একসাথে এগিয়ে যাই একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে।