পুরনো লেনদেন শেষ হচ্ছে
- আপডেট টাইম : ০৩:১০:৩৭ অপরাহ্ণ, শনিবার, ২ জানুয়ারি ২০২১
- / ৩২২ ৫০০০.০ বার পাঠক
কম-বেশি সবারই কামনা ছিল ২০২০ সাল শেষ হোক তাড়াতাড়ি। আর সেটাই হতে যাচ্ছে। আমরা ২০২০ থেকে ২০২১ সালে এ পা রাখতে যাচ্ছি। বিদায়ী ২০২০ সালের হতাশা ও বঞ্চনাকে পেছনে ফেলে ভাল কিছু প্রাপ্তির স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বরণ করে নেবে নতুন বছর অর্থাৎ ২০২১ সাল। মানুষ হিসেবে আমরা খুবই আত্মভোলা। তাই আমরা বিদায়ী দিনগুলোর কথা খুব একটা ভাবি না। অতীতের হিসাবের খাতা উল্টে দেখতে চাই না। উটপাখির মতো মুখ বুজে অতীতকে ভুলে থাকতে বেশি পছন্দ করি। তদ্রƒপ ভবিষ্যত সম্পর্কেও উদাসীন থাকি। ফলে আমাদের জীবন ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে না। অথচ নতুন বছরকে সুন্দর, উন্নত ও সমৃদ্ধ করার জন্য অতীত জীবনের হিসাব-নিকাশ অত্যন্ত জরুরী। একেকটি বছর আসে নতুন উদ্দীপনা ও নতুন প্রেরণা নিয়ে। সেই প্রেরণা নিয়েই শুরু হয়েছিল ২০২০। তার পরও বিদায়ী এই বছরে করোনাভাইরাস নামের অদৃশ্য ভাইরাসের থাবায় গোটা বিশ্ব যেমন বিপর্যস্ত হয়েছে তেমনি বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে কর্মহীন হয়ে মানবেতর দিন কাটছে খেটে খাওয়া মানুষের। আমাদের দেশসহ পৃথিবী এখন আক্ষরিক অর্থেই গভীর সঙ্কটে। রোজ টিভি বা খবরের কাগজের পাতা খুললেই দেখা যায় করোনার থাবায় বিপর্যস্ত হচ্ছে গোটা বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্রে করোনাকালের পূর্বে বেকারত্বের হার ছিল সাড়ে ৩ শতাংশ যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১৪ শতাংশের ওপরে। প্রায় ৪ কোটি মানুষ বেকার ভাতার জন্য আবেদন করেছে। করোনা মোকাবেলায় লকডাউন কার্যকর করতে গিয়ে প্রায় সব বড় অর্থনীতির দেশই এমন সমস্যায় পড়েছে। জার্মানি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেনসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বেড়েছে বেকারত্ব। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর একটি পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে ৩৩০ কোটি কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে ৮৫ শতাংশ মানুষ করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত। এসব তথ্য জানান দিচ্ছে বাংলাদেশের বেকার সমস্যা কত ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই চালিকাশক্তি হলো রফতানি আয় ও রেমিটেন্স। রফতানি আয় কমে গেলে দেশের শিল্প-কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের আয় কমে যাওয়া বা কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। অন্যদিকে প্রবাসীরা টাকা পাঠানো কমিয়ে দিলে তাদের পরিবার দেশে আগের মতো খরচ করতে পারবেন না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা বাণিজ্যে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ১০৪২ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ ভাগ বেশি। এই গতি ধরে রাখা এখন কঠিন হয়ে যাবে বাংলাদেশের জন্য।
আবার দেশে যখন সবাই করোনার থাবায় আতঙ্কিত ও শঙ্কিত ছিল তখনও প্রকটভাবে বিস্তৃত হওয়া শুরু করেছিল নারীর প্রতি সহিংসতা। সংবাদপত্র কিংবা টিভি খুললেই দেখা যেত ঢাবি শিক্ষার্থী ধর্ষণ, ধর্ষণে কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা, বন্ধুর মেয়েকে ধর্ষণ, এমসি কলেজে গণধর্ষণ, স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা, চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণ এবং বিয়ের প্রলোভনে কিশোরীকে ধর্ষণের খবর। সবগুলো বলতে গেলে শেষ করা যাবে না। কিন্ত তার পরও আমাদের দেশ থেমে নেই। পৃথিবীর বুক থেকে কোটি প্রাণ চলে গেলেও মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে প্রমাণ করেছে মানুষ মানুষের জন্য। এই সময়ে আমাদের আত্মকেন্দ্রিক সমাজ হঠাৎ করেই যেন এক অনির্বচনীয় মানবিক সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত। মানুষ আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন। আর এই মানুষগুলো হলো- সেলিব্রেটি, কর্পোরেট, রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা নেতা। আবার একেবারে সাধারণ মানুষও রয়েছে এ দলে। চীন-জাপান বৈরিতা ভুলে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে। বহির্বিশ্বের এ রকম চিত্র এখন অহরহ। বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়ে বাংলাদেশও করোনার টিকা আবিষ্কারের কাজে শামিল হয়েছে।
‘বৈশ্বিক টেকসই প্রতিযোগিতা সক্ষমতাসূচক বা গ্লোবাল সাসটেইনেবল কম্পিটিটিভনেস ইনডেস্ক (জিএসসিআই)-২০২০’ সূচকে উঠে আসে- সম্পদ দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহারের মাধ্যমে বৈশ্বিক টেকসই প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে ভারতকে ছাড়িয়ে গেল বাংলাদেশ। চলতি বছর এই সূচকে বাংলাদেশ ১৭ ধাপ এগিয়েছে, আর ভারত মাত্র তিন ধাপ। ২০২০ সালে ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫তম। অপরদিকে ভারতের অবস্থান ১২৭তম। এবারের সূচকে ভারত ছাড়াও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের চেয়ে ওপরে অবস্থান করছে। বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ, আইএমএফ, ওইসিডি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে এটি তৈরি করে সুইজারল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া যৌথ উদ্যোগ ‘সলএবিলিটি’ এবং থিঙ্কট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান সাসটেইনেবল ইন্টেলিজেন্স। ২০১২ সাল থেকে প্রতি বছর এই সূচক প্রকাশ করে আসছে সংস্থাটি। জিএসসিআই-২০২০ এ বাংলাদেশের স্কোর ৪৩ দশমিক ৩ পয়েন্ট। গত বছরের তুলনায় স্কোর ৪ দশমিক ২ পয়েন্ট বেড়েছে। অপরদিকে ভারতের স্কোর ৪২ দশমিক ৪ পয়েন্ট। বাংলাদেশের চেয়ে দশমিক ৯ শতাংশ পযেন্ট কম। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত জিএসসিআইয়ের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩২তম। আর ভারত ছিল ১৩০তম অবস্থানে। ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশ এই সূচকে ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করছে। এ ছাড়াও আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে বিশ্বের ২৯ তম প্রভাবশালী নারী। ২০১৯ সালে বিশ্বের প্রভাবশালী এক শ’ নারীর তালিকা গত ১০ ডিসেম্বর রোজ বৃহস্পতিবার প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্বস সাময়িকী। ব্যবসা, মানবসেবা, গণমাধ্যম ও রাজনীতিতে যেসব নারী নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রেখেছেন, সেসব কীর্তিময়ীকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই তালিকা। প্রভাবশালী এই শত নারীর তালিকা প্রসঙ্গে ফোর্বসের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ময়রা ফোর্বস বলেছেন, এ বছর বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারীদের তালিকায় যাঁরা স্থান পেয়েছেন, তাঁরা একেকজন উদ্ভাবক ও অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ী। তাঁরা প্রচলিত ক্ষমতাকাঠামোকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করতে বিশ্বমঞ্চে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। ফোর্বসের প্রতিবেদনে শেখ হাসিনা সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী। তিনি টানা তৃতীয়বার এবং সব মিলিয়ে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। দেশে দৃঢ়ভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
হাজারে জল্পনা-কল্পনা ছাড়িয়ে ২০২০ এর ডিসেম্বর এ পদ্মা সেতুর সর্বশেষ স্প্যান বসানোর কাজও শেষ হয়ে গিয়েছে। দেশের জনগণের মুখে-মুখে একটিই স্লোগান- নিজেদের টাকায় স্বপ্নের সেতু। এ পর্যন্ত পদ্মা সেতুর ৪১টি স্প্যান বসানো হয়েছে। এটির মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয়েছে ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে পদ্মা সেতু। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু। সেই হিসেবে ৩ বছর ২ মাস ১০ দিনে বসানো হচ্ছে সেতুর সব কয়টি স্প্যান। বন্যা, নদী ভাঙন, চ্যানেলে নাব্য সঙ্কট, করোনাভাইরাস মহামারীসহ নানা জটিলতা কাটিয়ে একে একে ৪১টি স্প্যান বসানো হয়। মূল সেতুর ২ হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাবের মধ্যে এক হাজার ২৮৫টি এবং ২ হাজার ৯৫৯টি রেলওয়ে স্ল্যাবের মধ্যে এক হাজার ৯৩০টি স্থাপন করা হয়েছে। মাওয়া ও জাজিরা ভায়াডাক্টে ৪৮৪টি সুপার-টি গার্ডারের মধ্যে ৩১০টি স্থাপন করা হয়েছে।
এবারের ২০২০ সালে আমাদের প্রত্যাশার শতভাগ পূরণ হয়নি সত্য, তবুও নতুন বছরে আমাদের প্রাণের উদ্যম ও উচ্ছ্বাসে যেন ভাটা না পড়ে। ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে। তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে’- দুঃখ-কষ্ট সবকিছু কাটিয়ে নতুন জীবনের দিকে যাত্রার প্রেরণা পেতে চাই। রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত হানাহানি থেমে গিয়ে আমাদের প্রিয় স্বদেশ যেন সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে পারে। ২০২০ সাল অনেক কারণেই স্মৃতির পাতায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। মহাকালের আবর্তে হারিয়ে গেলেও বিদায়ী বছরটি দেশের মানুষের মনে দাগ কেটে থাকবে বহুকাল ও বহু বছর ধরে। এখন নতুন বছর আর নতুন সূর্যের অপেক্ষায় দেশবাসী। অপেক্ষা কেবল করোনার টিকা, মানুষের নিরাপত্তা, শান্তি ও স্বস্তি সর্বস্তরে ফিরে আসার। আগামী পহেলা জানুয়ারি, ২০২১ সালে নতুন জীবনে যাত্রা করবে মানুষ। শুরু হবে আরও একটি নতুন বছর। নতুন বছরের সূচনালগ্নে সবার প্রত্যাশা হোক- পুরনো বছরের হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা, হানাহানি ভুলে গিয়ে নতুন বছরে নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলা। পুরনো বছরের পাপগুলো হিসাব করে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চাই। আর নতুন বছরে পুরনো পাপগুলো দ্বিতীয়বার না করার দৃঢ় সঙ্কল্প করা। কারণ, দৃঢ় সঙ্কল্প জীবনবোধ ও চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য নতুন বছরের আগমন। তাই প্রত্যাশার পারদে যোগ হোক ইতিবাচক চিন্তা চেতনা। লক্ষ্য হোক মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো। কামনা করি, সব ধরনের স্থবিরতা কাটিয়ে নতুন বছর সবার জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ। দেশে ফিরে আসুক শান্তি, সমৃদ্ধি, স্বস্তি ও গতিময়তা।