নিজেকে কতটুকু জানি? আমাদের অবস্থার ভিত্তি কী?

- আপডেট টাইম : ০৬:২০:৩১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১১ মে ২০২৫
- / ৩ ১৫০০০.০ বার পাঠক
আমরা সত্যই কতটুকু জানি নিজেদের সম্পর্কে? আমাদের চারিপাশের পৃথিবী, সমাজ, পরিবেশ, এমনকি আমাদের সত্তার গভীরে আমরা কতটুকু প্রবেশ করিতে সক্ষম হইয়াছি? এই প্রশ্নগুলির উত্তর সন্ধান করিলেই আমরা উপলব্ধি করিতে পারি-আমরা অনেক কিছুই জানি না। আমাদের জ্ঞানের সীমা আসলে সীমাহীন জগতের তুলনায় ক্ষুদ্র এক বিন্দু মাত্র। মহামতি সক্রেটিস একসময় বলিয়াছিলেন- ‘সত্যিকারের জ্ঞান তখনই আসে, যখন আমরা বুঝিতে পারি যে আমরা কিছুই জানি না।’ তিনি আরো বলিয়াছিলেন- ‘সেই ব্যক্তি জ্ঞানী, যিনি তাহার অজ্ঞতার রূপ ও পরিমাণ জানেন।’ ইহার বিপরীতে, আমাদের সমাজে অনেকে আছেন, যাহারা সামান্য বিদ্যা অর্জন করিয়া আত্মতুষ্টিতে ভোগেন এবং ভাবেন, তিনি যেন জ্ঞানের সকল সোপান অতিক্রম করিয়াছেন। এই প্রবণতাই অজ্ঞতার পরিচয়।
অজ্ঞতা স্বীকার করা লজ্জার বিষয় নহে; বরং ইহাই জ্ঞানের দিকে প্রথম পদক্ষেপ। নিজের অজ্ঞতা অনুধাবন করিলে তবেই আত্মজ্ঞান হইতে পারে। এই জন্য মনীষীরা বলিয়া থাকেন- ‘তুমি নিজেকে এক ক্ষুদ্র দেহ বলিয়া মনে করো, অথচ তোমার ভিতরে লুক্কায়িত রহিয়াছে এক বিশাল বিশ্ব।’ এই কথাটির মধ্য দিয়া স্পষ্ট হইয়া উঠে যে, নিজেকে জানিবার চেষ্টার অর্থ হইল এক বিশাল উপলব্ধির যাত্রা শুরু করা।
আমাদের জন্ম হইতেছে একক কোষরূপে; ক্রমে আমরা লক্ষ-কোটি কোষের এক বিস্ময়কর শরীরে পরিণত হই। আমাদের মস্তিষ্কের নিউরনসমূহ যে জটিল প্রক্রিয়ায় কাজ করে, তাহা আজও বিজ্ঞানের জন্য রহস্যরূপে বিরাজমান। আইজ্যাক নিউটন বলিয়াছেন, ‘আমি নিজেকে সমুদ্রতীরে খেলা করা এক ছোট বালকের মতো মনে করি, যে কখনো সুন্দর নুড়ি খুঁজিয়া আনন্দিত হইতেছে, কিন্তু সামনের বিশাল সমুদ্র রহিয়াছে অনাবিষ্কৃত।’ এই বোধই হইতেছে জ্ঞানের প্রকৃত চেতনা।
আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে-ইহা বুঝা জরুরি। যাহারা নিজেদের জানেন না, তাহারা নিজের সীমাবদ্ধতাও জানেন না। ফলত তাহারা নিজেদের এমন কিছু ভাবেন, যাহা তাহারা নন। মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষের সাধ্যানুযায়ীই তাহার উপর দায়িত্ব অর্পণ করেন। আল-কুরআনের আয়াতে (সুরা বাকারা: ২: ২৮৬) বলা হইয়াছে যে, আল্লাহ কাহারো ওপর তাহার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা দেন না।
এই বিশ্বাস আমাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মচেতনা জাগ্রত করিতে সাহায্য করে। এখন, নিজেকে জানিবার জন্য চাই আত্মসময়। এই আত্মসময় হইতে পারে ধ্যান, চিন্তা, আত্মপর্যালোচনার মধ্য দিয়া। জালালউদ্দিন রুমির ভাষায়, ‘নিজের হৃদয় খনন করো, যেখানে তুমি সোনা পাইবে, কারণ সোনার খনি তো তোমার ভিতরেই।’ এই আত্মখননই হইতেছে আত্মজ্ঞানের প্রকৃত পথ।
নিজেকে জানিবার পাশাপাশি প্রয়োজন নিজেকে ভালোবাসা। এই ব্যাপারে গৌতম বুদ্ধ বলিয়াছেন, ‘তুমি নিজেকেই যেইভাবে ভালোবাসা ও অনুগ্রহের যোগ্য মনে করো, ঠিক সেইভাবেই সমস্ত বিশ্ববাসীও তাহার প্রাপ্য।’ এই কথার দ্বারা আমরা উপলব্ধি করিতে পারি, নিজেকে ভালোবাসিলে অন্যকে ভালোবাসিবার শক্তিও আসে।
এইখানে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলি উল্লিখিত হওয়া আবশ্যক-তাহা হইল-ধৈর্য। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধৈর্য অপরিহার্য। কনফুশিয়াস বলিয়াছেন- ‘ধৈর্যের অভাবেই অনেক সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটে।’ জালালউদ্দিন রুমি ধৈর্যকে ব্যাখ্যা করিয়া বলিয়াছেন, ‘ধৈর্য মানে বসিয়া থাকিয়া প্রতীক্ষা করা নহে; ইহা ভবিষ্যতের দিগন্তকে দেখতে পাওয়া।’ আমরা যদি তাড়াহুড়া করি, তবে আমরা কখনোই আমাদের সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ ঘটাইতে পারিব না। যদি আমরা নিজেরা নিজেদের বুঝিতে না পারি, তবে অপরকে কখনোই বুঝিতে পারিব না।
অতএব, শেষমেশ আমাদের আবার সেই চিরন্তন ও চিরসত্য বাক্যটির দিকেই ফিরিয়া তাকাইতে হইবে- ‘নো দাইসেলফ’- নিজেকে জানো। আমরা এই সত্যের দিকে তাকাই না বিধায় আমাদের চারিদিকে এত সমস্যা। একটিবার প্রত্যেকের নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত-‘কে আমি? আমি এখন এই অবস্থায় আছি অথবা আসিয়াছি, তাহার ভিত্তি কী?’ ইহা সকলের জন্যই প্রযোজ্য।