নাড়ির টানে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে ঘর মুখো মানুষ-সদরঘাটে উপচে পড়া ভিড়
- আপডেট টাইম : ১০:৪১:৩৫ পূর্বাহ্ণ, বুধবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৩
- / ২৭২ ৫০০০.০ বার পাঠক
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর।
দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদ আসে খুশি আর আনন্দের বার্তা নিয়ে। ঈদ কেন্দ্র করে সমাজের প্রায় সব শ্রেণির মানুষের থাকে নানা আয়োজন। এর মধ্যে অন্যতম হলো ঈদে বাড়ি ফেরা। ঈদ উপলক্ষে নাড়ির টানে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য মানুষ তাদের কর্মক্ষেত্র বা অস্থায়ী আবাস ছেড়ে পাড়ি জমায় জন্মভিটায়। কেউ বাসে, কেউ ট্রেনে কিংবা লঞ্চে।
সদরঘাটে গিয়ে এমনটি দৃশ্য দেখা যায়,
পদ্মা সেতুর কারণে লঞ্চে কিছুটা যাত্রী আগে কম থাকলেও ঈদের ছুটির কারণে ঘর মুখ অনেক মানুষরাই এবার লঞ্চকে বেছে নিয়েছেন, এ প্রধান কারণ হচ্ছে অনেকেই ঝাকুনি সহ্য করতে পারেন না,
ঝাঁকুনি যাদের ঝাকুনি সহ্য করার ক্ষমতা নেই তারা গন্তব্যে ফেরার জন্য লঞ্চকে বেশি পছন্দ করে থাকেন।
কারণ নিজ গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য সারা রাস্তায় বমি করতে করতে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ে, রথযাত্রায় এমনটি হয় না।
এবার-কম করে হলেও দেশের অনেকেই এখন বাড়িতে যান আকাশপথে যবেন যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো রয়েছে, স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের বিশেষ করে নগরের উন্নয়ন ঘটেছে দ্রুতগতিতে। নগরগুলো আজ শিল্পায়নের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠায় প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মূলত কর্মসংস্থানের আশায় মানুষ নগরে পাড়ি জমায়। সঙ্গত কারণে ঈদ কেন্দ্র করে বিপুলসংখ্যক মানুষ দেশের প্রান্তিক এলাকায় আবার ছড়িয়ে পড়ে।
ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া এ দেশের মানুষের কাছে অনেকটা যেনো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঈদ উৎসব কেন্দ্র করে নগর ছেড়ে বাড়ির ফেরার এমন ঘটনা বিশ্বে বিরল নয়।
তো চলুন জেনে আসি এবার ঈদে ঘরমুখো কতগুলো মানুষ যাত্রা করবে
এবারের ঈদুল ফিতরে ইন্দোনেশিয়ার ৯ কোটি মানুষ তাদের কর্মস্থল থেকে গ্রামের বাড়িতে যাবে।
আর বাংলাদেশে শুধু রাজধানী শহর ঢাকা থেকে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ ঈদের আগে বাড়ি ফিরতে আগ্রহী। এই হিসাব অনুযায়ী ঈদের আগের দিন পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ এ শহর ত্যাগ করবে বাড়ির উদ্দেশে। এবার লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রতিদিন যানবাহনের ধারণক্ষমতা রয়েছে ১৬ লাখ। এর মধ্যে বাসে ৮ লাখ, ট্রেনে এক লাখ, লঞ্চে ১ লাখ ২৫ হাজার, মোটরসাইকেলে ৩ লাখ ও প্রাইভেট কারে ৩ লাখ রয়েছে।
জীবন-জীবিকার তাগিদে বড় বড় শহরে আবাস গড়ে তোলেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। এসব নগরের অধিকাংশ মানুষের নিজের বাড়ি নেই। তারা ভাড়া বাসায় থাকেন। তাই ঈদের লম্বা ছুটিতে তাদের বেশিরভাগই চান পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মনের গভীরে বাড়ি বলে যে ছবিটি আঁকা থাকে, এর মূল অবস্থান হচ্ছে গ্রামে। ঈদ উপলক্ষে ওই বাড়ি বা গ্রামে দিনকয়েকের জন্য হলেও ফিরে যাওয়া, আদতে নিজেকেই ফিরে পাওয়ার অনুভূতিটাই আলাদা।
ঈদে-পার্বণে বাড়ি ছুটে যাওয়া- এটি বাংলাদেশের মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করার জন্য সবাই বাড়ি ফিরছে, তাদের চোখ-মুখে খেলা করছে অন্য রকম দ্যুতি!
কী ওই অমোঘ টান- যার জন্য মানুষ শত কষ্ট স্বীকার করে ঘরে ফিরছে?
যানবাহনে কোথাও পা ফেলার উপায় নেই। তবুও কারও মধ্যে এতটুকু বিরক্তি নেই। সবাই নিজে ও চেনা-অচেনা অন্যদের সঙ্গে ফিরছেন আপন নিবাসে। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করা,
কারও মা-বাবার প্রতি টান, কারও পূর্বপুরুষের ফেলে যাওয়া বসতভিটার প্রতি অনুরাগ, কেউ সন্তানকে তার শিকড়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চান। আবার কেউ চান পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী- সবার সঙ্গে দেখা ও কুশল বিনিময় করতে।
আর আর এই কারণে গ্রাম বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল গুলো তাদের ভিরে মুখরিত হয়ে ওঠে,
পারিবারিক বন্ধন বা সংহতি বজায় রাখার তাগিদও দেখা যায় অনেকের মধ্যে। এমন আরো অজস্র কারণ নগরবাসীকে টেনে নিয়ে যায় তার নিজ গ্রামের বাড়িতে। এই ফিরে যাওয়ায় অনেক সময় প্রেরণা হয়ে থাকে। গ্রামের মাঠ, গ্রামের চায়ের দোকানের আড্ডা, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীটি, যে খালে নাইত ছোটবেলায়, যে বটগাছটির কাছে গিয়ে আশ্রয় মিলত বৃষ্টিতে-রোদে- সবই মনের মধ্যে কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে। বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর গ্রামীণ সমাজও মানুষের ঈদে নগর ছাড়ার অন্যতম কারণ।
নগরে যারা বাস করেন,
সেই সকল মানুষদের বেশিরভাগের শিকড় হচ্ছে গ্রামে। এখনো কারও মা-বাবা, কারও দাদা-দাদি বা অন্যান্য আত্মীয় রয়ে গেছেন গ্রামে। এক বা দুই প্রজন্মের নগরবাসী হয়েও তারা ওই শিকড় ভুলতে পারেননি।
তাই তারা ঈদের আনন্দে ফিরে যেতে চান ওই শিকড়ের কাছে।
যদিও নাগরিক ব্যস্ততা ক্ষণিকের জন্য এসব আবেগ চাপা দিয়ে রাখে, তবুও ছুটির দিনগুলোয় ওই স্মৃতিগুলো কাতরাতে থাকে। তখন অনেক দূরে থাকলেও মন চলে যায় স্মৃতির কাছে।
ঈদ পর্বের সঙ্গে ধর্মীয় কিছু বিষয় জড়িত থাকে।
যেমন- অনেকেই ঈদের নামাজ আদায় করার পর পরই চলে যান মৃত মা-বাবা বা দাদা-দাদির কবর জিয়ারত করতে।
তাই নগরে অনেকের স্থায়ী আবাস হলেও অন্তত মা-বাবার কবরের টানেও তাকে ফিরে যেতে হয়। সারাবছর না গেলেও অন্তত ঈদের ছুটিতে যাওয়ার সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চান না।
ঈদে বাড়ি ফেরার এটিও একটি কারণ বলে মনে হয়।
গ্রামে ফেরার সুফল হচ্ছে গ্রাম-শহরের মেলবন্ধন। স্বল্পসময়ের মেলামেশায় ভাবের যেটুকু আদান-প্রদান ঘটে, তা আত্মিক উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখে।
গ্রামের পরিবেশ হয়ে ওঠে মনোরম।
আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগব্যবস্থার বিকাশ এমনিতেই শহর আর গ্রামের মধ্যকার দূরত্ব কিছুটা হলেও কমিয়ে দিয়েছে। ঈদ উপলক্ষে গ্রামে ফেরা এ ধারা আরও এগিয়ে নিতে পারে। যান্ত্রিকতার এ যুগে ভাইবোনের ছেলেমেয়েরা অনেকেই একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে এবং
ঈদের সময় গিয়ে তারা মিলিত হয়।
একে অন্যের সঙ্গে মোবাইল নম্বর বিনিময় করে। ফেসবুকে একে অন্যের বন্ধু হয়। এভাবেই উভয়ের মধ্যে নতুন যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
এমন ঘটনা এখন সব পরিবারের মধ্যেই আছে। এদিকে থেকে ঈদ সবার কাছে একটা মিলনের উৎসব।
এ ছাড়া ঈদ উৎসবের মধ্যে নানা পারিবারিক ও সামাজিক কাজও সম্পন্ন হয়। যেমন- আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি বা মনোমালিন্য অনেক সময় হয়ে যায়। ঈদ একটা সুযোগ করে দেয় এসব পারিবারিক দ্বন্দ্ব বা ঝামেলা নিরসনের। আবার জমিজমা সংক্রান্ত নানা সমস্যা বা পারিবারিক অন্যান্য সমস্যার বিষয়ে এ সময় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইদানীং বিয়ে, জন্মদিন, বিয়েবার্র্ষিকী, খতনা, আকিকা-এসব অনুষ্ঠান ঈদের সময় হয়ে থাকে।
কারণ বছরের এই একটি সময়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পরিবারের সদস্যরা বাড়িতে ফিরে আসেন।
এই ঈদে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে-
ঈদের আনন্দের ছড়িয়ে পড়ুক বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল গুলোতে।
এ আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক-সমাজের সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে।
বিশেষ প্রতিনিধি-দৈনিক সময়ের কণ্ঠ