দেশে দৃশ্যমান নয় সমবায় প্রতিষ্ঠান
- আপডেট টাইম : ০৪:২৪:৫৮ অপরাহ্ণ, রবিবার, ২৪ জানুয়ারি ২০২১
- / ২৮৯ ৫০০০.০ বার পাঠক
সময়ের কন্ঠ পএিকার রিপোর্ট।।
সম্প্রতি দ্বিতীয় দফায় সরকার করোনা পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এবার চমক হলো, প্রণোদনা ঋণ বিতরণে এনজিওদের যুক্ত করার সরকারী নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জানা গেছে, প্রণোদনা ঋণের তালিকায় দেশের কার্যকর ও ক্ষতিগ্রস্ত সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। প্রতিবছর জাতীয় সমবায় দিবস দেশজুড়ে বর্ণাঢ্যভাবে উদ্যাপন এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় সমবায় পুরস্কার প্রদান করা হয়। গত ক’বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ এবং সমবায়ীদের উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। তাই প্রণোদনা ঋণের তালিকায় ক্ষতিগ্রস্ত কার্যকর সমবায় প্রতিষ্ঠানকে বাতিল করা শুধু অযৌক্তিক নয়, এতে ক্ষুণ্ন হবে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের ভাবমূর্তি।
সমবায় প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও সদস্যদের বেশিরভাগের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। স্বাধীনতার পর এ শ্রেণীর লোকদের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এনজিওরা এগিয়ে আসে। প্রধানত সেবার নামে তাদের উত্থান ঘটলেও পরবর্তীতে তা আর বজায় থাকেনি। সে কথায় পরে আসছি। সমবায় প্রতিষ্ঠান প্রাক-ঐতিহাসিককাল থেকে সভ্যতার বিকাশে বিশ্বব্যাপী অনন্যসাধারণ ভূমিকা রাখে। দরিদ্রদের দারিদ্র্যের কবল থেকে বের করে আনতে সমবায় ব্যবস্থাপনা ক্ষুদ্র ঋণের আদি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে সমবায় কার্যক্রম চলছে এক শ’ বছরের অধিক সময় ধরে। সমবায় বিশ্বব্যাপী একটি স্বীকৃত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও কাঠামো। সমাজভিত্তিক নৈতিক মানদণ্ড বজায় রেখে সদস্যদের সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনাকে উৎসাহিত করা সমবায়ের কাজ। তাই সমবায় ব্যবস্থাপনাকে হীন দৃষ্টিতে দেখা অনুচিত।
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯০৪ সালে প্রথম সমবায় সমিতি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদের দেশে সমবায় আন্দোলনের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। যদিও ব্রিটিশ বেনিয়াদের এ ধারার পূর্বে ১৮৮৫ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ব বাংলার পাবনা ও সিরাজগঞ্জে এবং বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় খুলনার রাড়ুলীতে কৃষকদের দারিদ্র্যের কথা বিবেচনা করে সমবায় আন্দোলনের গোড়াপত্তন করেন।
পাকিস্তান আমলে ১৯৫৫ সালে ভিনদেশী খীস্টান ধর্মযাজক ফাদার চার্লস জে, ইয়াং আমাদের দেশের দরিদ্র খ্রীস্টদের ভাগ্য পরিবর্তনে সমবায়ভিত্তিক ক্রেডিট ইউনিয়নের সূচনা করেন। বর্তমানে দেশে ১ হাজার ৮৪টি ক্রেডিট ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের ৫৪টি জেলার ২৬২টি উপজেলায় এর সেবাকেন্দ্র কার্যকর আছে। এ আন্দোলনের সঙ্গে থেকে দেশের সব ধর্মের মানুষ সম্পৃক্ত হতে শুরু করে। দেশের ৬ লাখের অধিক মানুষ ক্রেডিট ইউনিয়নের সদস্য।
ড. আখতার হামিদ খান ৬০ দশকে কুমিল্লায় দরিদ্র কৃষকদের দুর্দশা দূর করতে দ্বি-স্তর বিশিষ্ট পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় সমিতি গঠন এবং পরিচালনার কাজ শুরু করেন। ড. খানের কুমিল্লার দারিদ্র্য বিমোচন পদ্ধতি পরবর্তীতে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফএও) বিশ্বের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মোচনের মডেল হিসেবে তুলে ধরে। স্বাধীনতা-উত্তর প্রণীত সংবিধানের ১৩ নং অনুচ্ছেদে সমবায়কে মালিকানার দ্বিতীয় খাত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গবাদিপশু পালনকারী কৃষকদের এবং দেশের মানুষের দুগ্ধজাত পণ্য সহজলভ্য করার জন্য মিল্ক ভিটা নামক প্রতিষ্ঠানের সূচনা করেন। ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন। দ্বিতীয় বিপ্লবের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমবায়কে অগ্রাধিকার দেয়া হয়।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীনতা অর্জনের প্রারম্ভ সময় দেশের ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতি, অবকাঠামো এবং দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীকে বাঁচিয়ে রাখতে বিদেশী দাতা সংস্থার সাহায্য-সহযোগিতা ও বুদ্ধি-পরামর্শ অপরিহার্য ছিল। তৎকালে আমাদের দেশে গণ্ডায় গণ্ডায় বেসরকারী সমাজসেবামূলক সাহায্য সংস্থা গড়ে ওঠে। এসব সংস্থা সরকারের পাশাপাশি বিদেশী দাতাদের অর্থানুকূল্য অর্জন করে প্রথম দিকে দেশের মানুষের কল্যাণের নামে কর্মসূচী বাস্তবায়ন শুরু করে। বেসরকারী সংস্থা এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দরিদ্রদের মধ্যে খাদ্য বিতরণসহ সমাজ উন্নয়নের নামে ইত্যাকার কাজ করতে থাকে। এনজিওরা সরকারী কাজের তদারকি, কোথাও কোথাও সরকারী কাজের পরিপূরক কর্মসূচী হাতে নেয়। একই সঙ্গে দেশের পরিবেশ, শৃঙ্খলা ও মানবাধিকার রক্ষায় সরকারের ভূমিকা পালনের বিষয়ে এনজিওরা প্রশ্ন তোলে। এসব বিষয়ে সভা-সেমিনারে আলাপ-আলোচনা, শোভাযাত্রা ইত্যাদি করে শত শত এনজিও বছরে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে তাদের কাজের যৌক্তিকতায় সরকারী কাজের ব্যর্থতার ডামাডোল বাজিয়ে চলতে থাকে।
এসবের মধ্য দিয়ে দেশের অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এনজিও সরকারের প্যারালাল প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭২ সাল থেকে ৯-১০ বছর এনজিওরা সমাজকল্যাণের ছদ্মাবরণে নানা কাজ করে। ’৮০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে এনজিওদের একটি বৃহৎ অংশ মাইক্রো ক্রেডিট নামক ক্ষুদ্র ঋণের কাজে হাত দেয়। সমাজকল্যাণ, জয়েন্ট স্টক ইত্যাকার প্রতিষ্ঠান থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে আর্থিক কাজ চালাতে থাকে। এনজিওরা সে সময় থেকে ২০০৬ সালে মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি আইন পাসের পূর্বক্ষণ পর্যন্ত জনগণের সঙ্গে বেআইনীভাবে ক্ষুদ্র ঋণের নামে আর্থিক ব্যবসা-বাণিজ্য করে আসছিল।
দেশে আইনসিদ্ধ আর্থিক কারবারি প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ ব্যাংক, নন-ফরমাল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান, বীমা এবং সমবায় অধিদফতর থেকে নিবন্ধিত সঞ্চয় ঋণদান সমিতি, ক্রেডিট কো-অপারেটিভ সোসাইটি এবং ক্রেডিট ইউনিয়নসমূহ।
জনগণের অংশগ্রহণমূলক সমবায় দফতরের নিবন্ধিত সমাজভিত্তিক তিন ক্যাটাগরির আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এছাড়া অন্যান্য প্রচলিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময় গড়ে উঠা ক্ষুদ্র ঋণ কারবারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনটাই সমবায় প্রতিষ্ঠানের মতো গণমানুষের অংশগ্রহণ ও মালিকানার স্বীকৃতি নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানের কাঠামো গড়ে তোলা এবং পরিচালনা করা হয় না। ব্যাংক, বীমা, নন-ফরমাল আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং এনজিও এসব প্রতিষ্ঠানে জনসাধারণ আর্থিকভাবে অংশগ্রহণ করে। তবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় মতামত প্রদানের ক্ষমতা হিসাবধারী মানুষ দেয়া হয় না।
দেশের অগ্রগতি ও দারিদ্র্য বিমোচনে সমবায় এবং এনজিও আলাদাভাবে কাজ করলেও এটা কোন বিপরীতধর্মী কাজ নয়। নীতিনির্ধারকরা এনজিও এবং সমবায়কে সমতালে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিলে, একে অন্যের সঙ্গে সহযোগিতা করলে জাতীয় উন্নয়ন টেকসই এবং ত্বরান্বিত হতে পারে। এক্ষেত্রে আইন-কানুনের আলোকে সরকার ও দাতাদের সমান্তরাল ভূমিকা আবশ্যক।
বাংলাদেশে সমবায় ব্যবস্থা পরিচালনার আইন-কাঠামোয় কোন সময়ই সুদূরপ্রসারী এবং উদার ব্যবসায়ী দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়নি। সমবায় আইনবিধি যখনই পরিবর্তন-পরিমার্জন করা হয়েছে তখনই দেখা গেছে সমবায় প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। প্রাথমিক একটি সমবায় সমিতির পুঁজি ২০-৫০ কোটি টাকা হতে পারে। কেন্দ্রীয় জাতীয় সমবায় সমিতির পুঁজি হাজার কোটি টাকা হতে পারে। বড় বড় সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান, পণ্য আমদানি-রফতানি করার বিষয়াবলী সমবায় সমিতি আইনে কোন ধারণা দেয়া হয়নি। বড় সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশের বিষয় সমবায় মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদফতর, নীতিনির্ধারকদের চিন্তায় আজও স্থান করে নিতে পারেনি। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘সমবায় সমিতিকে উৎপাদনমুখীকরণ, পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী সামাজিক অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন।’ সমবায় আন্দোলন বিষয়ে যারা ন্যূনতম খোঁজ-খবর রাখেন তারা সবাই জানেন দেশে বিদ্যমান সমবায় আইনবিধি কোনভাবেই সমবায়বান্ধব নয়, বরং অত্যধিক নিয়ন্ত্রণমূলক। ২০১৩ সালে সমবায় সমিতি আইন পরিবর্তনের কয়েকটি নিয়ন্ত্রণমূলক ধারা প্রবর্তনে সমবায় আন্দোলনের বিকাশ থমকে গেছে।
সমবায় প্রতিষ্ঠানের গৃহীত সমাজ উন্নয়ন ও ব্যবসায়ী প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ প্রাপ্তির সুযোগ নেই। অথচ এনজিওদের ঋণের অর্থলগ্নির জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে পল্লী কর্মীসহায়ক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মাত্র বাৎসরিক ৪% সুদে হাজার হাজার কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে। এনজিওদের বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ দিলে কেন কার্যকর সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভজনক প্রকল্পে ঋণ দেয়া হবে না? দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক উন্নয়নে এখনও দ্বিধা বিদ্যমান থাকলে সমবায় প্রতিষ্ঠান কিভাবে দেশে দৃশ্যমান থাকবে? কিভাবে জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রীর আশাবাদ বাস্তবায়ন হবে?
সরকারের কাছে আহ্বান, ব্যাংক সেবা থেকে বঞ্চিত সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শত শত বছর যাবত যে সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বের দেশে দেশে সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিক উন্নয়নে স্বাক্ষর রেখে আসছে এনজিওদের অগ্রাধিকার দিয়ে সেই সমবায় ব্যবস্থাপনাকে প্রশ্নবিদ্ধ না করার নীতি নেয়া হোক। বিশ্ব স্বীকৃত সমবায় ব্যবস্থাকে এনজিওদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সমতালে বিকাশে অধিক সুযোগ এবং আর্থিক সহায়ক কাঠামো গড়ে তুলে সমবায় আন্দোলনকে দেশে দৃশ্যমান করা হোক।