এক নির্বাচনে ‘টালমাটাল’ আ.লীগ-বিএনপির রাজনীতি
- আপডেট টাইম : ০৭:২৫:৪৯ অপরাহ্ণ, বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারি ২০২২
- / ১৯৭ ৫০০০.০ বার পাঠক
সময়ের কন্ঠ রিপোর্টে।।
পলিটিক্যাল হান্টিং গ্রাউন্ড অব বেঙ্গল’ খ্যাত প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি এখন টালমাটাল। এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচন যেন ‘তছনছ’ করে দিয়ে গেল নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতি।
সরকারি দল আওয়ামী লীগের একের পর সহযোগী সংগঠনের কমিটি বিলুপ্তির ঘোষণা আসছে আর জেলা ও মহানগর বিএনপির দুই শীর্ষ নেতাকে রীতিমতো বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় বিএনপি।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অভিযোগ, যাদের কমিটি বিলুপ্ত করা হচ্ছে বা আরও হতে যাচ্ছে তারা কেউই সদ্যসমাপ্ত নাসিক নির্বাচনে বিজয়ী মেয়র প্রার্থী আইভীর জন্য মাঠে নামেনি।
আর বিএনপির নীতি নির্ধারকরা মনে করছেন, এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আইভীর নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচন করাটা ছিল দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী। তবে এ বিলুপ্তি আর বহিষ্কারের ঘটনায় উভয় দলের একটি অংশ বেজায় খুশি হলেও মূলধারার বা রাজপথে থাকা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরীক্ষিত নেতাকর্মী সমর্থকদের মাঝে চলছে ক্ষোভের দাবানল।
এদিকে নগরবাসী মনে করছেন, শামীম ওসমানপন্থিদের কোণঠাসা করতেই সরকারি দল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা কমিটি বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে নতুন করে দল সাজাতে চাচ্ছেন। কিন্তু এতে করে আওয়ামী লীগ দুর্বল হবে নাকি শক্তিশালী হবে সেটি ভাববার বিষয়।
অপরদিকে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির রাজনীতিকে রীতিমতো ধরে রাখা অ্যাডভোকেট তৈমুর ও এটিএম কামালের মতো ২ ত্যাগী নেতাকে বহিষ্কার করে বিএনপি নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করেছে বলে মনে করেন নগরবাসী। তারা বলছেন, এমনিতেই বিএনপিতে নেতৃত্ব দেয়ার মতো সিনিয়র নেতার সংখ্যা কম। সেখানে এই ২ নেতা না থাকলে বিএনপির রাজনীতি আগামীতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সময়ই বলে দিবে।
জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার পর সেলিনা হায়াত আইভীর প্রচারণায় শামীম ওসমানপন্থিরা মাঠে নামবেন কিনা এ নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়। কারণ মেয়র থাকাকালীন সেলিনা হায়াত আইভীর সঙ্গে হকার ইস্যু নিয়ে সিটি করপোরেশনের দায়ের করা মামলার আসামি ছিলেন শামীম ওসমানপন্থি দলের প্রথমসারির নেতারা। ওই মামলায় আসামি খোদ শামীম ওসমান নিজেই।
এছাড়া মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহার বিরুদ্ধে আইভী নিজেই আইসিটি আইনে মামলা দায়ের করেছিলেন। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছিল শামীম ওসমানের প্রয়াত মা বাবা ও বড় ভাইয়ের কবরে শ্মশানের মাটি ফেলার ইস্যুটি।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতারা প্রচারণায় আসার পর মাঠে না থাকার অভিযোগ উঠে শামীম ওসমানপন্থি নেতাদের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার প্রার্থী হওয়ার পর শামীম ওসমানপন্থী বা শামীম ওসমানের প্রত্যক্ষভাবে আইভীর পক্ষে মাঠে নামাটা অপরিহার্য হয়ে উঠে নৌকার জয়ের ক্ষেত্রে।
যদিও শামীম ওসমানপন্থি হিসেবে পরিচিত মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবু হাসনাত শহীদ বাদল, মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাকিরুল আলম হেলাল, মহানগর যুবলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন সাজনু প্রথম থেকেই মাঠে ছিলেন নৌকার সমর্থনে। কিন্তু প্রয়োজন হয়ে উঠে খোদ শামীম ওসমানের। শুরু হয় চাপ প্রয়োগ।
গত ৮জানুয়ারি নৌকার প্রচারণামূলক সভা চলাকালেই বিলুপ্তির খবর আসে মহানগর ছাত্রলীগের কমিটির। ওই রাতেই মহানগর ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে পুলিশের অভিযানের নামে মারধর, চাপ প্রয়োগ শুরু হয়। এরই মধ্যে গত ৯ জানুয়ারি আইভীর দায়ের করা মামলা মাথায় নিয়েই মারা যান জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সেক্রেটারি মিজানুর রহমান সুজন। ফলে ক্ষোভ আর রক্তক্ষরণের মাত্রা বেড়ে যায় দ্বিগুণ।
এসব নিয়েই গত ১০ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে নিজের অবস্থান নৌকার পক্ষে জানান দেন শামীম ওসমান। কিন্তু থেমে থাকেনি কমিটি বিলুপ্তিকরণ। গত নির্বাচনের দিন ১৬ জানুয়ারি বিকালেই বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় জেলা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি। ১৮ জানুয়ারি বিলুপ্ত করা হয় মহানগর শ্রমিকলীগের কমিটি।
ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম গণমাধ্যমে বলেছেন, নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগও পুনর্গঠন করা হবে। আমরা এখানে নির্বাচনের কাজ করতে এসে অনেক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। এগুলো দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের আগামী সভায় উত্থাপন করা হবে।
তবে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, শামীম ওসমানের মতো দক্ষ ও কারিশম্যাটিক নেতা এখনো তৈরি হয়নি। নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কয়েক আইনজীবী নেতা বিএনপির সঙ্গে আঁতাত করে বিদ্রোহী প্যানেল দেয়ার পরেও পূর্ণ প্যানেলে জয়ী হয়েছে শুধুমাত্র শামীম ওসমানের কারণে।
শামীম ওসমান বা তার অনুসারীদের মাইনাস করলে আওয়ামী লীগই দুর্বল হবে। কারণ, গত এক যুগ ধরে শামীম ওসমান বিরোধী গ্রুপের সঙ্গে তথাকথিত সুশীল ও বামপন্থীরা ঘিরে থাকায় এমনিতেই কর্মীরা ক্ষুব্ধ। তার উপর এই অবস্থা চলতে থাকলে মাঠে ত্যাগী ও প্রকৃত কর্মী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পরলেও নব্য হাইব্রিডের অভাব হবে না।
অপরদিকে বহিষ্কারের খড়গ পরেছে ‘জাঁদরেল’ বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার ও এটিএম কামালের ওপর। সেই নাসিক নির্বাচনকে ইস্যু করেই এই ২ মাঠের পরীক্ষিত নেতাকে ১৮ জানুয়ারি স্থায়ী বহিষ্কার করেছে বিএনপি।
২০১১ সালেও শামীম ওসমানকে ঠেকাতে রীতিমতো কোরবানি দেওয়া হয়েছিল ওই সময়ের বিএনপিপ্রার্থী তৈমুরকেই। এবার হলেন স্থায়ী বহিষ্কার।
জানা গেছে, ইতোমধ্যেই জেলা বিএনপির আহবায়ক (ভারপ্রাপ্ত) করা হয়েছে রূপগঞ্জে তারাবো পৌর বিএনপির সভাপতি নাছির উদ্দিনকে; যার বিরুদ্ধে সরকারি দলের সঙ্গে আঁতাত করার অভিযোগ উঠেছিল বহু আগেই। এদিকে তৈমুর ও এটিএম কামালকে বহিষ্কারের পর বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।
তারা বলছেন, ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। জেলা ও মহানগর বিএনপির রাজনীতি ধরে রাখতে এই দুই নেতা অর্ধশত মামলা খেয়েছেন, এটিএম কামাল জেল খেটেছেন বহু মাস। নির্বাচনে তৈমুর আলম খন্দকার জয়ী হলে এই বিএনপি ডেকে নিয়ে তাকে ও কামালকে ফুল দিয়ে সম্মান করতো। অথচ এখন তাদের দল থেকে বের করে দেওয়া হলো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মহানগর বিএনপির কয়েকজন নেতা জানান, তৈমুরের নির্বাচনকে ঘিরে পুরো ২৭টি ওয়ার্ডে বিএনপির হামলা-মামলা খাওয়া কর্মীগুলো জেগে উঠেছিল। বিএনপি সাংগঠনিকভাবে শক্তির পরিচয়ও দিয়েছে। কিন্তু এই বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত আর কোনো কর্মীকে রাজপথে টেনেও নামানো যাবে না।
তবে এই বহিষ্কারে খুশি হয়েছেন গত নাসিক নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত ও সিদ্ধিরগঞ্জের সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিনপন্থিরা। কারণ এ নির্বাচনে তারা নেপথ্যে ও সরাসরি তৈমুরের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছিলেন।