বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষণে এমনটি বলেন সব দেশের সমান সম্মানের কথা
- আপডেট টাইম : ০৯:৫০:১৯ পূর্বাহ্ণ, সোমবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১
- / ৪৫১ ৫০০০.০ বার পাঠক
মোঃ শহিদুল ইসলাম( শহিদ )বিভাগীয় ব্যুরো প্রধান।।
১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষণটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক। সদস্যপদ লাভের আট দিনের মাথায় তিনি জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বলেন, বিশ্বের সব দেশের সম্মান ও মর্যাদা এক।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দেয়া তার ভাষণটি ছিল বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, স্বাধিকার আন্দোলনের প্রস্তুতি ও দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ। আর এর সাড়ে তিন বছর পর জাতিসংঘে দেয়া ভাষণটি ছিল সমগ্র বিশ্বের অধিকারবঞ্চিত নির্যাতিত নিষ্পেষিত মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বিশ্বশান্তি, ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার বলিষ্ঠ উচ্চারণ।
জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক, যিনি বাংলায় বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রথমেই অনুরোধ করা হয়েছিল, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করবেন।’ কিন্তু প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সুগভীর দরদ ও মমত্ববোধ থেকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই।’জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের আট দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু সাধু বাংলায় জাতিসংঘে দেয়া ভাষণের শুরুতেই বলেন, ‘মাননীয় সভাপতি, আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সাথে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগীদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।’
তিনি বলেন, ‘স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাহারা বিশ্বের সকল জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাঙ্ক্ষিত ছিলেন।
‘যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত রহিয়াছে, আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন। আমি জানি, শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়িয়া তুলিবার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের এই অঙ্গীকারের সহিত শহীদানের বিদেহী আত্মাও মিলিত হইবেন।’
বঙ্গবন্ধু জনগণের অধিকার কেড়ে নেয়ার ক্ষেত্রে দেশে দেশে সেনাবাহিনী ব্যবহারের তীব্র নিন্দা জানান এবং বাংলাদেশসহ চারটি দেশ আলজেরিয়া, গিনি বিসাউ এবং ভিয়েতনামের নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘এই দেশগুলো অপশক্তির বিরুদ্ধে বিরাট বিজয় অর্জন করিতে সক্ষম হইয়াছে।’
চূড়ান্ত বিজয়ের ইতিহাস জনগণের পক্ষেই থাকে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু ফিলিস্তিন, জাম্বিয়া, নামিবিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।এই ভাষণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে সাবেক সচিব ও অ্যাম্বাসেডর ওয়ালিউর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সে দিনের ওই ভাষণ কিন্তু স্বাভাবিক কোনো বিষয় ছিল না। সদস্যপদ পাওয়ার মাত্র আট দিনের মাথায় দেয়া বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ ছিল বিশ্ববাসীর জন্য এক বিশেষ বার্তা। বিশেষ করে যখন, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই তখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে গড়িমসি করছিল। প্রায় পুরো মুসলিম বিশ্ব, মধ্যপ্রাচ্য এবং চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ স্বীকৃতি না দিয়ে বিরোধিতা করছিল।
‘যে সময় বা প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ভাষণের মঞ্চে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন জাতিসংঘ ও তার পাঁচ মোড়ল (ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন স্থায়ী সদস্য) সম্পর্কে বিশ্ব সন্দিহান ছিল। কারণ তারা তখন বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণের খেলায় নেমেছিল। বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক এ ভাষণে বিশ্ববাসীকে নতুন করে উৎসাহিত করে তোলেন। কারণ তিনি সব দেশের সমান সম্মান ও মর্যাদার কথা বলেছিলেন।’
ওয়ালিউর রহমান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছিলেন, ছোট্ট একটা দরিদ্র ও জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ একটি ভূখণ্ড কেবল ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতাই অর্জন করেনি, নিজস্ব মাতৃভাষা ও কৃষ্টি, ঐতিহ্য, স্বতন্ত্র সংস্কৃতিও আছে তাদের। আছে নিজস্ব বৈশ্বিক ধারণা ও দর্শন।
‘বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের ভাষণে দরিদ্র, অবহেলিত ও শোষিতদের জন্য বার্তা পৌঁছে দেন: দেশকে ভালোবাসলে, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি মমত্ব থাকলে যে কোনো শক্তির বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়ানো যায়। পরাধীনতার শেঁকল ছিড়ে স্বাধীন হওয়া যায়।’
‘জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর সেই অভাবনীয় ভাষণ’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছেন বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের পলিটিক্যাল সেক্রেটারি ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সদস্য, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং ঘটনার সাক্ষী তোফায়েল আহমেদ।
তিনি লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলা বক্তৃতার ইংরেজি ভাষান্তর করার গুরুদায়িত্বটি অর্পিত হয়েছিল ফারুক চৌধুরীর ওপর। তিনি ছিলেন লন্ডনে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার। প্রথমে ফারুক ভাই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তখন পরিস্থিতি সহজ করতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “রিহার্সাল দাও। বক্তৃতা ভাষান্তরের সময় ভাববে, যেন তুমিই প্রধানমন্ত্রী। তবে পরে কিন্তু তা ভুলে যেও।”’