ঢাকা ০৮:০৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
সংবাদ শিরোনাম ::
গরু বহনকারী ভটভটির ধাক্কায় প্রাণ হারালো  দুই যুবক ইবিতে ভর্তি পরীক্ষার্থীদের জন্য থাকছে না কোন পরিবহন সেবা নবাবগঞ্জ প্রেসক্লাবের সকল সাংবাদিকের সঙ্গে ওসির সৌজন্য সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় পাকুন্দিয়া উপজেলায় ৪ মামলার পরোয়ানাভূক্ত পলাতক আসামী গ্রেফতার রাণীশংকৈলে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা কোনাবাড়ি পল্লী বিদ্যুৎ পাওয়ার সাবস্টেশনে আগুন তামাক হচ্ছে মাদকের মূল লক্ষ্য -ডাঃ মোঃ নজরুল ইসলাম কিরাটন ইউনিয়নের পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম আমাদের মাঝে আর নেই শিবগঞ্জে সানামসজিদ স্থলবন্দরে হিট স্ট্রোকে ট্রাফিক পরিদর্শকের মৃত্যু গাজীপুরবাসীর জন্য চরম “সৌভাগ্য’ বর্তমান ডিসি এডিসি রেভিনিউ চৌকস ও মেধাবী দুই কর্মকর্তার চিন্তা,চেতনায় কর্মে, সর্বোপরিভাবে সততাকে প্রাধাণ্য দিয়েই দায়িত্ব পালন করছেন

শ্রমিকদের বিক্ষোভ বাধা দেওয়ায়,পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি।।৪৯ জনের লাশ পুড়ে কয়লা

  • প্রাণ গেল ৫২ জনের, নিখোঁজ ৭০
  • ৪৯ জনের লাশ পুড়ে কয়লা
  • শ্রমিকদের বিক্ষোভ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ
  • সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি

আরিফুল ইসলাম রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ॥ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেড নামে একটি কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় আরও ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়াল ৫২ জনে। শুক্রবার বিকেল ৩ টার দিকে হাসেম ফুড কারখানাটির চতুর্থ তলা থেকে ৪৯ টি মরদেহ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৬ তলা ভবনটির চতুর্থ তলা পর্যন্ত আগুন নেভানো হয়েছে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার আগুন নির্বাপণের কাজ চলছে। আগুন নির্বাপণের পর মোট হতাহতের সংখ্যা বলা যাবে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৫২ জন নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেলেও এখনও ৭০ জনের বেশি নিখোঁজ রয়েছেন।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক অপারেশন অফিসার জিল্লুর রহমান সাংবাদিকদের লাশ উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ফায়ার সার্ভিসের সিভিল ডিভিশনের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্মণ ফায়ার জানিয়েছেন, উদ্ধার হওয়া ৪৯ জনের লাশ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তাদের চেনার কোনই উপায় নেই। স্বজনরা চাইলেও লাশ দেখে শনাক্ত করতে পারবেন না। ডিএনএ টেস্ট ছাড়া লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হবে না। এর আগে, গত বৃহস্পতিবার বিকেলে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় দুই নারী- স্বপ্না রানী ও মিনা আক্তার নিহত হন। পরে রাত ১১ টার দিকে মোরসালিন (২৮) নামে আরও এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছে।

ঘটনার পর থেকেই নিহতের স্বজনরা কারখানার চারপাশে ভিড় জমিয়েছে। স্বজনদের আহাজারিতে কারখানার আশপাশের পরিবেশ ভারি হয়ে গেছে। এদিকে আগুন নেভাতে দেরি হওয়ায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল ও ভাংচুর চালায়। এসময় পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া, পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। তারা হাসেম ফুডের আনসার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে আনসারদের মারধর করে অস্ত্রাগার থেকে তিনটি শটগান লুট করে নিয়ে যায় বলে জানান উপজেলা আনসারদের ইনচার্জ নাছিমা বেগম।

স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উপজেলার কর্ণগোপ এলাকার সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানায় প্রায় ৭ হাজার শ্রমিক, কর্মচারী কাজ করেন। ছয় তলা ভবনে থাকা কারখানাটির নিচ তলার একটি ফ্লোরে কার্টন এবং পলিথিন তৈরির কাজ চলে। সেখান থেকেই হঠাৎ করে আগুনের সূত্রপাত। এসময় আগুনের লেলিহান শিখা বাড়তে শুরু করে। এক পর্যায়ে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। কালো ধোঁয়ায় কারখানাটি অন্ধকার হয়ে যায়। এক পর্যায়ে শ্রমিকরা ছোটাছুটি করতে শুরু করেন। কেউ কেউ ভবনের ছাদে অবস্থান নেন। তবে চার তলায় থাকা প্রায় ৭০-৮০ শ্রমিক কাজ করেন। অগ্নিকান্ডের খবর পেয়ে চার তলার শ্রমিকরা ছোটাছুটি করতে থাকলে ওই তলার দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তারক্ষী কেচি গেটে তালা দিয়ে রাখেন। আগুন নিভে যাবে বলে তালা দিয়ে শ্রমিকদের ওই তলাতেই বসিয়ে রাখেন। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় অন্যান্য তলার শ্রমিকরা অনেকে বের হতে পারলেও চার তলার শ্রমিকরা বের হতে পারেননি। আগুনের খবর পেয়ে কেউ কেউ ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে শুরু করে। নিহতের কেউ কেউ মোবাইল ফোনে স্বজনদের সঙ্গে শেষ কথা বলেছেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে আগুন থেকে বাঁচতে রানী, মিনা আক্তার ও মোরসালিন হক ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে নিহত হন। এছাড়া এ ঘটনায় প্রায় অর্ধশতাধিক শ্রমিক আহত হন। এদের মধ্যে ১০ জনকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান, জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ, পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শাহ নূসরাত জাহান, সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতিকুল ইসলাম। এদিকে বেলা ১১ টা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভাতে ব্যর্থ হলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু করেন। এক পর্যায়ে রূপগঞ্জ থানা পুলিশ ও আঞ্চলিক পুলিশের সদস্যদের সঙ্গে শ্রমিকদের ধাওয়া, পাল্টাধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। তারা কারখানা ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে চলাচলরত গাড়িসহ মোট অর্ধশতাধিক গাড়ি, মোটরসাইকেল ভাংচুর করে। সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেডে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা হাসেম ফুডের আনসার ক্যাম্পে প্রবেশ করে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। এসময় শ্রমিকরা ক্যাম্পের অস্ত্র সংরক্ষণাগারের তালা ভেঙ্গে তিনটি শটগান লুট করে নেয়। শ্রমিকদের হামলায় কাউসার, বিশ্বজিত, ফারুক, মোশরাকুলসহ প্রায় ৫ আনসার সদস্য আহত হয়।

শ্রমিক ও নিহতের স্বজনরা অভিযোগ করে বলেন, হাসেম ফুড কারখানাটি অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চলত। কারখানাটিতে অগ্নি নির্বাপণের কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এছাড়া বেশিরভাগই শিশুশ্রমিক কাজ করত। এছাড়া কারখানাটি অতিরিক্ত খাদ্যপণ্যে অতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করত। এ কারণেই অতিরিক্ত কেমিক্যালের কারণে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের এত দেরি হয়। এছাড়া কারখানার ভবন থেকে বের হতে শ্রমিকদের জন্য কোন ইমারজেন্সি এক্সিটের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এছাড়া নিহত শ্রমিকদের বেশিরভাগই শিশু।

১২ বছর বয়সী শিশুশ্রমিক বিশাখা রানী ক্ষোভের সুরে বলেন, বাবা-মাসহ আমাদের ৫ বোনের সংসার। বেতন-ভাতা ও ওভারটাইম না পাওয়ায় আমরা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম। এ কারণে আমরা শ্রমিকরা বেতন-ভাতার দাবিতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করি। আর এ ক্ষোভেই কারখানার মালিকপক্ষ এই ভবনে আগুন লাগিয়ে আমার মা সপ্না রানীসহ অন্যান্য শ্রমিককে হত্যা করে। আমরা এ হত্যার বিচার চাই।

নিখোঁজ শ্রমিক তাছলিমা আক্তারের বাবা আক্তার হোসেন বলেন, মালিকপক্ষের দোষেই কারখানায় আগুন লাগে। এছাড়া মালিকপক্ষ শ্রমিকদের চার তলায় আটকে রেখে হত্যা করে। আমরা এ নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার চাই।

নিখোঁজ শ্রমিক ওমৃতা রানীর (১৭) বোন রোজিনা আক্তার জানান, তার বোন ওমৃতা আক্তার চার তলায় কাজ করছিল। ওমৃতা রানী বলছিল মালিকপক্ষ তাদের আটকে রেখে জোর করে ১২ ঘণ্টা ডিউটি করাতেন। ঘটনার দিনও তারা কেচিগেট তালা দিয়ে রাখায় চার তলার কোন শ্রমিক বের হতে পারেনি। হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানাটির যে ভবনটিতে আগুন লেগেছে সে ভবনটি বিল্ডিং কোড না মেনে করা হয়েছে। অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কারখানাটি পরিচালনা করায় এ অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত।

কারখানার অন্যান্য শ্রমিক আরও অভিযোগ করে বলেন, কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ঠিকমতো পরিশোধ করেন না। শ্রমিকরা বেতন চাইলে মালিকপক্ষ তাদের মারধরসহ চাকরিচ্যুত করার হুমকিধমকি প্রদান করেন। কারখানাটিতে দুটি গেট থাকলেও একটি গেট কারখানা কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে রাখে। কোন দুর্ঘটনা হলে শ্রমিকরা দ্রুতগতিতে বের হতে গেলেও শ্রমিকদের পদদলিত হওয়ার শঙ্কা থাকে।

৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি ॥ জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, এ অগ্নিকা-ের ঘটনায় জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ৭ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অগ্নিকান্ডে যারা নিহত হয়েছেন তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে লাশ দাফনের জন্য নগদ ২৫ হাজার টাকা ও আহতের পরিবারদের নগদ ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হবে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক অপারেশন অফিসার জিল্লুর রহমান বলেন, গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৫ টা থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা হাসেম ফুডে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করেন। চার তলা পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। এ পর্যন্ত ৪৯ টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। লাশগুলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। তবে পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার আগুন এখনও থেমে থেমে জ্বলছে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার আগুন পুরোপুরি নির্বাপণ করলে বোঝা যাবে হতাহতের সংখ্যা বাড়বে কিনা।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও হতাহতের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করে পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী (বীরপ্রতীক) বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে হতাহতের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া এ ঘটনার ব্যাপারে তদন্ত কমিটির ওপর ছেড়ে দেয়া হলো। কারখানার অব্যবস্থাপনার কারণে যদি এ ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে সে ব্যাপারেও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

২৫ নারী শ্রমিকের প্রাণ বাঁচালেন তাজুল ॥ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড এ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের সময় ওই ভবনের ষষ্ঠ তলায় থাকা ২৫-৩০ শ্রমিককে দড়ি দিয়ে ছাদ থেকে নিচে নামিয়ে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন তাজুল ইসলাম। যে ২৫-৩০ শ্রমিককে তিনি নামিয়েছেন, তাদের কেউ আহত হননি। তার কল্যাণে বেঁচে গেছে ঐ শ্রমিকরা। নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে শ্রমিকদের উদ্ধার করতে গিয়ে শ্রমিকদের ছাদ থেকে নামাতে গিয়ে তাজুল ইসলাম নিজেই আহত হন। তাজুল ইসলাম ওই ভবনের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (ডিপ্লোমা) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

তিনি জানান, বিকেল ৫টার দিকে তিনি ওই ভবনের ৫তলায় ইলেকট্রিক্যাল কাজ করছিলেন। হঠাৎ করে গ্যাসের গন্ধ পেয়ে শ্রমিকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে চারদিকে ছুটতে থাকেন। এ সময় আগুন লাগার খবরে ষষ্ঠ তলার শ্রমিকরা আতঙ্কিত হয়ে ভবনের ছাদে চলে যায়। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন উপরে দড়ি পাঠালে তাজুল ইসলাম একাই ২৫-৩০ নারী শ্রমিককে নিচে নামিয়ে আনেন।

তাজুল ইসলাম বলেন, আমি নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই কাজটি করেছি। আমি নিজেই এখন একটু অসুস্থ। তাই আর আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারছি না।

ডিজিটাল যুগে আগুন নিয়ন্ত্রণে বিলম্ব কেন ॥ ডিজিটাল এই যুগে ফায়ার সার্ভিস একদিনও কেন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি এ প্রশ্ন এখন অনেকের। এদিকে ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারায় শ্রমিক এবং স্থানীয় এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ওপর চড়াও হয়েছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক বন্ধ করে গাড়ি ভাংচুর করেছে শ্রমিকরা।

এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ভিপি সোহেল বলেন- এই আধুনিক যুগে ফায়ার সার্ভিস নিয়মমাফিক কাজ করলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে এত সময় লাগার কথা নয়। অগ্নিদগ্ধদের উদ্ধারে আসা স্থানীয় একটি হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার সুমন মিয়া বলেন আগুন নেভানোর কাজে আরও ফায়ার সার্ভিসের লোক প্রয়োজন ছিল। তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে পেরে উঠছিল না বলেও সুমন জানান।

এ বিষয়ে ডেমরা ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মোঃ ওসমান গনি বলেন, ডেমরা ফায়ার সার্ভিস অগ্নিকান্ডের শুরু থেকেই নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সঙ্গে আরও ১৭ টি ইউনিট কাজ করছে পর্যায়ক্রমে। কিন্তু কারখানার ৬ তলা এ ভবনটিতে কেমিক্যাল জাতীয় কিছু থাকায় পরিস্থিতি একটু জটিল মনে হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের সকল দল নিরলসভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণ ও নির্বাপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান। এ ব্যাপারে প্রেসক্লাবের উপদেষ্টা সিনিয়র সাংবাদিক আলম হোসেন বলেন- অগ্নিকান্ডের শুরুতে ক্রেনযুক্ত আরও আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলে আগুন সহসাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতো। আগুন নিয়ন্ত্রণে বিলম্ব হওয়ার বিষয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

খাদ্যে কেমিক্যাল ব্যবহারের অভিযোগ ॥ বিপুল পরিমাণ কেমিক্যালের কারণে বৃহস্পতিবার বিকেল ৫ টায় লাগা আগুন শুক্রবার এই সংবাদ লেখা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায়ও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। প্রতিষ্ঠানটি তাদের তৈরি খাবারে কেমিক্যাল ব্যবহার করত বলেও অভিযোগ করেছেন অনেকে। দাহ্য এই কেমিক্যালের কারণেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম বলেন- শুনেছি প্রতিষ্ঠানটিতে শ্রমিকদের নিরাপত্তার ত্রুটি ছিল। ফ্লোরে ফ্লোরে বিপুল পরিমাণ কেমিক্যালসহ দাহ্যপদার্থ রাখার বিষয়টিতে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এসব দাহ্য পদার্থের কারণেই জানমালের এত ক্ষতি হয়েছে। তিনি তাঁদের সংগঠনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য আদালতে লড়বেন বলেও জানান। প্রতিষ্ঠানটিতে সুগন্ধি কেমিক্যাল, ভেজাল তৈল এবং ঘি ব্যবহারেরও অভিযোগ করেছেন অনেকে।

প্রতিষ্ঠানটি ছিল শিশুশ্রমিকে ঠাসা ॥ সজীব গ্রুপের মানবখাদ্য তৈরির প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে শিশুশ্রমের অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি ফ্লোরেই শিশুশ্রমিকে ঠাসা ছিল। এ ব্যাপারে উপজেলার বরপা এলাকায় বসবাসকারী শ্রমি টুলু মিয়া (১৪) জানান কারখানাটিতে তার মতো অনেকেই কাজ করত। কম বেতন হওয়ায় কারখানা মালিকের শিশুশ্রমিকদের প্রতি আগ্রহ ছিল। এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ নুসরাত জাহান বলেন, অগ্নিকান্ডের পর শিশুশ্রমিকের কথা শুনেছি। এমনটি হলে এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

দায় নেবেন না সেজান জুস চেয়ারম্যান ॥ সেজান জুস প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবুল হাসেম এ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় কোন দায় নেবেন না বলে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে আবুল হাসেম সাংবাদিকদের বলেন, এটা নিতান্তই একটি দুর্ঘটনা। তিনি আরও বলেন, এখানে একই সারিতে ছয়টি ভবনে ছয়টি ফ্যাক্টরি আছে। যে ভবনে আগুন লেগেছে, সেখানে পাঁচ/ছয় শ’ শ্রমিক কাজ করত। জীবনে বড় ভুল করেছি ইন্ডাস্ট্রি করে। ইন্ডাস্ট্রি করলে শ্রমিক থাকবে। শ্রমিক থাকলে কাজ হবে। কাজ হলে আগুন লাগতেই পারে। এর দায় কি আমার? আমি তো আর গিয়ে আগুন লাগাই নাই। এই দায় আমার না। সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে বলছেন, কোন শ্রমিক সিগারেট খেয়ে ফেলে দিয়েছে। সেখান থেকে আগুন লাগতে পারে। যেহেতু নিচের তলায় কার্টন রাখা ছিল এবং বিভিন্ন ধরনের দাহ্য পদার্থ ছিল, তাই হয়ত আগুনের এই ভয়াবহতা। আবুল হাসেম ঘটনাস্থলে কেন যাননি এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমার লোকজন সেখানে রয়েছে। যারা মারা গেছেন, তারা তো আমারই ছেলেমেয়ে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।

আরো খবর.......

জনপ্রিয় সংবাদ

গরু বহনকারী ভটভটির ধাক্কায় প্রাণ হারালো  দুই যুবক

শ্রমিকদের বিক্ষোভ বাধা দেওয়ায়,পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি।।৪৯ জনের লাশ পুড়ে কয়লা

আপডেট টাইম : ০৫:৩৪:৫৩ অপরাহ্ণ, শুক্রবার, ৯ জুলাই ২০২১
  • প্রাণ গেল ৫২ জনের, নিখোঁজ ৭০
  • ৪৯ জনের লাশ পুড়ে কয়লা
  • শ্রমিকদের বিক্ষোভ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ
  • সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি

আরিফুল ইসলাম রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ॥ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেড নামে একটি কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় আরও ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়াল ৫২ জনে। শুক্রবার বিকেল ৩ টার দিকে হাসেম ফুড কারখানাটির চতুর্থ তলা থেকে ৪৯ টি মরদেহ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৬ তলা ভবনটির চতুর্থ তলা পর্যন্ত আগুন নেভানো হয়েছে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার আগুন নির্বাপণের কাজ চলছে। আগুন নির্বাপণের পর মোট হতাহতের সংখ্যা বলা যাবে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৫২ জন নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেলেও এখনও ৭০ জনের বেশি নিখোঁজ রয়েছেন।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক অপারেশন অফিসার জিল্লুর রহমান সাংবাদিকদের লাশ উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ফায়ার সার্ভিসের সিভিল ডিভিশনের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্মণ ফায়ার জানিয়েছেন, উদ্ধার হওয়া ৪৯ জনের লাশ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তাদের চেনার কোনই উপায় নেই। স্বজনরা চাইলেও লাশ দেখে শনাক্ত করতে পারবেন না। ডিএনএ টেস্ট ছাড়া লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হবে না। এর আগে, গত বৃহস্পতিবার বিকেলে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় দুই নারী- স্বপ্না রানী ও মিনা আক্তার নিহত হন। পরে রাত ১১ টার দিকে মোরসালিন (২৮) নামে আরও এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছে।

ঘটনার পর থেকেই নিহতের স্বজনরা কারখানার চারপাশে ভিড় জমিয়েছে। স্বজনদের আহাজারিতে কারখানার আশপাশের পরিবেশ ভারি হয়ে গেছে। এদিকে আগুন নেভাতে দেরি হওয়ায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল ও ভাংচুর চালায়। এসময় পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া, পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। তারা হাসেম ফুডের আনসার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে আনসারদের মারধর করে অস্ত্রাগার থেকে তিনটি শটগান লুট করে নিয়ে যায় বলে জানান উপজেলা আনসারদের ইনচার্জ নাছিমা বেগম।

স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উপজেলার কর্ণগোপ এলাকার সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানায় প্রায় ৭ হাজার শ্রমিক, কর্মচারী কাজ করেন। ছয় তলা ভবনে থাকা কারখানাটির নিচ তলার একটি ফ্লোরে কার্টন এবং পলিথিন তৈরির কাজ চলে। সেখান থেকেই হঠাৎ করে আগুনের সূত্রপাত। এসময় আগুনের লেলিহান শিখা বাড়তে শুরু করে। এক পর্যায়ে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। কালো ধোঁয়ায় কারখানাটি অন্ধকার হয়ে যায়। এক পর্যায়ে শ্রমিকরা ছোটাছুটি করতে শুরু করেন। কেউ কেউ ভবনের ছাদে অবস্থান নেন। তবে চার তলায় থাকা প্রায় ৭০-৮০ শ্রমিক কাজ করেন। অগ্নিকান্ডের খবর পেয়ে চার তলার শ্রমিকরা ছোটাছুটি করতে থাকলে ওই তলার দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তারক্ষী কেচি গেটে তালা দিয়ে রাখেন। আগুন নিভে যাবে বলে তালা দিয়ে শ্রমিকদের ওই তলাতেই বসিয়ে রাখেন। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় অন্যান্য তলার শ্রমিকরা অনেকে বের হতে পারলেও চার তলার শ্রমিকরা বের হতে পারেননি। আগুনের খবর পেয়ে কেউ কেউ ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে শুরু করে। নিহতের কেউ কেউ মোবাইল ফোনে স্বজনদের সঙ্গে শেষ কথা বলেছেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে আগুন থেকে বাঁচতে রানী, মিনা আক্তার ও মোরসালিন হক ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে নিহত হন। এছাড়া এ ঘটনায় প্রায় অর্ধশতাধিক শ্রমিক আহত হন। এদের মধ্যে ১০ জনকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান, জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ, পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শাহ নূসরাত জাহান, সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতিকুল ইসলাম। এদিকে বেলা ১১ টা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভাতে ব্যর্থ হলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু করেন। এক পর্যায়ে রূপগঞ্জ থানা পুলিশ ও আঞ্চলিক পুলিশের সদস্যদের সঙ্গে শ্রমিকদের ধাওয়া, পাল্টাধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। তারা কারখানা ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে চলাচলরত গাড়িসহ মোট অর্ধশতাধিক গাড়ি, মোটরসাইকেল ভাংচুর করে। সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেডে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা হাসেম ফুডের আনসার ক্যাম্পে প্রবেশ করে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। এসময় শ্রমিকরা ক্যাম্পের অস্ত্র সংরক্ষণাগারের তালা ভেঙ্গে তিনটি শটগান লুট করে নেয়। শ্রমিকদের হামলায় কাউসার, বিশ্বজিত, ফারুক, মোশরাকুলসহ প্রায় ৫ আনসার সদস্য আহত হয়।

শ্রমিক ও নিহতের স্বজনরা অভিযোগ করে বলেন, হাসেম ফুড কারখানাটি অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চলত। কারখানাটিতে অগ্নি নির্বাপণের কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এছাড়া বেশিরভাগই শিশুশ্রমিক কাজ করত। এছাড়া কারখানাটি অতিরিক্ত খাদ্যপণ্যে অতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করত। এ কারণেই অতিরিক্ত কেমিক্যালের কারণে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের এত দেরি হয়। এছাড়া কারখানার ভবন থেকে বের হতে শ্রমিকদের জন্য কোন ইমারজেন্সি এক্সিটের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এছাড়া নিহত শ্রমিকদের বেশিরভাগই শিশু।

১২ বছর বয়সী শিশুশ্রমিক বিশাখা রানী ক্ষোভের সুরে বলেন, বাবা-মাসহ আমাদের ৫ বোনের সংসার। বেতন-ভাতা ও ওভারটাইম না পাওয়ায় আমরা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম। এ কারণে আমরা শ্রমিকরা বেতন-ভাতার দাবিতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করি। আর এ ক্ষোভেই কারখানার মালিকপক্ষ এই ভবনে আগুন লাগিয়ে আমার মা সপ্না রানীসহ অন্যান্য শ্রমিককে হত্যা করে। আমরা এ হত্যার বিচার চাই।

নিখোঁজ শ্রমিক তাছলিমা আক্তারের বাবা আক্তার হোসেন বলেন, মালিকপক্ষের দোষেই কারখানায় আগুন লাগে। এছাড়া মালিকপক্ষ শ্রমিকদের চার তলায় আটকে রেখে হত্যা করে। আমরা এ নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার চাই।

নিখোঁজ শ্রমিক ওমৃতা রানীর (১৭) বোন রোজিনা আক্তার জানান, তার বোন ওমৃতা আক্তার চার তলায় কাজ করছিল। ওমৃতা রানী বলছিল মালিকপক্ষ তাদের আটকে রেখে জোর করে ১২ ঘণ্টা ডিউটি করাতেন। ঘটনার দিনও তারা কেচিগেট তালা দিয়ে রাখায় চার তলার কোন শ্রমিক বের হতে পারেনি। হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানাটির যে ভবনটিতে আগুন লেগেছে সে ভবনটি বিল্ডিং কোড না মেনে করা হয়েছে। অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কারখানাটি পরিচালনা করায় এ অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত।

কারখানার অন্যান্য শ্রমিক আরও অভিযোগ করে বলেন, কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ঠিকমতো পরিশোধ করেন না। শ্রমিকরা বেতন চাইলে মালিকপক্ষ তাদের মারধরসহ চাকরিচ্যুত করার হুমকিধমকি প্রদান করেন। কারখানাটিতে দুটি গেট থাকলেও একটি গেট কারখানা কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে রাখে। কোন দুর্ঘটনা হলে শ্রমিকরা দ্রুতগতিতে বের হতে গেলেও শ্রমিকদের পদদলিত হওয়ার শঙ্কা থাকে।

৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি ॥ জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, এ অগ্নিকা-ের ঘটনায় জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ৭ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অগ্নিকান্ডে যারা নিহত হয়েছেন তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে লাশ দাফনের জন্য নগদ ২৫ হাজার টাকা ও আহতের পরিবারদের নগদ ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হবে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক অপারেশন অফিসার জিল্লুর রহমান বলেন, গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৫ টা থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা হাসেম ফুডে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করেন। চার তলা পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। এ পর্যন্ত ৪৯ টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। লাশগুলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। তবে পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার আগুন এখনও থেমে থেমে জ্বলছে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার আগুন পুরোপুরি নির্বাপণ করলে বোঝা যাবে হতাহতের সংখ্যা বাড়বে কিনা।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও হতাহতের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করে পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী (বীরপ্রতীক) বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে হতাহতের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া এ ঘটনার ব্যাপারে তদন্ত কমিটির ওপর ছেড়ে দেয়া হলো। কারখানার অব্যবস্থাপনার কারণে যদি এ ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে সে ব্যাপারেও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

২৫ নারী শ্রমিকের প্রাণ বাঁচালেন তাজুল ॥ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড এ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের সময় ওই ভবনের ষষ্ঠ তলায় থাকা ২৫-৩০ শ্রমিককে দড়ি দিয়ে ছাদ থেকে নিচে নামিয়ে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন তাজুল ইসলাম। যে ২৫-৩০ শ্রমিককে তিনি নামিয়েছেন, তাদের কেউ আহত হননি। তার কল্যাণে বেঁচে গেছে ঐ শ্রমিকরা। নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে শ্রমিকদের উদ্ধার করতে গিয়ে শ্রমিকদের ছাদ থেকে নামাতে গিয়ে তাজুল ইসলাম নিজেই আহত হন। তাজুল ইসলাম ওই ভবনের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (ডিপ্লোমা) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

তিনি জানান, বিকেল ৫টার দিকে তিনি ওই ভবনের ৫তলায় ইলেকট্রিক্যাল কাজ করছিলেন। হঠাৎ করে গ্যাসের গন্ধ পেয়ে শ্রমিকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে চারদিকে ছুটতে থাকেন। এ সময় আগুন লাগার খবরে ষষ্ঠ তলার শ্রমিকরা আতঙ্কিত হয়ে ভবনের ছাদে চলে যায়। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন উপরে দড়ি পাঠালে তাজুল ইসলাম একাই ২৫-৩০ নারী শ্রমিককে নিচে নামিয়ে আনেন।

তাজুল ইসলাম বলেন, আমি নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই কাজটি করেছি। আমি নিজেই এখন একটু অসুস্থ। তাই আর আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারছি না।

ডিজিটাল যুগে আগুন নিয়ন্ত্রণে বিলম্ব কেন ॥ ডিজিটাল এই যুগে ফায়ার সার্ভিস একদিনও কেন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি এ প্রশ্ন এখন অনেকের। এদিকে ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারায় শ্রমিক এবং স্থানীয় এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ওপর চড়াও হয়েছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক বন্ধ করে গাড়ি ভাংচুর করেছে শ্রমিকরা।

এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ভিপি সোহেল বলেন- এই আধুনিক যুগে ফায়ার সার্ভিস নিয়মমাফিক কাজ করলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে এত সময় লাগার কথা নয়। অগ্নিদগ্ধদের উদ্ধারে আসা স্থানীয় একটি হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার সুমন মিয়া বলেন আগুন নেভানোর কাজে আরও ফায়ার সার্ভিসের লোক প্রয়োজন ছিল। তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে পেরে উঠছিল না বলেও সুমন জানান।

এ বিষয়ে ডেমরা ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মোঃ ওসমান গনি বলেন, ডেমরা ফায়ার সার্ভিস অগ্নিকান্ডের শুরু থেকেই নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সঙ্গে আরও ১৭ টি ইউনিট কাজ করছে পর্যায়ক্রমে। কিন্তু কারখানার ৬ তলা এ ভবনটিতে কেমিক্যাল জাতীয় কিছু থাকায় পরিস্থিতি একটু জটিল মনে হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের সকল দল নিরলসভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণ ও নির্বাপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান। এ ব্যাপারে প্রেসক্লাবের উপদেষ্টা সিনিয়র সাংবাদিক আলম হোসেন বলেন- অগ্নিকান্ডের শুরুতে ক্রেনযুক্ত আরও আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলে আগুন সহসাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতো। আগুন নিয়ন্ত্রণে বিলম্ব হওয়ার বিষয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

খাদ্যে কেমিক্যাল ব্যবহারের অভিযোগ ॥ বিপুল পরিমাণ কেমিক্যালের কারণে বৃহস্পতিবার বিকেল ৫ টায় লাগা আগুন শুক্রবার এই সংবাদ লেখা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায়ও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। প্রতিষ্ঠানটি তাদের তৈরি খাবারে কেমিক্যাল ব্যবহার করত বলেও অভিযোগ করেছেন অনেকে। দাহ্য এই কেমিক্যালের কারণেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম বলেন- শুনেছি প্রতিষ্ঠানটিতে শ্রমিকদের নিরাপত্তার ত্রুটি ছিল। ফ্লোরে ফ্লোরে বিপুল পরিমাণ কেমিক্যালসহ দাহ্যপদার্থ রাখার বিষয়টিতে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এসব দাহ্য পদার্থের কারণেই জানমালের এত ক্ষতি হয়েছে। তিনি তাঁদের সংগঠনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য আদালতে লড়বেন বলেও জানান। প্রতিষ্ঠানটিতে সুগন্ধি কেমিক্যাল, ভেজাল তৈল এবং ঘি ব্যবহারেরও অভিযোগ করেছেন অনেকে।

প্রতিষ্ঠানটি ছিল শিশুশ্রমিকে ঠাসা ॥ সজীব গ্রুপের মানবখাদ্য তৈরির প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে শিশুশ্রমের অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি ফ্লোরেই শিশুশ্রমিকে ঠাসা ছিল। এ ব্যাপারে উপজেলার বরপা এলাকায় বসবাসকারী শ্রমি টুলু মিয়া (১৪) জানান কারখানাটিতে তার মতো অনেকেই কাজ করত। কম বেতন হওয়ায় কারখানা মালিকের শিশুশ্রমিকদের প্রতি আগ্রহ ছিল। এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ নুসরাত জাহান বলেন, অগ্নিকান্ডের পর শিশুশ্রমিকের কথা শুনেছি। এমনটি হলে এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

দায় নেবেন না সেজান জুস চেয়ারম্যান ॥ সেজান জুস প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবুল হাসেম এ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় কোন দায় নেবেন না বলে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে আবুল হাসেম সাংবাদিকদের বলেন, এটা নিতান্তই একটি দুর্ঘটনা। তিনি আরও বলেন, এখানে একই সারিতে ছয়টি ভবনে ছয়টি ফ্যাক্টরি আছে। যে ভবনে আগুন লেগেছে, সেখানে পাঁচ/ছয় শ’ শ্রমিক কাজ করত। জীবনে বড় ভুল করেছি ইন্ডাস্ট্রি করে। ইন্ডাস্ট্রি করলে শ্রমিক থাকবে। শ্রমিক থাকলে কাজ হবে। কাজ হলে আগুন লাগতেই পারে। এর দায় কি আমার? আমি তো আর গিয়ে আগুন লাগাই নাই। এই দায় আমার না। সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে বলছেন, কোন শ্রমিক সিগারেট খেয়ে ফেলে দিয়েছে। সেখান থেকে আগুন লাগতে পারে। যেহেতু নিচের তলায় কার্টন রাখা ছিল এবং বিভিন্ন ধরনের দাহ্য পদার্থ ছিল, তাই হয়ত আগুনের এই ভয়াবহতা। আবুল হাসেম ঘটনাস্থলে কেন যাননি এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমার লোকজন সেখানে রয়েছে। যারা মারা গেছেন, তারা তো আমারই ছেলেমেয়ে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।