ওমর ফারুক : বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা তার ঐতিহ্যবাহী যাত্রার ৭৫ বছর পূর্তি উদ্যাপন করেছে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে। ১৯৫০ সালের ১ ডিসেম্বর ‘চালনা পোর্ট’ নামে যাত্রা শুরু করা এ বন্দর পরবর্তীতে ‘মোংলা পোর্ট অথরিটি’ হিসেবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাণিজ্য ও অর্থনীতির অন্যতম প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
রাত ১২টা ১ মিনিটে বন্দরে অবস্থানরত সব দেশি–বিদেশি জাহাজে এক মিনিট ধরে বিরতিহীন হুইসেল বাজানোর মধ্য দিয়ে প্লাটিনাম জয়ন্তীর সূচনা হয়। ভোরে বন্দর সদর দপ্তর থেকে জেটি ফটক পর্যন্ত বিশাল র্যালি বের করা হয়। বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল শাহীন রহমান বেলুন ও কবুতর উড়িয়ে অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
পরে জেটি এলাকায় অনুষ্ঠিত মূল অনুষ্ঠানে বন্দরের বিভিন্ন সদস্য, পরিচালক, হারবার মাস্টার, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের আইন উপদেষ্টা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম ও বাংলাদেশ সরকারের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মাদ মনিরুজ্জামান, বিভাগীয় প্রধানসহ কর্মকর্তা–কর্মচারী, বন্দর ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধি এবং অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২১ জন কর্মকর্তা–কর্মচারীকে সম্মাননা দেওয়া হয়। পাশাপাশি বন্দর ব্যবহারকারী ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিশেষ স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। গত এক বছরে অবসরোত্তীর্ণ (পি.আর.এল) হওয়া ৫৬ জন কর্মকর্তা–কর্মচারীকে দেওয়া হয় বিদায় সংবর্ধনা।
অর্থবছর ২০২৪–২৫-এ বন্দর কার্গো, কন্টেইনার ও রাজস্ব আয়—তিন ক্ষেত্রেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। নির্ধারিত ৮৮.৮ লাখ মেট্রিক টন কার্গো লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে হ্যান্ডলিং হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ১২ হাজার মেট্রিক টন—অতিরিক্ত ১৭.২৫ শতাংশ। কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের লক্ষ্যমাত্রা ২০ হাজার টিইইউজের বিপরীতে হয়েছে ২১,৪৫৬ টিইইউজ। রাজস্ব আয়ে ৩৩৩.৮৭ কোটি টাকার বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ৩৪৩.৩০ কোটি টাকা। নীট মুনাফায়ও বিশাল সাফল্য এসেছে—২০.৪৬ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জন ৬২.১০ কোটি টাকা, যা ২০৩ শতাংশেরও বেশি।
বন্দরের আধুনিকায়ন, নতুন যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও নিয়মিত ড্রেজিংয়ের ফলে হ্যান্ডলিং সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বর্তমানে একই সাথে পাঁচটি জেটিতে জাহাজ হ্যান্ডলিং এবং প্রতি ঘন্টায় ২৪টিরও বেশি কন্টেইনার লোড–আনলোড সম্ভব হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের মাত্র পাঁচ মাসেই এসেছে ৩৫৬টি জাহাজ, হ্যান্ডলিং হয়েছে ১৩,৮৫৪ টিইইউজ কন্টেইনার।
মোংলা বন্দরের উন্নয়নে একাধিক প্রকল্প চলমান রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
* পশুর চ্যানেলে ইনার বার ড্রেজিং
• আধুনিক সহায়ক জলযান সংগ্রহ
• ২টি অসম্পূর্ণ জেটি নির্মাণ (পিপিপি)
• আপগ্রেডেশন অব মোংলা পোর্ট প্রকল্প
• বন্দর সুবিধাদির সম্প্রসারণ ও কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বাড়ানোর প্রকল্প এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বার্ষিক কার্গো হ্যান্ডলিং ক্ষমতা বাড়বে প্রায় দ্বিগুণ, কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা পৌঁছাবে ৪ লক্ষ টিইউজে। একই সঙ্গে শিপিং এজেন্ট, সিএন্ডএফ, স্টিভেডরিং এবং শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বন্দরে স্থাপিত Port Reception Facility (PRF) উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে—যা তেল দূষণ নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য সক্ষমতা যোগ করবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র মোংলা বন্দর ইতোমধ্যে খাদ্যশস্য, তেল, সার, কয়লা, গাড়ি, যন্ত্রপাতি, গ্যাসসহ বিভিন্ন আমদানি ও পাট, হিমায়িত মাছ, কাঁকড়া, টাইলস, ক্লে, রেশমী কাপড়সহ নানা পণ্য রপ্তানিতে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। ভূমি, নৌ ও রেলপথে দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাও এ বন্দরের মাধ্যমে আরও গতিশীল হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশের ট্রানজিট সুবিধাও ভবিষ্যতে বন্দরকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আরও শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাবে। নিরাপদ, আধুনিক ও বিশ্বমানের বন্দর গড়ে তোলার ভিশন সামনে রেখে মোংলা বন্দর তার ৭৫ বছরের যাত্রা অতীত সাফল্যের ভিত্তিতে আরও এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে প্লাটিনাম জয়ন্তী উদ্যাপন করেছে।
প্রিন্ট
নিজস্ব সংবাদ : 




















