মাসের পর মাস সংলাপের মধ্য দিয়ে মূষিক প্রসব করেছে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’। মূলতঃ ‘ঐকমত্য’র নামে সৃষ্টি করা হয়েছে আরো বেশি অনৈক্য। ফ্যাসিজমবিরোধী আন্দোলন, বিশেষতঃ চব্বিশের ৫ আগস্ট সকল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে অভূত ঐকমত্য দেখা গিয়েছিলো- তার ছিটে-ফোঁটাও এখন নেই। জাতীয় আকাক্সক্ষার বিপক্ষে গিয়ে জামায়াত এখন আঙ্গুল বাঁকা করার হুমকি দিচ্ছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবর্তে চাইছে ‘গণভোট’। বলা হচ্ছে এটি নাকি ‘জাতীয় জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া। কিন্তু জামায়াতের একের পর এক দাবির মিছিল দেখে ‘অন্য কিছু’র আশঙ্কা করছে মানুষ। এটিকে জাতীয় নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে তোলার আওয়ামী এবং ভারতীয় আকাক্সক্ষার ‘রোডম্যাপ’ মনে করছেন তারা। ঐকমত্য কমিশন ঐক্যের পরিবর্তে উপহার দিয়েছে চরম অনৈক্য। সংলাপের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এখন ঐকমত্য পৌঁছানের জন্য বল ঠেলে দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক দলের কোর্টে। গত ৩ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের ‘জরুরি সভা’য় সরকারের পক্ষ থেকে পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছে যে, ‘জাতীয় জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলো এক সপ্তাহের মধ্যে মতৈক্যে পৌঁছাতে না পারলে সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে।
সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো গত ১৫ বছর একসঙ্গে আন্দোলন করেছে। আমরা তাদের কিছুটা সময় দিতে চাই। তারা নিজেরা আলোচনা করে এসব বিষয়ে একমত হতে পারে কি না সেটা দেখি। রাজনৈতিক দলগুলোকে ৭ দিনের আল্টিমেটাম দেয়া হলো কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, আমরা কোনো আলটিমেটাম দিইনি। আমরা অপেক্ষা করবো। এরপর প্রয়োজন হলে সরকার নিজের মতো করেই সিদ্ধান্ত নেবে।
সরকারের এমন বক্তব্যের পর সাধারণ মানুষের মাঝে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোকে যদি দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিজেরাই ঐকমত্যে পৌঁছানোর কথা এখন বলা হচ্ছে, তাহলে কথিত ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ করেছেটা কী ? কমিশন গঠনের নামে অন্তর্বর্তী সরকারের এতো অর্থ ব্যয়, এতো ঢাক-ঢোল পেটানো এতো অর্থ খরচেরই বা কী দরকার ছিলো? নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পরও রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার (সংবিধান বহির্ভূত) গঠন-প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌঁছেছিলো। তখনতো কোনো ঐকমত্য কমিশনের প্রয়োজন পড়েনি। এখন রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘দ্রুততম ঐকমত্যে পৌঁছানোর’ আহ্বান কেন? আসলে অন্তর্বর্তী সরকারের মতলবটা কী ? এ প্রশ্ন এখন মানুষ সরাসরিই করছে। কারণ, গণভোটের জন্য জুলাই অভ্যুত্থান হয়নি। একটি চরম স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা থেকে উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, ইনসাফ তথা সামাজিক ন্যায় বিচারের আকাক্সক্ষায় সংঘটিত হয়েছে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান। আর সেই আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের একমাত্র গণতান্ত্রিক পথ হচ্ছে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন। সেই আকাক্সক্ষাকে ‘দুই নম্বর এজেন্ডা’য় পরিণত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তারা সামনে নিয়ে এসেছে ‘গণভোট’ নামের উটকো ইস্যুকে। নেটিজেনদের গভীর সন্দেহ, ‘গণভোট’ ইস্যুতে জামায়াত ও সমমনা কয়েকটি প্যাডসর্বস্ব দলের জোটকে মাঠে নামিয়েছে মূলতঃ সরকার। সাত দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে সরকারই ‘গণভোট’ ইস্যু মাঠে এনেছে জামায়াতকে দিয়ে। জামায়াত হুঙ্কার ছেড়ে মাঠ গরমের চেষ্টা চালাচ্ছে। আঙ্গুল বাঁকিয়ে ঘি ওঠানোর হুমকি দিচ্ছে। এমন হুমকি এক সময় আ’লীগ দিয়েছিলো বিচার বিভাগের উদ্দেশ্যে। লগি-বৈঠার মিছিল করে আ’লীগ তৎকালীন প্রধান বিচারপতির উদ্দেশ্যে বলেছিলো, এ লাঠি কোথায় মারতে হয় আমরা জানি ! সেই আওয়ামী প্রতিধ্বনি এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে জামায়াতের হুঙ্কারে।
আজ রোববার (৯ নভেম্বর) শেষ হচ্ছে সরকার ঘোষিত রাজনৈতিক দলগুলোর ‘ঐকমত্যে পৌঁছানো’র ডেডলাইন। এ হিসেবে সরকারের ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণের’ তারিখও বটে। অন্যদিকে জামায়াত ‘গণভোট’ দাবি না নামলে ১১ নভেম্বর রাজপথ অচল করে দেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি এমন একটি হুঙ্কারের অপেক্ষায়ই ছিলো? যাতে জামায়াতের এই উটকো দাবিকে মেনে নিতে পারে? বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের দাবি মেনে নেয়ার জন্যই কি অন্তর্বর্তী সরকার ? সরকার কি তাহলে জামায়াতের দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে? উল্টোভাবে বলা যেতে পারে, সরকারের ‘চাওয়া’টাকেই কি জামায়াতকে দিয়ে বাস্তবায়ন করতে চাইছে ড. ইউনূস সরকার? বারংবার ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি ও টাইমলাইন ঘোষণা করে এখন জামায়াতকে দিয়ে ‘গণভোট’ ইস্যু সামনে আনা সরকারের কী ধরনের চাতুর্য ? মানুষকি এতোই বোকা ? এমন খুচরা চালাকি দেশের মানুষ বোঝে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ, সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মো: মহসিন রশিদতো স্পষ্ট ভাষায়ই বলছেন, ড. ইউনূসই নির্বাচন চান না! মুখে নির্বাচনের কথা বললেও কার্যতঃ তিনি ইস্যু সৃষ্টি করতে চাইছেন। প্রথম পি.আর. পদ্ধতি, এখন আবার গণভোট’র মতো ইস্যু সৃষ্টি করছেন তিনিই। অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে তিনি নতুন নতুন ইস্যু পয়দা করছেন। একবার ‘মানবিক করিডোর’ দিতে চাইলেন। চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে চাইলেন। সাধারণ মানুষের তীব্র অনাপত্তির মুখে রণেভঙ্গ দেন তিনি। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানকে মহসিন রশিদ ‘সিআইএ’র এজেন্ট’ বলেই উল্লেখ করছেন। তার ভাষায়, ড. মুহাম্মদ ইউনূস-খলিল-আলী রিয়াজচক্র এই অনৈক্য সৃষ্টির জন্য দায়ী। তারা একটি দলকে দিয়ে নির্বাচনোন্মুখ জাতিকে ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছেন।
সিনিয়র অ্যাডভোকেট মহসিন রশিদ আরো বলেন, বাংলাদেশকে একটি ‘ডল হাউজ’এ পরিণত করার পাঁয়তারা চলছে। এসবের অন্য অর্থ হচ্ছে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন না করা। ধরুন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে কি হবে না- এ প্রশ্নে জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি গণভোট হলো। যে দেশের বহু মানুষ এখনো নিরক্ষর সে দেশের মানুষ বিষয়টি বুঝলো কি বুঝলো না, আপনি গায়ের জোরে গণভোট বা রেফারেন্ডাম একটি করে নিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে কোনো দল সরকার গঠনের পর যদি একটি আইন করে ওই গণভোট বাতিল করে দেয়? তাহলে যারা (জামায়াত) আজকে জুলাই জাতীয় সনদ প্রশ্নে গণভোট-গণভোট করছেন তাদের তখন কি করার থাকবে ? ‘জুলাই জাতীয় সনদ’র তখন কী হবে? সুপ্রিম কোর্টের রায়ওতো পার্লামেন্টে বাতিল করা যায়।
আরেক সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বারংবার বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও বেআইনি। তার মতে, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের আয়োজন বাস্তবসম্মত নয়। সম্পূর্ণ অবাস্তব ধারণা থেকে গণভোটের কথা বলা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সাধারণতঃ গণভোট হয় তখন, যখন আগে সংসদ একটি বিষয়ে ধরুন আইন পাস করলো। সংবিধানে সংশোধনী পাস করে। দ্বিতীয় ধাপে গিয়ে জনগণ এটিকে গ্রহণ করলো কি করলো নাÑ এই প্রশ্নে গণভোট হয়। আগে গণভোট তারপর সংসদ- এমনটি দুনিয়ায় কখনো হয়নি। যে বিষয়ে গণভোটের কথা বলা হচ্ছে যে, জুলাই সনদে ৮৪টি ধারা আছে। ৮৪টি বিষয় আছে। মোটামুটি ২৫-৩০ পৃষ্ঠার একটা দলিল। এই দলিল পড়ে জনগণ কেমন করে নির্ধারণ করবে যে এটির পক্ষে কি পক্ষে নয়? ড.শাহদীন মালিকের যুক্তি হচ্ছে, বিশাল বই পড়ে বোঝার জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দরকার, সেই শিক্ষাতো আমাদের বোধহয় শতকরা ২০ ভাগের বেশি ভোটারের নেই। তার মধ্যে ৮৪টি বিষয় পড়ে কেউ যদি মনে করে যে আমি ৫০টির সঙ্গে একমত, কিন্তু ৩৪টির সঙ্গে একমত না। তাহলে কী হবে ? এভাবে গণভোট হয় না।
তিনি বলেন, ধরে নিলাম জুলাই সনদ গণভোটে পাস হলো। তারপর যেটা বলা হচ্ছে যে, সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে এটি যদি গ্রহণ না করে তাহলে আপনাআপনি বাস্তবায়িত হবে। এটিও আইনে দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে উদ্ভট ধারণা। গণভোট করার আগে গণভোট সংক্রান্ত আইনও পাস করতে হবে। কীভাবে গণভোট হবে? নির্বাচন কমিশন এটি কিভাবে পরিচালনা করবে? সেই আইনের খসড়াওতো এখন পর্যন্ত হয়নি। এখন গণভোটের কথা বলে আমাদের মূল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফেরত যাওয়ার যেটি সংসদ নির্বাচন, সেটিই বাধাগ্রস্ত হয় কি না এ আমার আশঙ্কা।
প্রিন্ট
নিজস্ব সংবাদ : 




















