ঢাকা ১২:৫৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ২০ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo হবিগঞ্জ-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী ডা: শাখায়াত হাসান জীবন আজমিরীগঞ্জ বানিয়াচংয়ে উচ্ছ্বাস Logo পটুয়াখালী-২ আসনে এনসিপি-জামায়াতে উচ্ছ্বাস, বিএনপিতে বিষাদ Logo ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মাগুরা-২ আসনে ধানের শীষের কান্ডারী এ্যাড. নিতাই রায় চৌধুরী Logo ফরিদপুরে চেয়ারম্যানের শেল্টারে চায়না দুয়ারি জালের কারখানার রমরমা ব্যবসা, প্রশাসনের অভিযানে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা Logo রয়টার্সের প্রতিবেদন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সালিশের দ্বারস্থ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে আদানি গ্রুপ Logo টানা কমছে দেশের রপ্তানি আয়, সামনে আরও কমার আশঙ্কা Logo বিএনপির ফাঁকা রাখা ৬৩ আসনে অগ্রাধিকার পাবেন যারা Logo আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশ জারি জোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই ভোট করতে হবে Logo আশুলিয়া সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ৬ দলিল লেখক বরখাস্ত Logo সাভারে ট্রলি ভ্যানের ব্রেক ফেল আয়ারল্যান্ডের ওপরে এসে গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ

আফগানিস্তানে কেন ব্যর্থ হয়েছিল সিআইএ?

মানুষকে চাঁদে পাঠানোর সাফল্যের পর যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পৃথিবীর বিশ্বাস ছিল সীমাহীন। মনে করা হতো—তারা চাইলে অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে। কিন্তু আফগানিস্তানে টানা দুই দশক যুদ্ধের পর সেনা প্রত্যাহার এবং তালেবানের পতাকা পুনরুত্থান সেই বিশ্বাসকে ভেঙে দিয়েছে।

আফগানিস্তান আজ ইতিহাসে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যর্থতার প্রতীক নয়, গোয়েন্দা ব্যর্থতারও নগ্ন স্বাক্ষর। মার্কিন অনুসন্ধানী সাংবাদিক টিম ওয়াইনার তার বই The Mission: American Intelligence in the 21st Century- এ তুলে ধরেছেন সিআইএ’র দীর্ঘ ব্যর্থতার কাহিনি।

অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের অহংকার বনাম নির্মম বাস্তবতা

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও গোয়েন্দা শক্তিকে ঘিরে বিশ্বে দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের অন্ধ আস্থা কাজ করেছে। মনে করা হতো—তারা চাইলে মুহূর্তেই যেকোনো লক্ষ্য পূরণ করতে পারে।

কিন্তু বাস্তবে সিআইএ’র ভেতরে সীমাবদ্ধতা, অজ্ঞতা এবং ভুল বিশ্লেষণই ছিল দৈনন্দিন বাস্তবতা। এজন্যই গোয়েন্দা বিদ্যায় একটি নতুন শাখার জন্ম হয়—“ইন্টেলিজেন্স ফেইলিওর” বা আরবিতে “إخفاق استخبارات”। আফগানিস্তান সেই ব্যর্থতার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়।

গোয়েন্দা সংস্থা: সত্যের অনুসন্ধান থেকে ছায়ার ষড়যন্ত্র

১৯৪৭ সালে সিআইএ জন্ম নেয় মূলত বিশ্বকে বোঝার জন্য এবং নতুন কোনো পার্ল হারবার ঠেকানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের বছরগুলোতে লক্ষ্য পাল্টে যায়। বোঝা নয়, বরং বিশ্বকে বদলানোই হয়ে ওঠে তাদের কাজ।

ইরানে মোসাদ্দেককে উৎখাত, কঙ্গোয় লুমুম্বা হত্যা, চিলিতে আলেন্দে উচ্ছেদ—সবখানেই সিআইএ’র ছায়া ছড়িয়ে পড়ে। ব্যর্থতাও ছিল অবশ্যম্ভাবী; কিউবার বে অব পিগস অভিযান বিপর্যয়ে শেষ হয়, ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি সিআইএকে গভীর সংকটে ফেলে।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর গোয়েন্দা যন্ত্রটিও ভেঙে পড়ে। বাজেট কেটে দেওয়া হয়, ঘাঁটি বন্ধ হয়, জনবল হ্রাস পায়। তখনকার এক উপ-পরিচালক মন্তব্য করেছিলেন—“সবকিছুই বদলে গেল।” অনেকে লিখেছিলেন—“সিআইএ মৃত; কেবল কোনো ভয়াবহ বিপর্যয় ছাড়া আর জেগে উঠবে না।”

৯/১১: অন্ধকারের সূচনা

১৯৯৮ সালে আল-কায়েদা পূর্ব আফ্রিকায় মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালায়। সেটি প্রমাণ করে তাদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। কিন্তু সার্বিয়ায় যুদ্ধ চলাকালীন চীনা দূতাবাসে ভুলবশত বোমা হামলার মতো ঘটনাগুলো প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনকে সিআইএ’র ওপর আস্থা হারাতে বাধ্য করে। ফলে আল-কায়েদার ঘাঁটি আফগানিস্তানে থাকা সত্ত্বেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

২০০১ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে বুশ প্রশাসন। তাদের দৃষ্টি ছিল ইরাকের দিকে, আফগানিস্তানকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কিন্তু ১১ সেপ্টেম্বরের হামলা আমেরিকাকে বাধ্য করে সরাসরি যুদ্ধে নামতে। প্রেসিডেন্ট বুশ ঘোষণা দেন—“কূটনীতি নয়, আমরা যুদ্ধে যাচ্ছি।”

যুদ্ধের নকশা ও বাস্তবতা

প্রথমে পরিকল্পনা ছিল সহজ—তালেবানকে সরিয়ে দ্রুত আল-কায়েদাকে ধ্বংস করা। সিআইএ উত্তর জোটকে ডলার ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে তালেবানের পতন ঘটায়। কিন্তু এরপর কী হবে—সেই প্রশ্নের উত্তর কারও কাছে ছিল না।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রামসফেল্ড বলেছিলেন, “আমরা জাতি গড়তে যাচ্ছি না।” অথচ প্রেসিডেন্ট কারজাই তালেবানের সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেটি আমেরিকা প্রত্যাখ্যান করে। ফলস্বরূপ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে থাকে, আর আফগান মাটিতে জন্ম নেয় অমোঘ অচলাবস্থা।

ব্যর্থতার কারণ

আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার মূল কারণ ছিল চারটি—আফগান সমাজ ও উপজাতি কাঠামো না বোঝার কৌশলগত অন্ধত্ব; ব্যাগভর্তি ডলার, গাড়ি ও বিলাসবহুল সরঞ্জাম বিলিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের কেনার নামে ব্যাপক দুর্নীতি; মাঝপথে আফগানিস্তান থেকে ইরাকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া; এবং শুধু তাৎক্ষণিক সাফল্যকে প্রাধান্য দেওয়া, অথচ কৌশলগত পরিকল্পনায় শূন্যতা। এসব কারণই একে একে যুদ্ধকে অনন্ত দুঃস্বপ্নে পরিণত করে।

দীর্ঘসূত্রতার সমাপ্তি

২০০১ সালের শেষের দিকে তালেবান পতনের পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল না। শান্তি আলোচনার সুযোগ হাতছাড়া হয়। এরপর কেটে যায় দুই দশক—অঢেল অর্থ ব্যয় হয়, অগণিত প্রাণ ঝরে যায়। অবশেষে ২০২১ সালে বিশৃঙ্খল সেনা প্রত্যাহার ঘটে, আর কাবুলে তালেবানের পতাকা পুনরুত্থান হয়। দৃশ্যটি হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দ্বিতীয় সায়গন—অপমানের প্রতীক, ব্যর্থতার ইতিহাস।

ইরাকে নতুন অধ্যায়, একই ভুল

আফগানিস্তান যখন স্থবির, তখন আমেরিকা মনোযোগ ঘোরায় ইরাকে। সাদ্দাম হুসেইনের বিরুদ্ধে গোপন অস্ত্র কর্মসূচির অভিযোগ প্রমাণে সিআইএ ব্যবহৃত হয়। পরে প্রমাণিত হয়, তথ্যগুলো ছিল মিথ্যা। আফগানিস্তানের পর ইরাকেও গোয়েন্দা ব্যর্থতা বিশ্বমঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

মুখোশ খসে পড়া

অবশেষে ব্যর্থতা স্বীকার করতেই হয়। সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্টিফেন হ্যাডলি বলেন, “আফগান সরকারের দুর্নীতিই তালেবানের সবচেয়ে বড় শক্তি।”

টিম ওয়াইনার মন্তব্য করেন, “তারা ডলার বিলাচ্ছিল, কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে তা বোঝেনি।” আর সাবেক সিআইএ পরিচালক রবার্ট গেটস অকপটে স্বীকার করেন, “৯/১১’র আগে আমরা জানতামই না আল-কায়েদা আসলে কী।”

উপসংহার

আফগানিস্তান ও ইরাকের যুদ্ধ প্রমাণ করেছে—শুধু সামরিক শক্তি বা অর্থ নয়, গোয়েন্দা ব্যর্থতাও একটি সাম্রাজ্যকে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করতে পারে। সিআইএ’র দায়িত্ব ছিল সমাজ ও শত্রুকে গভীরভাবে বোঝা এবং নীতি-নির্ধারকদের সামনে সত্য তথ্য উপস্থাপন করা। সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে তারা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক বিশ্বাসযোগ্যতার মূলে আঘাত হেনেছে।

সারকথা

ইতিহাস শেখায়—সাম্রাজ্যের পতন সবসময় কামানের গর্জনে হয় না; অনেক সময় তা ঘটে নিঃশব্দে—ভুল বিশ্লেষণ, অন্ধ অহংকার আর গোয়েন্দা ব্যর্থতার মর্মান্তিক সমন্বয়ে। আফগানিস্তান ও ইরাকের অভিজ্ঞতা তাই কেবল দুটি যুদ্ধের গল্প নয়; এটি গোটা সাম্রাজ্যের অন্ধকার আয়না।

আল জাজিরা আরবি থেকে মিশর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ানের অনুবাদ


প্রিন্ট
ট্যাগস :
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

হবিগঞ্জ-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী ডা: শাখায়াত হাসান জীবন আজমিরীগঞ্জ বানিয়াচংয়ে উচ্ছ্বাস

আফগানিস্তানে কেন ব্যর্থ হয়েছিল সিআইএ?

আপডেট সময় ১২:৪১:৪৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৫

মানুষকে চাঁদে পাঠানোর সাফল্যের পর যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পৃথিবীর বিশ্বাস ছিল সীমাহীন। মনে করা হতো—তারা চাইলে অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে। কিন্তু আফগানিস্তানে টানা দুই দশক যুদ্ধের পর সেনা প্রত্যাহার এবং তালেবানের পতাকা পুনরুত্থান সেই বিশ্বাসকে ভেঙে দিয়েছে।

আফগানিস্তান আজ ইতিহাসে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যর্থতার প্রতীক নয়, গোয়েন্দা ব্যর্থতারও নগ্ন স্বাক্ষর। মার্কিন অনুসন্ধানী সাংবাদিক টিম ওয়াইনার তার বই The Mission: American Intelligence in the 21st Century- এ তুলে ধরেছেন সিআইএ’র দীর্ঘ ব্যর্থতার কাহিনি।

অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের অহংকার বনাম নির্মম বাস্তবতা

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও গোয়েন্দা শক্তিকে ঘিরে বিশ্বে দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের অন্ধ আস্থা কাজ করেছে। মনে করা হতো—তারা চাইলে মুহূর্তেই যেকোনো লক্ষ্য পূরণ করতে পারে।

কিন্তু বাস্তবে সিআইএ’র ভেতরে সীমাবদ্ধতা, অজ্ঞতা এবং ভুল বিশ্লেষণই ছিল দৈনন্দিন বাস্তবতা। এজন্যই গোয়েন্দা বিদ্যায় একটি নতুন শাখার জন্ম হয়—“ইন্টেলিজেন্স ফেইলিওর” বা আরবিতে “إخفاق استخبارات”। আফগানিস্তান সেই ব্যর্থতার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়।

গোয়েন্দা সংস্থা: সত্যের অনুসন্ধান থেকে ছায়ার ষড়যন্ত্র

১৯৪৭ সালে সিআইএ জন্ম নেয় মূলত বিশ্বকে বোঝার জন্য এবং নতুন কোনো পার্ল হারবার ঠেকানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের বছরগুলোতে লক্ষ্য পাল্টে যায়। বোঝা নয়, বরং বিশ্বকে বদলানোই হয়ে ওঠে তাদের কাজ।

ইরানে মোসাদ্দেককে উৎখাত, কঙ্গোয় লুমুম্বা হত্যা, চিলিতে আলেন্দে উচ্ছেদ—সবখানেই সিআইএ’র ছায়া ছড়িয়ে পড়ে। ব্যর্থতাও ছিল অবশ্যম্ভাবী; কিউবার বে অব পিগস অভিযান বিপর্যয়ে শেষ হয়, ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি সিআইএকে গভীর সংকটে ফেলে।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর গোয়েন্দা যন্ত্রটিও ভেঙে পড়ে। বাজেট কেটে দেওয়া হয়, ঘাঁটি বন্ধ হয়, জনবল হ্রাস পায়। তখনকার এক উপ-পরিচালক মন্তব্য করেছিলেন—“সবকিছুই বদলে গেল।” অনেকে লিখেছিলেন—“সিআইএ মৃত; কেবল কোনো ভয়াবহ বিপর্যয় ছাড়া আর জেগে উঠবে না।”

৯/১১: অন্ধকারের সূচনা

১৯৯৮ সালে আল-কায়েদা পূর্ব আফ্রিকায় মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালায়। সেটি প্রমাণ করে তাদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। কিন্তু সার্বিয়ায় যুদ্ধ চলাকালীন চীনা দূতাবাসে ভুলবশত বোমা হামলার মতো ঘটনাগুলো প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনকে সিআইএ’র ওপর আস্থা হারাতে বাধ্য করে। ফলে আল-কায়েদার ঘাঁটি আফগানিস্তানে থাকা সত্ত্বেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

২০০১ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে বুশ প্রশাসন। তাদের দৃষ্টি ছিল ইরাকের দিকে, আফগানিস্তানকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কিন্তু ১১ সেপ্টেম্বরের হামলা আমেরিকাকে বাধ্য করে সরাসরি যুদ্ধে নামতে। প্রেসিডেন্ট বুশ ঘোষণা দেন—“কূটনীতি নয়, আমরা যুদ্ধে যাচ্ছি।”

যুদ্ধের নকশা ও বাস্তবতা

প্রথমে পরিকল্পনা ছিল সহজ—তালেবানকে সরিয়ে দ্রুত আল-কায়েদাকে ধ্বংস করা। সিআইএ উত্তর জোটকে ডলার ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে তালেবানের পতন ঘটায়। কিন্তু এরপর কী হবে—সেই প্রশ্নের উত্তর কারও কাছে ছিল না।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রামসফেল্ড বলেছিলেন, “আমরা জাতি গড়তে যাচ্ছি না।” অথচ প্রেসিডেন্ট কারজাই তালেবানের সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেটি আমেরিকা প্রত্যাখ্যান করে। ফলস্বরূপ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে থাকে, আর আফগান মাটিতে জন্ম নেয় অমোঘ অচলাবস্থা।

ব্যর্থতার কারণ

আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার মূল কারণ ছিল চারটি—আফগান সমাজ ও উপজাতি কাঠামো না বোঝার কৌশলগত অন্ধত্ব; ব্যাগভর্তি ডলার, গাড়ি ও বিলাসবহুল সরঞ্জাম বিলিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের কেনার নামে ব্যাপক দুর্নীতি; মাঝপথে আফগানিস্তান থেকে ইরাকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া; এবং শুধু তাৎক্ষণিক সাফল্যকে প্রাধান্য দেওয়া, অথচ কৌশলগত পরিকল্পনায় শূন্যতা। এসব কারণই একে একে যুদ্ধকে অনন্ত দুঃস্বপ্নে পরিণত করে।

দীর্ঘসূত্রতার সমাপ্তি

২০০১ সালের শেষের দিকে তালেবান পতনের পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল না। শান্তি আলোচনার সুযোগ হাতছাড়া হয়। এরপর কেটে যায় দুই দশক—অঢেল অর্থ ব্যয় হয়, অগণিত প্রাণ ঝরে যায়। অবশেষে ২০২১ সালে বিশৃঙ্খল সেনা প্রত্যাহার ঘটে, আর কাবুলে তালেবানের পতাকা পুনরুত্থান হয়। দৃশ্যটি হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দ্বিতীয় সায়গন—অপমানের প্রতীক, ব্যর্থতার ইতিহাস।

ইরাকে নতুন অধ্যায়, একই ভুল

আফগানিস্তান যখন স্থবির, তখন আমেরিকা মনোযোগ ঘোরায় ইরাকে। সাদ্দাম হুসেইনের বিরুদ্ধে গোপন অস্ত্র কর্মসূচির অভিযোগ প্রমাণে সিআইএ ব্যবহৃত হয়। পরে প্রমাণিত হয়, তথ্যগুলো ছিল মিথ্যা। আফগানিস্তানের পর ইরাকেও গোয়েন্দা ব্যর্থতা বিশ্বমঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

মুখোশ খসে পড়া

অবশেষে ব্যর্থতা স্বীকার করতেই হয়। সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্টিফেন হ্যাডলি বলেন, “আফগান সরকারের দুর্নীতিই তালেবানের সবচেয়ে বড় শক্তি।”

টিম ওয়াইনার মন্তব্য করেন, “তারা ডলার বিলাচ্ছিল, কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে তা বোঝেনি।” আর সাবেক সিআইএ পরিচালক রবার্ট গেটস অকপটে স্বীকার করেন, “৯/১১’র আগে আমরা জানতামই না আল-কায়েদা আসলে কী।”

উপসংহার

আফগানিস্তান ও ইরাকের যুদ্ধ প্রমাণ করেছে—শুধু সামরিক শক্তি বা অর্থ নয়, গোয়েন্দা ব্যর্থতাও একটি সাম্রাজ্যকে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করতে পারে। সিআইএ’র দায়িত্ব ছিল সমাজ ও শত্রুকে গভীরভাবে বোঝা এবং নীতি-নির্ধারকদের সামনে সত্য তথ্য উপস্থাপন করা। সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে তারা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক বিশ্বাসযোগ্যতার মূলে আঘাত হেনেছে।

সারকথা

ইতিহাস শেখায়—সাম্রাজ্যের পতন সবসময় কামানের গর্জনে হয় না; অনেক সময় তা ঘটে নিঃশব্দে—ভুল বিশ্লেষণ, অন্ধ অহংকার আর গোয়েন্দা ব্যর্থতার মর্মান্তিক সমন্বয়ে। আফগানিস্তান ও ইরাকের অভিজ্ঞতা তাই কেবল দুটি যুদ্ধের গল্প নয়; এটি গোটা সাম্রাজ্যের অন্ধকার আয়না।

আল জাজিরা আরবি থেকে মিশর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ানের অনুবাদ


প্রিন্ট