ছবি: প্রতীকী
ইতিহাস বদলে দেওয়া জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিল শিক্ষার্থীরা। তাই অন্য যে কোনো খাতের চেয়ে দীর্ঘদিন পিছিয়ে থাকা শিক্ষা খাতে পরিবর্তনই মানুষের বেশি প্রত্যাশা ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এ খাতে ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের মতো অভিজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ব্যক্তিকে উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ এই প্রত্যাশা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। সবকিছু মিলিয়ে শিক্ষা খাতে মানুষের প্রত্যাশা ছিল পাহাড়সম। কিন্তু এ খাতে এক বছরের অর্জন সব মহলকেই হতাশ করেছে। প্রত্যাশা অনুযায়ী শিক্ষা খাতে আসেনি কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নেতৃত্বের দুর্বলতা, যুগোপযোগী বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনার অভাব, বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের অভাব, আমলানির্ভরতা, রাজনৈতিক দলগুলোর পদ দখল, শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশের ক্ষমতা প্রদর্শনের মানসিকতা এবং লেখাপড়ায় মনোযোগ কম থাকায় শিক্ষায় প্রত্যাশিত পরিবর্তন হয়নি। এছাড়া সরকারে অটো পাশের ব্যবস্থা ও শিক্ষা কমিশন গঠন না করাও এর অন্যতম কারণ বলে তারা মনে করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, আমরা ভেবেছিলাম জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ৫০ বছরে শিক্ষার গুণগত একটা পরিবর্তন আসবে, সেটি হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনেক সংস্কার কমিটি করেছে। শিক্ষা খাত সংস্কারের সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। শিক্ষার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। শিক্ষায় যদি সংস্কার না হয়, দেশের অনেক সমস্যার সমাধান হবে না। এখনো সময় আছে একটা স্থায়ী শিক্ষা কমিশন অথবা অস্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করার। অন্ততপক্ষে এমন একটা কমিটি দরকার, যাতে ১৬ বছরে শিক্ষায় যে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, তার একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ পায়। ১৬ বছরে দেশে শিক্ষা বলতে কিছু ছিল না, সব ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা শিক্ষা নিয়ে খুব হতাশ। যতদিন একটি গণমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষা পদ্ধতির ব্যবস্থা প্রবর্তন করা না হবে, ততদিন দেশের উন্নতি হবে না। আমরা এই মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারছি না, কারণ আমাদের কোনো ভিত্তি বা শিক্ষানীতি নেই।
আরও পড়ুন
রিসোর্ট-রেস্টুরেন্টেও সরকার উৎখাতে একাধিক বৈঠক
রিসোর্ট-রেস্টুরেন্টেও সরকার উৎখাতে একাধিক বৈঠক
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য শিক্ষকদের উপাচার্য নিয়োগ দেয়নি। বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দুর্নীতি ও অনিয়ম খতিয়ে দেখার কোনো উদ্যোগ নেই। এক বছরে শিক্ষায় কোনো পরিবর্তন হয়নি এবং পরিবর্তনের চেষ্টাও করেনি। জানা যায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। মার্চে শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার (সিআর আবরার)। সম্প্রতি নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে ৫১টি সরকারি ও ৪টি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগ দেওয়া প্রায় সব কটি স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষসহ শীর্ষ পর্যায়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন। এ কারণে প্রথমে এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বাভাবিক করাই ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। পরে ধীরে ধীরে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নতুন উপাচার্য দেয়। উপাচার্য নিয়োগের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসতে শুরু করে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন, দলীয় রাজনীতিমুক্ত করা, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির বিধি সংশোধন এবং গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধির দৃশ্যমান বড় উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শিক্ষা উপদেষ্টা পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। শিক্ষকদের পেনশন পেতে ভোগান্তি, নিয়োগে অনিয়ম ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাবের অভিযোগ এখনো অব্যাহত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একের পর এক আন্দোলন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হয়রানি, এমনকি প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি পাওয়ায় উচ্চশিক্ষার পরিবেশ ক্ষতিগস্ত হয়েছে। অন্যদিকে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরেও শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়ন বা ঝরে পড়া রোধে কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। শিক্ষানীতির পূর্ণ পর্যালোচনা, যুগোপযোগী কারিকুলাম ও নিরপেক্ষ নিয়োগব্যবস্থা গঠনের মতো মৌলিক সংস্কারগুলো কেবল কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখনো বিভিন্ন দপ্তরে রয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতি। শিক্ষার সংকট নিরসনে সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সামগ্রিকভাবে পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। কেবল কোনো ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। চলতি শিক্ষাবর্ষ শুরুর চার মাস পর শিক্ষার্থীরা নতুন বই হাতে পেয়েছে। ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থীর মাঝে নিম্নমানের বই বিতরণের অভিযোগ রয়েছে। এসব বই মুদ্রণে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ‘একক ভর্তি পরীক্ষা’ আয়োজনের বড় সুযোগ ছিল এই অন্তর্বর্তী সরকারের সময়, সেটিও সম্ভব হয়নি।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। শিক্ষা নিয়ে কমিশন করার একটা প্রত্যাশা থাকলেও সেটি হয়নি। প্রাথমিক স্তরে একটা কমিটি করা হয়েছে। কমিটি সামগ্রিক বিষয়ে ২০০ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট জমা দিলেও খণ্ডিতভাবে দুই-একটি জিনিস বিবেচনায় নিয়েছে সরকার। যেখানে ১০০টির বেশি সুপারিশ করা হয়েছে। এককথায়, যে ধরনের সংস্কারের প্রত্যাশা ছিল, সেটি পূরণ হয়নি। আগের যেসব সমস্যা ও দুর্নীতি ছিল, সেটি এখনো রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের গুণগত মানের শিক্ষা অর্জনে নানান সমস্যা রয়েছে। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকদের সংকট রয়েছে। মাধ্যমিকেও গণিত, বিজ্ঞান ও ইংরেজির যোগ্য শিক্ষকের অভাব রয়েছে। শিক্ষায় যোগ্য নেতৃত্বের অভাব রয়েছে। শিক্ষাবিদ দিয়ে নয়, শিক্ষা বোঝে না এমন লোকদের নিয়ে শিক্ষার নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সরকারি আমলাদের দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিচালনা করছে। যার ফলে শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষা সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকারও দরকার।
বিগত কয়েক বছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে যোগ্যতার চেয়ে দলীয় পরিচয় বিবেচনায় নিয়োগ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী, দেড় দশকে ৪৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ৮ হাজার ৮০০ জন শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন। অভিযোগ আছে, তাদের বড় অংশের নিয়োগেই যোগ্যতর প্রার্থীদের উপেক্ষা, স্বজনপ্রীতি, দলীয় প্রভাব খাটানো হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই পছন্দের প্রার্থীকে প্রথমে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে পরবর্তী সময়ে স্থায়ী করা হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ২০১৬ সালের এক প্রকাশনায় প্রভাষক নিয়োগে আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক লেনদেনের তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া ২০২৪ সালে ইউজিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তত ৩০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগের ক্ষেত্রে ইউজিসির নিয়ম অমান্য করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নিয়োগের এ অনিয়মের অভিযোগ গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়েও অব্যাহত রয়েছে।
প্রিন্ট