আজ দেশে করোনায় কঠিন সঙ্কটে শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা
- আপডেট টাইম : ০৫:৫২:১৬ অপরাহ্ণ, শুক্রবার, ৩০ এপ্রিল ২০২১
- / ২৪১ ৫০০০.০ বার পাঠক
সময়ের কন্ঠ রিপোর্টার।।
রাজধানীর কাফরুল এলাকার একটি ভবনে কাজ করতেন শাহিদা বেগম (৩২)। করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় তাকে গত মার্চ মাসের বেতন দিয়ে একেবারে বিদায় করে দিয়েছেন তার গৃহকর্তা। কোথাও কাজের ব্যবস্থা করতে না পারায় ঘরভাড়া দিয়ে শুক্রবার গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন শাহিদা বেগম। চলমান লকডাউনে দীর্ঘদিন ধরে পাবলিক পরিবহন বন্ধ থাকায় কোনভাবে দিনযাপন করছেন রাজু আহমেদ। দুবার বাস মালিকদের পক্ষ থেকে কিছু সহায়তা পেয়েছেন। রাজু জানান, আর্থিক সহায়তা নেই, কাজ নেই, ঘরে খাবারও নেই। করোনা মহামারীতে শাহিদা বেগমের মতো গৃহকর্মী কিংবা রাজুর মতো পরিবহন শ্রমিকের সংখ্যা এই নগরীতে অনেকাংশেই বেড়েছে। জীবন বাঁচাতে ধারকর্জের জন্য হয় আত্মীয়স্বজন, নয়ত ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে হয়েছে শ্রমিকদের। আবার কাউকে কাউকে নিতে হয়েছে সরকারের দেয়া খাদ্যসহায়তা। করোনা মহামারীতে কর্মজীবী শ্রমিকদের নানামুখী সঙ্কটের মধ্যে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস।
জানা গেছে, ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে লাখ লাখ শ্রমিক সমবেত কণ্ঠে দাবি তুলেছিলেন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত নয়, আট ঘণ্টা কর্মদিবস চাই। শ্রমিকদের গুলি করে হত্যার মাধ্যমে সেই আন্দোলন নিষ্ঠুরভাবে দমন করাই শুধু নয়, আন্দোলনের নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। ১৯১৯ সালে আইএলও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সারাবিশ্বে মে দিবস পালিত হয়ে আসছে। শ্রম দাসত্ব থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষা নিয়ে শ্রমজীবী মানুষ গভীর আবেগে মে দিবস পালন করে। বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পর থেকেই মে দিবস সরকারী ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে গণজমায়েত হয় এমন কোন অনুষ্ঠান এবার হচ্ছে না। তবে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিবসটি উপলক্ষে গণমাধ্যমগুলোও বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে।
জানা যায়, মে দিবসের প্রধান দাবি আট ঘণ্টা কর্মদিবস দেশের ২২ লাখ সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হলেও কোটি কোটি বেসরকারী শ্রমিক সেই সুফল পান না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেয়া তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট শ্রমশক্তি ছয় কোটি আট লাখ। এর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে (শ্রম আইনের সুবিধা পান) কর্মরত জনশক্তির মাত্র ১৪.৯ শতাংশ। সবচেয়ে বড় অংশ ৮৫.১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। এই হিসাবে দেশের পাঁচ কোটি মানুষ দিনমজুরের মতো কাজ করে; যাদের শ্রম আইন-২০০৬ প্রদত্ত নিয়োগপত্র, কর্মঘণ্টা, ঝুঁকি ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, বাড়িভাড়াসহ বেশিরভাগ অধিকারই নিশ্চিত নয়। মালিকপক্ষের ইচ্ছায় তাদের কাজ ও মজুরি নির্ধারণ হয়ে থাকে। একাধিক শ্রমিক সংগঠনের দেয়া তথ্য মতে, শ্রম আইন নির্ধারিত মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে ৪৩টি সেক্টরের সোয়া কোটি শ্রমজীবীর নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের ব্যবস্থা থাকলেও বাকি লাখ লাখ শ্রমিককে ‘কাজ নাই তো মজুরি নাই’ নীতিতে কাজ করানো হয়ে থাকে। ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক নির্মাণ খাতে, ৭০ লাখ পরিবহন খাতে, তিন লাখ পাট খাতে এবং ১০ লাখের বেশি দোকান কর্মচারী, চা, চামড়া, তাঁত, রিরোলিং, মোটর মেকানিক, লবণ, চিংড়ি, সংবাদমাধ্যম, হাসপাতাল-ক্লিনিক, পুস্তক বাঁধাই, হকার, রিক্সা-ভ্যানচালক, ইজিবাইক চালক, সিকিউরিটি গার্ডসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করছেন।
শ্রমিক নেতারা জানান, শ্রমিকদের আয়ের বড় অংশ খাদ্য, বাড়িভাড়া, পোশাক ও চিকিৎসায় ব্যয় হয়ে যাওয়ার ফলে সঞ্চয় যেমন থাকছে না, তেমনি দক্ষতা অর্জনের জন্য বাড়তি খরচ করাও শ্রমিকের জন্য সম্ভব হয়ে উঠছে না। এরপর শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তো রয়েছেই। সাভারে রানা প্লাজা ধস ও তাজরীনসহ বিভিন্ন কারখানার অগ্নিকান্ড শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি সামনে এনে দিয়েছে। সর্বশেষ করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই দুর্যোগ শ্রমিকদের অসহায়ত্বের বিষয়টি বিশ্ববাসীর সামনে স্পষ্ট করে তুলেছে। এসব ক্ষেত্রে মালিকের মুনাফার শিকার হচ্ছেন শ্রমিকরা।
আজ মহান মে দিবসে শ্রমিকদের রাজপথ কাঁপানো স্লোগান থাকছে না। কোন সভা-সমাবেশ আর শোভাযাত্রা হবে না। করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী ৩০০ কোটির বেশি শ্রমজীবী মানুষের জীবন স্তব্ধ করে দিয়েছে। ফলে আজ শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন হলেও করোনা দুনিয়ার এসব শ্রমজীবী মানুষের জীবন করে দিয়েছে লন্ডভন্ড। বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বলেন, রানা প্লাজা ভবনধসে আহত পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে ২০১৯ সালে বেকার ছিলেন ৫১ শতাংশ। গত বছর করোনাকালে সেটি বেড়ে ৫৭ শতাংশ হয়েছে, যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তিনি বলেন, গত বছর লকডাউনে বেতন কাটা, ছাঁটাই এবং লেঅফে শ্রমিকদের জীবন ছিল বিপর্যস্ত। কাজ হারায় সাড়ে ৩ লাখের বেশি শ্রমিক। বহু কারখানা এখনও বন্ধ। বহু শ্রমিক কাজ ছেড়ে গ্রামে গেছে কিংবা বেকার হয়েছে। এখনও কোন কোন কারখানার শ্রমিক তাদের বকেয়া বেতন পায়নি।
ন্যূনতম মজুরি নেই ৪৭ শিল্প খাতে ॥ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর (ডিআইএফই) থেকে দেশের সব শিল্প প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স নিতে হয়। শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন এই সংস্থা এ পর্যন্ত ৫৪টি শিল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিয়েছে। এর বাইরে বিবিধ তালিকায় আরও অন্তত ৫০টি শিল্প খাতকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এই ১০২টি শিল্পের মধ্যে মজুরি বোর্ড মাত্র ৪৭টি শিল্পে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ এখনও বাকি ৫৭টি শিল্পের শ্রমিকরা ন্যূনতম ঘোষিত মজুরির বাইরে রয়েছেন। মজুরি বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, আরও তিনটি শিল্পের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এ নিয়ে এখন কাজ চলছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশের মোট ছয় কোটি ৭০ হাজার মানুষ শ্রমবাজারে নিয়োজিত।
করোনায় ৮০ শতাংশেরই মজুরি কমেছে ॥ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও সুইডেনের ওয়েজ ইন্ডিকেটর ফাউন্ডেশন (ডব্লিউআইএফ)’র এক জরিপে দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে চার শিল্প খাতের ৮০ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি ১০০ শ্রমিকের মধ্যে ৮০ জনেরই মজুরি কমেছে। জরিপে দেখা গেছে, এই চার খাতের নারী শ্রমিকরা পুরুষের তুলনায় গড়ে ৭৭ শতাংশ কম মজুরি পান। চার খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মজুরি পান নির্মাণশিল্পের শ্রমিকরা। আবার তাঁরাই আছেন সবচেয়ে নাজুক অবস্থায়। কারণ, এই শিল্পে কর্মরত কোন শ্রমিকেরই যৌথ চুক্তি নেই, যা অন্য তিনটি খাতে কিছুটা হলেও আছে। নিরাপত্তার দিক থেকেও তাঁরা বেশি পিছিয়ে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় তাঁদের। অন্যদিকে সবচেয়ে কম মজুরি পান চা-শিল্পের শ্রমিকরা। জরিপের তথ্য বলছে, চারটি খাতের মধ্যে মাসে গড়ে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৫৪৭ টাকা করে মজুরি পান নির্মাণশিল্পের একজন শ্রমিক। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চামড়া খাতের একজন শ্রমিক মাসে মজুরি পান ১০ হাজার ৮০০ টাকা। পোশাকশিল্প তৃতীয় অবস্থানে। এই খাতের একজন শ্রমিকের মাসিক গড় মজুরি ৯ হাজার ৪৫৭ টাকা। সর্বনিম্ন মজুরি চা-শিল্পে। এই খাতের একজন শ্রমিক মাসে পান মাত্র ৩ হাজার ৯২ টাকা।
বিআইডিএস ও ডব্লিউআইএফ গত বছরের আগস্ট থেকে নবেম্বর সময়ে র্যা ন্ডম স্যাম্পলিং বা দৈবচয়নের ভিত্তিতে ‘শোভন মজুরি’ শীর্ষক এই জরিপ পরিচালনা করেছে। এতে চার খাতের মোট ১ হাজার ৮৯৪ শ্রমিকের সাক্ষাতকার নেয়া হয়। এর মধ্যে ৬৫টি তৈরি পোশাক কারখানার ৭২৪ জন, ৩৪টি চামড়া কারখানার ৩৩৭ জন, পাঁচটি চা বাগানের ৪০১ জন এবং নির্মাণশিল্পের ৪৩২ শ্রমিক রয়েছেন। জরিপ পরিচালনায় অর্থায়ন করে নেদারল্যান্ডসের সংস্থা মন্ডিয়াল এফএনভি। এই জরিপ করার উদ্দেশ্য ছিল, চারটি খাতে প্রকৃত মজুরি কত, শ্রমিকদের আয়-ব্যয়ের অবস্থা, করোনায় তাঁদের জীবনে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে এবং যৌথ চুক্তিপত্র আছে কিনা, এসব দেখা।