আজ সোনার বাংলা দেশ বঙ্গবন্ধুর দেশ
- আপডেট টাইম : ০৭:৫৭:৩৩ পূর্বাহ্ণ, শনিবার, ২০ মার্চ ২০২১
- / ৩১৮ ৫০০০.০ বার পাঠক
বোরহান সম্পাদকীয়।।
আজ সোনার বাংলা দেশ বঙ্গবন্ধুর দেশের রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ যাকে ইংরেজীতে বলা হয় Bangladesh Export Processing Zones Authority-বেপজা (BEPZA) সম্পর্কে দেশের মানুষের মনে অনেক কৌতূহল। বিভিন্ন সময়ে অনেকেই আমাদের এই সংস্থা সম্বন্ধে বিভিন্ন প্রশ্ন করে থাকেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরটি বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা)-এর ৪১তম প্রতিষ্ঠা বছর। মানুষের নানা ধরনের প্রশ্ন ও কৌতূহল নিবারণের আলোকে দেশের মানুষকে বেপজা সম্বন্ধে জ্ঞাতকরণের উদ্দেশ্যে এই প্রয়াস।১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বিধ্বস্ত দেশের দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দেশের প্রয়োজন ছিল ব্যক্তিগত মূলধন। এর মাধ্যমে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কারিগরি জ্ঞান/দক্ষতা ((Technical Knowhow)ি এর ব্যবহার। সদ্য স্বাধীন দেশে ব্যক্তিগত মূলধন বিনিয়োগ এবং কারিগরি জ্ঞানের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী ও সচল করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর পর বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সত্তরের দশকের শেষের দিকে Foreign Currency reserve (বৈদেশিক অর্থ জমা) একদম কমে যাচ্ছিল। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছিল না। এছাড়া FDI (Foreign Direct Investment) কমে যাওয়ায় দেশের মোট রফতানির ওপর এর প্রভাব পড়ায় কমতে থাকে রফতানি। সেই সময় তদানীন্তন World Bank President Mr. Robert Strange McNamara বাংলাদেশ সফরে এসে সরকারকে দেশে EPZ (Export Processing Zones) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উল্লিখিত রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো দূর করার পরামর্শ দেন। Mr. McNamara এর পরামর্শকে গুরুত্ব দিয়ে তদানীন্তন সরকার BEPZA Act ১৯৮০ জাতীয় সংসদে পাস করে, যা বাস্তবায়ন হয় ১৯৮০ সালের ১৫ এপ্রিল। ইপিজেড স্থাপনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য বেপজা তার রূপকল্প (Vision) হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে অভিলক্ষ (Mission) নির্ধারণ করে ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ়করণের লক্ষ্যে ইপিজেডসমূহের শিল্পায়ন, বিনিয়োগ উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং রফতানি বৃদ্ধিকরণ কার্যক্রম। বিদেশী ব্যক্তিগত মূলধনকে উৎসাহিত এবং আকর্ষণ করার জন্য সরকার উদার শিল্পনীতি (Liberal Industrial Policy) প্রণয়ন করে। এর ফলে EPZ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রগতির ধারাবাহিকতা শুরু হয়।
এই ধারাবাহিকতার আলোকে সর্ব প্রথম চট্টগ্রামের হালিশহরে ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠা হয় চট্টগ্রাম ইপিজেড। বর্তমানে চট্টগ্রাম ইপিজেড ৪৫৩ একর জমির ওপর সুবিন্যস্তভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম ইপিজেডের সাফল্যের আলোকে ১৯৯৩ সালে ঢাকার নিকটবর্তী সাভার অঞ্চলে ৩৬১.২২ একর এলাকা নিয়ে শুরু হয় ঢাকা ইপিজেড। চট্টগ্রাম ও ঢাকা ইপিজেডের পর ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের জীবনযাত্রার মান এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে, সে জন্য দেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর বাগেরহাটের মোংলায় মংলা ইপিজেড এবং উত্তরবঙ্গের নীলফামারী জেলায় ২০০১ সালে উত্তরা ইপিজেড এবং একই সঙ্গে পাবনার পাক্শিতে ঈশ্বরদী ইপিজেড প্রতিষ্ঠা হয়। এছাড়া ২০০০ সালে কুমিল্লা পুরাতন বিমানবন্দর এলাকায় কুমিল্লা ইপিজেড, ২০০৬ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে সাবেক আদমজী জুট মিল এলাকায় আদমজী ইপিজেড এবং চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গা স্টিল মিল এলাকায় কর্ণফুলী ইপিজেড প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মোট ২৩১১ একর জমির ওপর স্থাপিত এই ৮টি ইপিজেডে প্রায় ৫,০০,০০০ লাখ বাংলাদেশী নাগরিকের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে। যার মধ্যে নারী শ্রমিক প্রায় ৬৬%। ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত উল্লিখিত ৮টি ইপিজেডে ৪৬৩টি সচল শিল্প প্রতিষ্ঠানে মোট প্রকৃত বিনিয়োগের পরিমাণ ৫.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিগত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ইপিজেডের শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে মোট ৬.৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রফতানি করা হয়েছে, যা দেশের মোট জাতীয় রফতানির ২০%। করোনা মহামারীর কারণে সামগ্রিকভাবে দেশের মোট রফতানির পরিমাণ বিগত অর্থবছরে হ্রাস পেলেও বেপজার আওতাধীন ইপিজেডসমূহের রফতানিতে কোন রকম নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। এ পর্যন্ত ইপিজেডসমূহে জাপান, কোরিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্লান্স, ইতালি, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, আয়ারল্যান্ড, তুরস্ক, ইউক্রেন, কুয়েত, রোমানিয়া, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, শ্রীলঙ্কা, বেলজিয়াম, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যাণ্ড ও বাংলাদেশসহ ৩৮টি দেশ বিনিয়োগ করেছে। প্রথাগত তৈরি পোশাক পণ্যের বাইরে ইপিজেড এর কারখানাসমূহে তৈরি হচ্ছে বিশ্ববিখ্যাত বিভিন্ন ব্র্যাণ্ডের বহুমুখী সব পণ্য। এগুলোর মধ্যে Reebok, H&M. GAP, Jcpenney, Adidas, Lee, Wrangler, Lafuma, Dockers, Michael Kors, Walmart, Nike, ঘরশব উল্লেখযোগ্য।
দেশের ইপিজেডসমূহ রফতানি বহুমুখীকরণে ও বৈচিত্রায়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে দেশের ইপিজেডসমূহে ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য, গাড়ির যন্ত্রাংশ, মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশ, ক্যামেরার লেন্স ও পার্টস, বাইসাইকেল, বিদ্যুত, ব্যাটারি, গলফ শ্যাফট, জুতা ও জুতার এক্সেসরিজ, টেক্সটাইল, এনার্জি সেভিং বাল্ব, আসবাবপত্র, তাঁবু, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, কসমেটিকস, হলিউড চশমা, খেলার সামগ্রী, উইগ, বাঁশের কফিনসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি হচ্ছে।আজ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাই উপজেলার ১১৫০ একর জমিতে ‘বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল’ স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে, যেখানে কিছুদিনের মধ্যে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের জন্য চুক্তিবদ্ধ করা হবে। বেপজার সাফল্যের কথা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সরকার দেশে ৩টি নতুন ইপিজেড স্থাপন করার কাজ হাতে নিয়েছে। সেগুলো হলো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে যশোর জেলায় একটি, দেশের উত্তরাঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা উন্নয়নের লক্ষ্যে রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জের ইক্ষু খামারে একটি এবং পটুয়াখালী পায়রা বন্দরের কাছাকাছি এলাকায় একটি। মোট ৩টি নতুন ইপিজেড বাস্তবায়নের কাজ বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
সকল মালিক-শ্রমিক এবং শ্রম-মজুরি সম্পর্ক, উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি, পণ্যের গুণগতমান উন্নয়ন এবং আধুনিকায়ন, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার পূর্বশর্ত। সংবিধানের আলোকে এবং আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী শ্রমনীতি ও শ্রমিক কল্যাণে বহুমুখী কর্মকৌশল বাস্তবায়নে বেপজা বদ্ধপরিকর। এতদুদ্দেশ্যে বেপজা ইতোমধ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার একটি হলো ‘বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন ২০১৯’ যার মাধ্যমে বেপজা তার শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে।
বর্তমানে বেপজা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে একটি সফল সংস্থা। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বেপজার গবর্নিং বোর্ডের চেয়ারম্যান। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বেই বেপজা বর্তমানে একটি সফল সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে। আন্তর্জাতিক উদ্যোক্তাদের কাছে দেশের ইপিজেডসমূহ এখন বিনিয়োগের স্বর্গভূমি হিসেবে পরিগণিত ও প্রশংসিত হচ্ছে। স্বল্পতম উৎপাদন ব্যয়, শান্তিপূর্ণ স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা এবং শিল্পবান্ধব কর্মপরিবেশের ফলে বিশ্ববাজারে বেপজা এখন একটি ব্র্যান্ড।সরকারের উদার বিনিয়োগ ও শিল্প নীতির ফলে বর্তমান সরকারের অধীনে বিগত ১০ বছরে বেপজা বিনিয়োগ, রফতানি ও বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। দেশে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং জাতীয় রফতানিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বেপজার অধীনে ইপিজেডসমূহ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ব্যাপক অবদান রাখছে। প্রত্যক্ষ অবদান হিসেবে দেশে রফতানি, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োাগ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সেই সঙ্গে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে ইপিজেড স্থাপনের ফলে এর সন্নিহিত এলাকায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে গড়ে ওঠা Satellite Town, Backward and Forward Linkage Industries, Accessories Industries সহ পরিবহন, খাদ্য সরবরাহ, বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, টেলিযোগাযোগ, বীমা এজেন্ট, সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট, হোটেল ও হাউজিংসহ অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ব্যবসার মাধ্যমে দেশের আর্থিক উন্নয়ন এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে পরোক্ষভাবে যথেষ্ট অবদান রাখছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রূপকল্প ২০২১ এবং ২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে বেপজা দ্রুত এগিয়ে চলছে সাফল্যের সঙ্গে।
লেখকঃসময়ের কন্ঠ