ঢাকা ১২:৪৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
সংবাদ শিরোনাম ::

মাতৃ ও শিশু মৃত্যু কমাতে গর্ভকালীন সময়ে জরুরী সেবা নেয়া উচিত

মাতৃ ও শিশু মৃত্যু কমাতে প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী সেবার পাশাপাশি গর্ভাবস্থায় সেবাও সমান জরুরি বলছেন চিকিৎসকরা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের গাইনী বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি ডা. কামরুন্নেছা রুনার মতে, অনেকেই গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপারটি উপেক্ষা করে থাকেন। অথচ মা এবং মাতৃগর্ভে বেড়ে ওঠা শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য গর্ভকালীন সেবা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে যত্নের অভাবে মা ও শিশু উভয়েই বিভিন্ন ধরনের জটিলতাসহ মৃত্যুঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে।

নিরাপদ মাতৃত্ব বলতে গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী সময়ে সকল নারীর জন্য নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ বোঝায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে হলে গর্ভকালীন কমপক্ষে চারবার চেকআপের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। গর্ভধারণের ১৬ সপ্তাহের মধ্যে প্রথমবার, ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে ২য় বার, ৩২ সপ্তাহে তৃতীয় বার এবং ৩৬ সপ্তাহে ৪র্থ বার চিকিৎসকের কাছে গিয়ে এ চেকআপ সেবা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

এবারের নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের প্রতিপাদ্যেও গর্ভকালীন সেবার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য ও নবজাতকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতি বছর ২৮ মে বাংলাদেশ সরকার নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালন করে আসছে। এবার এই দিবসের প্রতিপাদ্য ‘গর্ভকালে চারবার সেবা গ্রহণ করি–নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করি’। বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামেও এ দিবস পালিত হচ্ছে আজ। চমেক হাসপাতালের গাইনী বিভাগ, ওজিএসবি চট্টগ্রাম শাখা ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি হাসপাতাল দিবসটি পালন করছে।

নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতে গর্ভধারণ পূর্ববর্তী সেবা, গর্ভকালীন সেবা, প্রসবকালীন সেবা এবং প্রসব পরবর্তী সেবার ওপর জোর দেয়ার কথা বলেছেন চমেক হাসপাতালের গাইনী বিভাগের প্রধান ও চমেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার। মা ও শিশুর জীবন রক্ষায় গর্ভকালীন সেবার পাশাপাশি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রসবের বিকল্প নেই জানিয়ে তিনি বলেন, প্রসবকালীন বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন বিলম্বিত প্রসব, বাধাগ্রস্ত প্রসব। এসব জটিলতা জরায়ু ফেটে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এছাড়া অতিরিক্ত রক্তক্ষরণসহ আরো নানা জটিলতা বাড়িতে সন্তান প্রসবের কারণে হয়ে থাকে। ইউনিসেফের এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, কোনো চিকিৎসক বা দক্ষ ধাত্রী ছাড়া বাড়িতে প্রসবের কারণেই অধিকাংশ প্রসূতি মায়ের মৃত্যু হয়। এজন্য নির্ধারিত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রসব করানো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রসব করানো হলে প্রসূতি মা ও শিশু উভয়ের মৃত্যুঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। প্রসবকালীন বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিলেও চিকিৎসক দ্রুত চিকিৎসার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু বাসা–বাড়িতে হলে এটি সম্ভব হয় না। জটিলতা দেখা দিলে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিতে অনেক দেরি হয়ে যায়। এতে করে মা ও শিশুর মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। প্রসূতিকে অবশ্যই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে প্রসব করানোর পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭–১৮ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বছরে ৩৭ লাখের বেশি শিশু জন্ম নেয়। এর মধ্যে ৫০ শতাংশের প্রসব হয় বাড়িতে। অর্থাৎ ৫০ শতাংশ প্রসূতিকে প্রসবকালীন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেয়া হয় না, যা মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি বলছেন চিকিৎসকরা। তাঁরা বলছেন, মা ও নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি কমাতে নির্ধারিত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রসব করানো গুরুত্বপূর্ণ।

গর্ভধারণ পূর্ববর্তী সেবা : চিকিৎসকরা বলছেন, গর্ভধারণ পূর্ববর্তী সেবা বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার প্রবণতা আমাদের সমাজে এখনো তেমনভাবে গড়ে উঠেনি। কিন্তু গর্ভধারণের পূর্বেই যদি চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া হয় তাহলে ডায়াবেটিস, রক্তস্বল্পতা, জন্মগত হৃদরোগসহ অনেক জটিল রোগ বা শারীরিক অবস্থা আগেই ডায়াগনোসিস হয়ে যায়। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পর স্থিতিশীল শারীরিক অবস্থায় গর্ভধারণ মা ও শিশুর জীবন বিপন্ন হওয়া থেকে রক্ষা করে। এছাড়া প্রয়োজনীয় পরামর্শ এই সময়ে ভবিষ্যৎ মাকে মানসিক প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করে।

গর্ভকালীন সেবা : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন গর্ভবতী মহিলার গর্ভাবস্থায় অন্তত চারবার গর্ভকালীন সেবা নিতে হবে। এই সেবার মধ্যে রয়েছে প্রসূতির শারীরিক পরীক্ষা, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা, প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান ও চিকিৎসাসেবা প্রদান, ঝুঁকিপূর্ণ মায়েদের চিহ্নিত করা ও সেবা প্রদান, প্রসূতি ও প্রসূতির পরিবারের সদস্যদের ভবিষ্যৎ প্রসবের প্রকৃতি, সময় ও স্থান নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গর্ভকালীন অন্তত একবার সেবাগ্রহীতার হার ২০১১ সালে ছিল ৬৮ শতাংশ। ২০১৭–২০১৮ সালে এ হার ৯২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০১১ সালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবা দানকারী থেকে সেবা গ্রহণের হার ছিল ৫৫ শতাংশ, যা ২০১৭–২০১৮ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ৮২ শতাংশ হয়েছে।

গর্ভকালীন সেবার হার শত ভাগে উন্নীত করা গেলে মাতৃ মৃত্যুর হার আরো কমে আসবে বলে জানান অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক মাতৃ মৃত্যু। একটি দেশের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি কতটা ভালো তার একটি মৌলিক সূচক মাতৃ মৃত্যুর হার। ভারত ও পাকিস্থানের তুলনায় বাংলাদেশ এই সূচকের বিচারে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছে। কিন্তু তা এসডিজির নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে এখনো পিছিয়ে।

প্রসবকালীন সেবা : প্রসূতি মায়েরা সন্তান জন্মদানের জন্য নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা গ্রহণ করলেই কেবল প্রসবকালীন সেবা নিশ্চিত করা যাবে বলে জানান চিকিৎসকরা। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, অধিকাংশ মায়ের মৃত্যু ঘটে কোনো চিকিৎসক বা দক্ষ ধাত্রী ছাড়া বাড়িতে প্রসবের কারণে।

ওজিএসবি চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি অধ্যাপক ডা. কামরুন্নেছা রুনা বলেন, প্রসবকালীন রক্তপাতের ঘটনায় অনেক প্রসূতি মায়ের অকাল মৃত্যু হয়। এটিকে চিকিৎসা ভাষায় একলেম্পশিয়া বলা হয়। এই রক্তপাত বন্ধ করা গেলে মাতৃ মৃত্যুর হার আরো কমে আসবে। প্রসবজনিত রক্তপাত বা একলেম্পশিয়ার চিকিৎসা সমন্বিতভাবে (বান্ডেল অ্যাপ্রোচ) করা গেলে মাতৃ মৃত্যু কমানো সম্ভব। সমন্বিতভাবে এর চিকিৎসাই ওজিএসবির বর্তমান লক্ষ্য।

প্রসব পরবর্তী সেবা : একজন মায়ের প্রসব পরবর্তী সেবাও গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে অধ্যাপক ডা. কামরুন্নেছা রুনা বলেন, প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়ের নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে প্রসব পরবর্তী ৬ সপ্তাহ সময়কালে রক্তক্ষরণ, জরায়ুতে সংক্রমণের মতো জটিলতাগুলো প্রসূতি মাকে মৃত্যুঝুঁকিতে ঠেলে দেয়। এছাড়া মূত্রাশয়, শ্বাসনালীর সংক্রমণ, রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধা, মানসিক বিষণ্নতা ইত্যাদি জটিলতাও দেখা দিতে পারে। তাই প্রসব পরবর্তী সেবাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

মায়ের সুস্থতার জন্য এই সময়কালে পুষ্টিকর খাবার, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পরিমিত ঘুম ও উষ্ণ মানসিক সাহচর্য জরুরি বলে মনে করেন চমেক হাসপাতালের গাইনী বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার। তিনি বলেন, দেশের স্বার্থে, অনাগত সন্তানের সুস্বাস্থ্যের জন্য, উন্নয়নের মাইলফলকে নিজেদের দৃঢ় অবস্থানের জন্য নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। কারণ, সুস্থ মা–ই শুধু পারেন একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে।

আরো খবর.......

জনপ্রিয় সংবাদ

পাহাড় পুর বাজারে ক্ষমতার দাপটে সরকারি শৌচাগার বন্ধ করে দোকান ঘর নির্মাণ,

মাতৃ ও শিশু মৃত্যু কমাতে গর্ভকালীন সময়ে জরুরী সেবা নেয়া উচিত

আপডেট টাইম : ০৩:১৪:০৫ অপরাহ্ণ, রবিবার, ২৮ মে ২০২৩

মাতৃ ও শিশু মৃত্যু কমাতে প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী সেবার পাশাপাশি গর্ভাবস্থায় সেবাও সমান জরুরি বলছেন চিকিৎসকরা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের গাইনী বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি ডা. কামরুন্নেছা রুনার মতে, অনেকেই গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপারটি উপেক্ষা করে থাকেন। অথচ মা এবং মাতৃগর্ভে বেড়ে ওঠা শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য গর্ভকালীন সেবা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে যত্নের অভাবে মা ও শিশু উভয়েই বিভিন্ন ধরনের জটিলতাসহ মৃত্যুঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে।

নিরাপদ মাতৃত্ব বলতে গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী সময়ে সকল নারীর জন্য নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ বোঝায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে হলে গর্ভকালীন কমপক্ষে চারবার চেকআপের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। গর্ভধারণের ১৬ সপ্তাহের মধ্যে প্রথমবার, ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে ২য় বার, ৩২ সপ্তাহে তৃতীয় বার এবং ৩৬ সপ্তাহে ৪র্থ বার চিকিৎসকের কাছে গিয়ে এ চেকআপ সেবা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

এবারের নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের প্রতিপাদ্যেও গর্ভকালীন সেবার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য ও নবজাতকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতি বছর ২৮ মে বাংলাদেশ সরকার নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালন করে আসছে। এবার এই দিবসের প্রতিপাদ্য ‘গর্ভকালে চারবার সেবা গ্রহণ করি–নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করি’। বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামেও এ দিবস পালিত হচ্ছে আজ। চমেক হাসপাতালের গাইনী বিভাগ, ওজিএসবি চট্টগ্রাম শাখা ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি হাসপাতাল দিবসটি পালন করছে।

নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতে গর্ভধারণ পূর্ববর্তী সেবা, গর্ভকালীন সেবা, প্রসবকালীন সেবা এবং প্রসব পরবর্তী সেবার ওপর জোর দেয়ার কথা বলেছেন চমেক হাসপাতালের গাইনী বিভাগের প্রধান ও চমেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার। মা ও শিশুর জীবন রক্ষায় গর্ভকালীন সেবার পাশাপাশি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রসবের বিকল্প নেই জানিয়ে তিনি বলেন, প্রসবকালীন বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন বিলম্বিত প্রসব, বাধাগ্রস্ত প্রসব। এসব জটিলতা জরায়ু ফেটে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এছাড়া অতিরিক্ত রক্তক্ষরণসহ আরো নানা জটিলতা বাড়িতে সন্তান প্রসবের কারণে হয়ে থাকে। ইউনিসেফের এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, কোনো চিকিৎসক বা দক্ষ ধাত্রী ছাড়া বাড়িতে প্রসবের কারণেই অধিকাংশ প্রসূতি মায়ের মৃত্যু হয়। এজন্য নির্ধারিত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রসব করানো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রসব করানো হলে প্রসূতি মা ও শিশু উভয়ের মৃত্যুঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। প্রসবকালীন বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিলেও চিকিৎসক দ্রুত চিকিৎসার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু বাসা–বাড়িতে হলে এটি সম্ভব হয় না। জটিলতা দেখা দিলে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিতে অনেক দেরি হয়ে যায়। এতে করে মা ও শিশুর মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। প্রসূতিকে অবশ্যই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে প্রসব করানোর পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭–১৮ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বছরে ৩৭ লাখের বেশি শিশু জন্ম নেয়। এর মধ্যে ৫০ শতাংশের প্রসব হয় বাড়িতে। অর্থাৎ ৫০ শতাংশ প্রসূতিকে প্রসবকালীন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেয়া হয় না, যা মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি বলছেন চিকিৎসকরা। তাঁরা বলছেন, মা ও নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি কমাতে নির্ধারিত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রসব করানো গুরুত্বপূর্ণ।

গর্ভধারণ পূর্ববর্তী সেবা : চিকিৎসকরা বলছেন, গর্ভধারণ পূর্ববর্তী সেবা বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার প্রবণতা আমাদের সমাজে এখনো তেমনভাবে গড়ে উঠেনি। কিন্তু গর্ভধারণের পূর্বেই যদি চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া হয় তাহলে ডায়াবেটিস, রক্তস্বল্পতা, জন্মগত হৃদরোগসহ অনেক জটিল রোগ বা শারীরিক অবস্থা আগেই ডায়াগনোসিস হয়ে যায়। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পর স্থিতিশীল শারীরিক অবস্থায় গর্ভধারণ মা ও শিশুর জীবন বিপন্ন হওয়া থেকে রক্ষা করে। এছাড়া প্রয়োজনীয় পরামর্শ এই সময়ে ভবিষ্যৎ মাকে মানসিক প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করে।

গর্ভকালীন সেবা : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন গর্ভবতী মহিলার গর্ভাবস্থায় অন্তত চারবার গর্ভকালীন সেবা নিতে হবে। এই সেবার মধ্যে রয়েছে প্রসূতির শারীরিক পরীক্ষা, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা, প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান ও চিকিৎসাসেবা প্রদান, ঝুঁকিপূর্ণ মায়েদের চিহ্নিত করা ও সেবা প্রদান, প্রসূতি ও প্রসূতির পরিবারের সদস্যদের ভবিষ্যৎ প্রসবের প্রকৃতি, সময় ও স্থান নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গর্ভকালীন অন্তত একবার সেবাগ্রহীতার হার ২০১১ সালে ছিল ৬৮ শতাংশ। ২০১৭–২০১৮ সালে এ হার ৯২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০১১ সালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবা দানকারী থেকে সেবা গ্রহণের হার ছিল ৫৫ শতাংশ, যা ২০১৭–২০১৮ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ৮২ শতাংশ হয়েছে।

গর্ভকালীন সেবার হার শত ভাগে উন্নীত করা গেলে মাতৃ মৃত্যুর হার আরো কমে আসবে বলে জানান অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক মাতৃ মৃত্যু। একটি দেশের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি কতটা ভালো তার একটি মৌলিক সূচক মাতৃ মৃত্যুর হার। ভারত ও পাকিস্থানের তুলনায় বাংলাদেশ এই সূচকের বিচারে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছে। কিন্তু তা এসডিজির নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে এখনো পিছিয়ে।

প্রসবকালীন সেবা : প্রসূতি মায়েরা সন্তান জন্মদানের জন্য নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা গ্রহণ করলেই কেবল প্রসবকালীন সেবা নিশ্চিত করা যাবে বলে জানান চিকিৎসকরা। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, অধিকাংশ মায়ের মৃত্যু ঘটে কোনো চিকিৎসক বা দক্ষ ধাত্রী ছাড়া বাড়িতে প্রসবের কারণে।

ওজিএসবি চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি অধ্যাপক ডা. কামরুন্নেছা রুনা বলেন, প্রসবকালীন রক্তপাতের ঘটনায় অনেক প্রসূতি মায়ের অকাল মৃত্যু হয়। এটিকে চিকিৎসা ভাষায় একলেম্পশিয়া বলা হয়। এই রক্তপাত বন্ধ করা গেলে মাতৃ মৃত্যুর হার আরো কমে আসবে। প্রসবজনিত রক্তপাত বা একলেম্পশিয়ার চিকিৎসা সমন্বিতভাবে (বান্ডেল অ্যাপ্রোচ) করা গেলে মাতৃ মৃত্যু কমানো সম্ভব। সমন্বিতভাবে এর চিকিৎসাই ওজিএসবির বর্তমান লক্ষ্য।

প্রসব পরবর্তী সেবা : একজন মায়ের প্রসব পরবর্তী সেবাও গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে অধ্যাপক ডা. কামরুন্নেছা রুনা বলেন, প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়ের নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে প্রসব পরবর্তী ৬ সপ্তাহ সময়কালে রক্তক্ষরণ, জরায়ুতে সংক্রমণের মতো জটিলতাগুলো প্রসূতি মাকে মৃত্যুঝুঁকিতে ঠেলে দেয়। এছাড়া মূত্রাশয়, শ্বাসনালীর সংক্রমণ, রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধা, মানসিক বিষণ্নতা ইত্যাদি জটিলতাও দেখা দিতে পারে। তাই প্রসব পরবর্তী সেবাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

মায়ের সুস্থতার জন্য এই সময়কালে পুষ্টিকর খাবার, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পরিমিত ঘুম ও উষ্ণ মানসিক সাহচর্য জরুরি বলে মনে করেন চমেক হাসপাতালের গাইনী বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার। তিনি বলেন, দেশের স্বার্থে, অনাগত সন্তানের সুস্বাস্থ্যের জন্য, উন্নয়নের মাইলফলকে নিজেদের দৃঢ় অবস্থানের জন্য নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। কারণ, সুস্থ মা–ই শুধু পারেন একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে।