নোয়া এলুমিনিয়াম ফ্যাক্টরীর বিষাক্ত ধোয়ায় ভোগান্তিতে শিশু শিক্ষার্থীরাসহ এলাকাবাসী

- আপডেট টাইম : ১২:৫৪:৫৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ মার্চ ২০২৩
- / ১৮৮ ৫০০০.০ বার পাঠক
চিমনিবিহীন চলছে শিল্প ফ্যাক্টরীর বয়লার। দিনরাত অবিরাম গলানো হচ্ছে ধাতব পদার্থ। এতে এই কাজে ব্যবহৃত রাসায়নিক মিশ্রিত বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। পরিবেশের জন্য চরম অনিরাপদ জেনেও দেদারছে করা হচ্ছে এই ঝু্ঁকিপূর্ণ কাজ।
ফলে বিষাক্ত দূষণে ভোগান্তিতে পড়েছে ফ্যাক্টরী সংলগ্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিশু শিক্ষার্থীরাসহ এলাকাবাসী। বার বার বলা সত্বেও কর্ণপাত করেনি ফ্যাক্টরী কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘ দুই বছর ধরে এমন অস্বাস্থ্যকর অবস্থা বিরাজ করলেও নির্বিকার স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর।
এমন দূর্ভোগ পোহাচ্ছে নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল সংলগ্ন এলাকাবাসী। এখানে নিয়ামতপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেষে স্থাপন করা হয়েছে রয়েলেক্স মেটাল ইন্ডাস্ট্রি (নোয়া কোম্পানি) নামে এলুমিনিয়াম ফ্যাক্টরী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশেই এবং আবাসিক এলাকায় এমন ফ্যাক্টরী প্রতিষ্ঠায় চরম দূষণ ঘটছে।
কারণ ফ্যাক্টরীর ধাতব পদার্থ গলানোর বয়লারটির অবস্থান বিদ্যালয়ের ছোট্ট মাঠের সাথেই এবং বয়লার রুমের জানালাও মাঠের দিকে। সেই সাথে ধোয়া ও বিষাক্ত বর্জ্য নির্গমনের জন্য নেই নিরাপদ দৈর্ঘ্যের চিমনী। তাই বয়লার চালু করলেই জানালা দিয়ে কালো ধোঁয়া বের হয়ে ছেয়ে যায় চারপাশ।
এই ধোঁয়ায় রাসায়নিকের ঝাঁঝাল গন্ধ খুবই উৎকট। যা চোখে ও নাকে জ্বালা সৃষ্টি করে। সেইসাথে রয়েছে ধাতব ছাই। আশেপাশের প্রতিটি বাসা, দোকানের চাল বা ছাদ এবং গাছের পাতা ও ডাল এই ছাইয়ের এক থেকে দুই ইঞ্চি আস্তরণে ঢেকে কালো হয়ে গেছে।
ইতোপূর্বে এলাকাবাসীর প্রতিবাদের মুখে একটা চিমনী লাগায়। তাতে কিছুটা রেহাই মিললেও গত দুই বছর আগে চিমনিটা ভেঙে গেলেও ঠিক করার কোন উদ্যোগ নাই। তার উপর চিমনি ছাড়াই খোলা বয়লারেই চলছে ধাতব গলানোর লাগাতার কাজ। ফলে চরম দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, মসজিদের মুসল্লী, দোকানদারসহ সহস্রাধিক এলাকাবাসী।
নিয়ামতপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র আসাদুজ্জামান বাবু বলে, ধোঁয়ার কারণে ক্লাস করা অনেক কষ্টকর। চোখ জ্বলে, শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়। মাঝে মাঝে ধোঁয়া বেশি হলে স্কুল থেকে চলে যেতে বাধ্য হই।
একইভাবে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী রাফিয়াতুজ্জোহরা বলে, প্রায়ই বিষাক্ত ধোঁয়ায় ঢেকে যায় পুরো স্কুল চত্বর। তখন ক্লাসে থাকা দুষ্কর হয়ে পড়ে। আমরা সবাই অনেক সমস্যায় আছি। স্কুলের সাথে সিলভার কারখানাটা সরানো দরকার। নয়তো ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকরা চরম দূর্ভোগে পড়বে।
কামরুন্নেসা ঝিনুক নামে তৃতীয় শ্রেণীর আরেক ছাত্রী বলে, ক্লাস করার সময় জানালা দিয়ে অনেক ধোঁয়া ঢুকে। এতে শ্বাস নেয়া যায়না এবং চোখে জ্বালা করে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা বেশী ভুক্তভোগী। তাদের ক্লাস রুম ফ্যাক্টরীর পাশেই থাকায় সবচেয়ে কষ্ট হয়।
সহকারী শিক্ষিকা মঞ্জুয়ারা চৌধুরী বলেন, আমরা বছরের পর বছর ধরে কষ্ট করছি, অত্যাচারিত হচ্ছি। ফ্যাক্টরী মালিক রাজ কুমার পোদ্দার একজন শিল্পপতি। আমাদের অসুবিধার কথা জানাতে তাঁর সাথে দেখা করতে চাইলেও তিনি কখনই এতটুকু সৌজন্যতা দেখাননি।
কয়েকবছর আগে আব্দুল্লাহ নামে তৃতীয় শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর চোখে ফ্যাক্টরীর ধাতব ধুলা বা ছাই পড়ে গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাকে নিয়ে চরম আতঙ্কে পড়ে গেছিলাম।
ম্যানেজারের মাধ্যমে জানার পরও তিনি সামান্য মানবতা দেখিয়ে একবারের জন্যও স্কুলে এসে সহমর্মিতা জানাননি। এমনকি ম্যানেজার বা অন্য কাউকেও পাঠাননি। তারা জেনে বুঝেই এমন আইন ও মানবতা বিরোধী কাজ করছেন। শিক্ষা অফিসসহ স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর জেনেও নিশ্চুপ।
প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) চিত্ত রঞ্জন রায় পঙ্কজ বলেন, প্রতিনিয়ত কারখানায় ধোঁয়ায় আমরা দূর্ভোগ পোহাচ্ছি। কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের নিয়ে আতঙ্কে থাকি। কখন যে কে অসুস্থ হয়ে পড়ে। অনেক অভিভাবক অভিযোগ দেয়। বার বার বলা সত্বেও রয়েলেক্স মেটাল ইন্ডাস্ট্রি মালিক কোন ভ্রুক্ষেপ করছেননা।
নীলফামারী জেলা বাস মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়ন পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলি চাইন্ড স্কুলের প্রধান শিক্ষক শাহিদ রেজা বলেন, আগে প্রচুর অসুবিধা হতো। চিমনি লাগানোর পর ধোঁয়া বা ছাই তেমন একটা না আসলেও সীসার গন্ধ বেশ সমস্যায় ফেলে। এখন আবার বেড়েছে। কর্তৃপক্ষের প্রতি বিষয়টা দেখার আহ্বান জানাচ্ছি।
নোয়া ফ্যাক্টরীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাজু কুমার পোদ্দারের সাথে যোগাযোগ করতে মুঠোফোনে বার বার কল দিলেও রিসিভ করেননি। ফ্যাক্টরীতে গেলে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ বলে প্রায় এক ঘন্টা গেটে দাঁড় করিয়ে রাখে সাংবাদিকদের। পরে ভিতরে ঢুকতে দিলেও এমডি সাক্ষাত করেনি।
ম্যানেজার (অপারেশন) আনোয়ার হোসেন মামুন উম্মুক্ত বয়লারে ধাতব পদার্থ গলানোয় ছাই, ধোঁয়া ও বিষাক্ত গন্ধে সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, আমাদের মিস্ত্রি একজনের বিয়ে আর অপরজন অসুস্থ থাকায় চিমনি মেরামতে বিলম্ব হচ্ছে। এখন দ্রুত ঠিক করা হবে।
চিমনিহীন অবস্থায় কি বয়লারের কাজ বন্ধ রাখা যেতনা? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এতে কোম্পানির অনেক ক্ষতি হবে। তাই চালাতে বাধ্য হয়েছি। আপনাদের কাছে মানুষ ও পরিবেশের ক্ষতির চেয়ে কি মুনাফাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ? এমন প্রশ্নে নিরব হয়ে যান তিনি এবং দ্রুত সটকে পড়েন।
সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফয়সাল রায়হান বলেন, লিখিত কোন অভিযোগ পাইনি। তবে বিষয়টা দেখছি। তাদেরকে নোটিশ দিবো এবং প্রয়োজনে পরিদর্শন করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পরিবেশ অধিদফতর নীলফামারী কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক কমল কুমার বর্মণ মুঠোফোনে বলেন, এসংক্রান্ত অভিযোগ পেয়েছি। গত ২৮ ফেব্রুয়ারী নোটিশ দিয়েছি। সাত কর্মদিবসের মধ্যে জবাব চাওয়া হয়েছে। চিমনি না লাগানো পর্যন্ত বন্ধ রাখতেও বলা হয়েছে। তবুও যদি খোলা অবস্থায় বয়লার চালু থাকে তাহলে সরেজমিন তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রয়েলেক্স মেটাল ইন্ডাস্ট্রির পরিবেশের ছাড়পত্র নেয়া আছে। তবে তা নবায়ন করা নেই। আমি এখানে নতুন এসেছি তাই এব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আর স্কুলের পাশে আবাসিক এলাকায় এমন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন কতটুকু বৈধ এবং কিভাবে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে তা আমি বলতে পারবোনা। এটা তৎকালীন দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তার বিষয়।