মান্দায় ঋণ নিয়ে শুরু, এখন বাজারের সবচেয়ে বড় দোকানের মালিক
- আপডেট টাইম : ০২:৩০:৩৯ অপরাহ্ণ, বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারি ২০২২
- / ২৮১ ৫০০০.০ বার পাঠক
নওগাঁ প্রতিনিধি।
অদম্য সাহস আর ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন হার না মানা এক সাহসী উদ্যোক্তা সাবরি খাতুন। পাঁচ বছর আগে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন এ উদ্যোক্তা। বর্তমানে তার দোকানে প্রায় ১০ লাখ টাকার মালামাল রয়েছে।
সাবরি খাতুনের বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামে। তবে পরিবারসহ ভাড়া থাকেন সতিহাট বাজারের পাশে।
ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার নানা জটিলতায় তরুণ উদ্যোক্তারা ঋণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন। এ কারণে তারা উচ্চ সুদে বেসরকারি সংস্থাগুলো থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন। যদি সহজ শর্তে বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ দেওয়া হতো তাহলে তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টি হতো বলে মনে করেন সাবরি খাতুন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার আমনুরা গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে সাবরি খাতুন। চার বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি পাঁচ নম্বর। ২০০২ সালে শ্রীরামপুর গ্রামের শাহজাহান আলী মন্ডলের সঙ্গে বিয়ে হয়। তখন বয়স প্রায় ১১ বছর।
স্বামী বেকারি ফ্যাক্টরির শ্রমিকের কাজ করতেন। স্বামীর পরিবার দরিদ্র ও জায়গা স্বল্পতার কারণে বিয়ের পর থেকেই সতিহাট বাজারের পাশে ভাড়া থাকতেন। তখন স্বামীর আয় ছিল মাত্র ১২০০ টাকা। যা দিয়ে সংসার ঠিকমতো চলতো না। এ নিয়ে প্রায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকতো।
স্বামী ও সংসারে সহযোগিতা করতে ২০০৬ সাল থেকে নকশি কাঁথার ওপর আর্ট (হ্যান্ড প্রিন্ট) করার কাজ শুরু করেন। প্রতি কাঁথার জন্য পেতেন ১৫০ টাকা। প্রতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না পেলেও বাবার বাড়িতে শিখেছিলেন। এ কাজ করে বেশ ভালো আয় করা শুরু করেন। কিন্তু বিভিন্ন মানুষ আসার-যাওয়ার কারণে স্বামী বিরক্ত বোধ করতেন। স্বামী অনেকবার বলেছেন এসব কাজ বন্ধ করার জন্য।
এরই মাঝে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। প্রতিবেশীরা বলতো সন্তান হলে কলোহ থেমে যাবে। কিন্তু সন্তান নিতে নারাজ স্বামী। এক সময় স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দূরত্ব তৈরি হয়। অবশেষে ২০১৬ সালে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
এরপর দুই মেয়েকে নিয়ে সাবরি খাতুন সতিহাটের পাশেই ভাড়া বাসায় থাকতে লাগলেন। মেয়েদেরও খোঁজ নিতেন না সাবেক স্বামী। এরই মাঝে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সালে এসএসসি পাস করেন সাবরি। বড় মেয়ে মুসকান এবার দশম শ্রেণিতে এবং ছোট মেয়ে মীম তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে।
বর্তমানে সতিহাট বাজারে সবচেয়ে বড় দোকান সাবরি খাতুনের ‘মুসকান নকশি কাঁথা ঘর’। যে দোকানে বিভিন্ন ধরনের সুতা, বোতাম ও সিট-কাপড় পাওয়া যায়।
সংগ্রামী উদ্যোক্তা সাবরি খাতুন বলেন, ২০১৭ সালে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিই। ওই টাকা থেকে একটা সেলাই মেশিন, কিছু নকশি কাঁথার ফর্মা, সুতা, বুতাম ও সাংসারিক জিনিসপত্র কেনা হয়। এরপর নকশি কাঁথা নিজেই তৈরি শুরু করলাম। একই বছর উপজেলায় যুব উন্নয়নে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করলাম। সেখানে ছিলাম ছয় মাস। প্রতিমাসে চার হাজার টাকা পেতাম। সেখানে সময় বেশি দিতে হতো, সে তুলনায় পারিশ্রমিক পেতাম না। এজন্য সেখানে কাজটা ছেড়ে দিই।
যেহেতু এলাকায় দীর্ঘদিন থেকে আছি, পরিচিত থাকায় নকশি কাঁথার কাজ আশপাশের নারীদের দিতাম। কাজ করে নিতে খুব একটা সমস্যা হতো না। কাঁথার চাহিদা বাড়তে থাকায় কাজও বাড়তে থাকে। নিজেই বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে কারিগরদের কাজ দিয়ে আসি এবং কাজ শেষ হলে নিয়ে আসি।
২০১৯ সালে একটা দোকান দিই এবং দোকান সংলগ্ন বাসা ভাড়া নিই। দোকানের নাম দিই বড় মেয়ের নামে। দোকানে ১৮ জন বিভিন্ন বয়সী নারী নকশি কাঁথার কারিগর রয়েছে। এছাড়া ২০২০ সালে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ১ লাখ টাকা ঋণ দেয়।
স্বপ্নের নকশি কাঁথার বিষয়ে তিনি বলেন, নকশি কাঁথা মজুরি সর্বনিম্ন ৭০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪৫০০ টাকা। সাধারণত ছক আঁকা কাঁথা তৈরি করতে সময় লাগে ১০-১৫ দিন। যা বিক্রি হয় ১৮০০-২০০০ টাকায়। লাভ থাকে ৩০০-৫০০ টাকা। এ কাঁথার চাহিদা বেশি। মাসে ৩০-৩৫টা বিক্রি হয়। আর ৪৫০০ টাকা মজুরির কাঁথা তৈরি করতে সময় লাগে প্রায় তিনমাস। যা ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। যেখানে লাভ থাকে ১৫০০-২০০০ টাকা। এ কাঁথার চাহিদা কম।
ঢাকা ও কক্সবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা যোগাযোগ করে এসব কাঁথা নেয়। তারা কাজ শুরুর আগে কিছু টাকা দেয় আর কাজ শেষে পুরো টাকা পরিশোধ করে। কাঁথার কাজ শেষে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে তাদের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিই।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে নকশি কাঁথার বড় একটা কারখানা করার। এছাড়া মেয়েদের পড়াশুনা করিয়ে তাদের কর্মসংস্থান তৈরি করার।
তিনি বলেন, নকশি কাঁথা, ওয়ান পিস, গলার কুরুশের কাজ, বিভিন্ন রঙের সুতা বিক্রি ও টেইলার্সের কাজ করা হয় আমার এখানে। যেখানে মাসে দেড় থেকে দুই লাখ টাকার মতো বিক্রি হয়। সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে আয় হয় ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। দোকানে ছয়টি অটো সেলাই মেশিন রয়েছে। দুইজন নারী শ্রমিক কমিশন ভিত্তিতে কাজ করে। যারা দিনে ২৫০-৩০০ টাকা আয় করে। বর্তমানে দোকানে প্রায় ১০ লাখ টাকার মালামাল আছে।
তবে তিক্ত অভিজ্ঞতাও আছে তার। জানালেন, নকশি কাঁথা ভালো সেল হওয়ায় কক্সবাজার থেকে ব্যবসায়ীরা যোগযোগ করে। লেনদেন বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে কক্সবাজারে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা আটকে আছে। দিচ্ছি দেবো বলে সময় পার করছেন ব্যবসায়ী। ওই লোকসান এখনো পুশিয়ে নিতে পারিনি।
তিনি বলেন, লক্ষ্যে পৌঁছানোর বড় সমস্যা ব্যাংক থেকে ঋণ না পাওয়া। ব্যাংকে বন্ধক রাখার মতো একমাত্র দোকান ছাড়া কোনো কিছুই আমার নেই। বর্তমানে বেসরকারি সংস্থার কাছে ২ লাখ টাকা ঋণের মধ্যে আছি।
নওগাঁ ব্যাংক ঋণ বিতরণ কমিটির সদস্য সচিব ও জনতা ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপক আশরাফুল আলম বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলো কোনো জামানত ছাড়াই ক্ষুদ্র ঋণ দেয়। তবে জামানত ছাড়া ঋণ বিতরণে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে আলাদা নীতিমালা থাকতে পারে যা আমার জানা নেই।