ঢাকা ০৯:২৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
সংবাদ শিরোনাম ::
গরু বহনকারী ভটভটির ধাক্কায় প্রাণ হারালো  দুই যুবক ইবিতে ভর্তি পরীক্ষার্থীদের জন্য থাকছে না কোন পরিবহন সেবা নবাবগঞ্জ প্রেসক্লাবের সকল সাংবাদিকের সঙ্গে ওসির সৌজন্য সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় পাকুন্দিয়া উপজেলায় ৪ মামলার পরোয়ানাভূক্ত পলাতক আসামী গ্রেফতার রাণীশংকৈলে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা কোনাবাড়ি পল্লী বিদ্যুৎ পাওয়ার সাবস্টেশনে আগুন তামাক হচ্ছে মাদকের মূল লক্ষ্য -ডাঃ মোঃ নজরুল ইসলাম কিরাটন ইউনিয়নের পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম আমাদের মাঝে আর নেই শিবগঞ্জে সানামসজিদ স্থলবন্দরে হিট স্ট্রোকে ট্রাফিক পরিদর্শকের মৃত্যু গাজীপুরবাসীর জন্য চরম “সৌভাগ্য’ বর্তমান ডিসি এডিসি রেভিনিউ চৌকস ও মেধাবী দুই কর্মকর্তার চিন্তা,চেতনায় কর্মে, সর্বোপরিভাবে সততাকে প্রাধাণ্য দিয়েই দায়িত্ব পালন করছেন

অভিমত ॥ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮পাস করেছে

  • সময়ের কন্ঠ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : ১১:৫৩:৪৭ পূর্বাহ্ণ, শনিবার, ৯ জানুয়ারি ২০২১
  • ২৩৩ ০.০০০ বার পাঠক

সম্পাদকীয় রিপোর্টের।।

২০১৮ সালে প্রণীত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন জাতীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত হওয়ার আগে মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত মামলা ও এতদসংক্রান্ত বিষয়াবলী পরিচালনার জন্য ১৯৯০ সালে প্রণীত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর ছিল। এর আগে অনুরূপ বিষয়াবলী Opium Act, 1857 (Act XIII of 1857), Opium Act, 1878 (Act I of 1878), Excise Act, 1909 (Act V of 1909), Dangerous Drugs Act, 1930 (Act II of 1930) Ges Opium Smoking Act 1932 (Act X of 1932) দ্বারা পরিচালিত হতো। যুগের প্রয়োজনে ওই সমস্ত আইন নতুনভাবে সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু সব আইন সংশোধন করা হলে উক্ত বিষয় সংক্রান্ত মামলা মোকদ্দমা পরিচালনাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে জটিলতা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকায় বিষয়টি কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় গ্রহণ করে সব আইন বাতিলক্রমে তার ফলে নতুন করে পূর্ণাঙ্গ একটি আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ফলে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ক্ষমতাবলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ, ১৯৮৯ (অধ্যাদেশ নং-১৯, ১৯৮৯) জারি করেন। পরবর্তীতে জাতীয় সংসদ কর্তৃক উক্ত অধ্যাদেশটি গৃহীত হয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০ নামে আইনে পরিণত হয়। ওই আইনে মোট ৫৬টি ধারা ছিল। ১৯৯০ সালে প্রণীত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন (১৯৯০ সালের ২০নং আইন) যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ২০০০, ২০০২ এবং ২০০৪ সালে তা সংশোধন করা হয়। কিন্তু তদসত্ত্বে¡ও তা ক্রমবর্ধান মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত অপরাধ প্রতিরোধে আশানুরূপ ফল প্রদানে সক্ষম না হওয়ায় নতুন করে একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে বিগত ২৭/১০/২০১৮ খ্রিঃ তারিখে মহান জাতীয় সংসদে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮’ পাস হয়। আইনটি পাস হওয়ার পূর্বে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০ মতে অর্থাৎ বিগত ইং১২/০৪/২০১০ তারিখে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আইনে ২৭টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (আদিবাসী) শ্রেণীর/জাতিসত্তার নাম উল্লেখ করে বাংলাদেশ সরকার গেজেটের মাধ্যমে প্রকাশ করলে দেশের আদিবাসী জনগণ তা ভুল তালিকা বলে দুঃখ প্রকাশ করে প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে সরকারী তালিকা হতে বাদ পড়া আদিবাসী জনগণ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আইনের বিধান মতে তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবিতে দেশের প্রতিটি জেলায় সমাবেশ, সভা, আলোচনা সভা, সেমিনার, মানব বন্ধন, সরকার বরাবর স্মারকলিপি প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে আন্দোলন করতে থাকে। উক্ত তালিকা হতে বাদ পড়া আদিবাসীদের নাম অন্তর্ভুক্তির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আইনে’ অবশিষ্ট/ বাকিদের অন্তর্ভুক্ত করার নিমিত্তে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় হতে প্রতিটি জেলায় জেলায় অর্থাৎ প্রত্যেকে জেলার (ডিসি) জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কাছে গেজেট তালিকাভুক্ত হতে বাদ পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতির/শ্রেণীর নামের তালিকা চেয়ে পত্র প্রেরণ করেন।

উক্ত নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) মহোদয়গণ তদন্ত অনুসন্ধান করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতির/ শ্রেণীর নামের তালিকা তৈরি সম্পন্ন করে উর্ধতন কর্তৃপক্ষ বরাবর অর্থাৎ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পত্রের উত্তর পাঠিয়ে দেন। দেশের সমগ্র জেলা প্রশাসক (ডিসি) মহোদয়গণের পাঠানো উক্ত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (আদিবাসী) জাতির নামের তালিকা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় প্রাপ্ত হলে দৈনিক জাতীয় পত্রিকা ‘দৈনিক প্রথম আলোর মাধ্যমে ইং২৬/১০/১২ তারিখ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জাতির/ শ্রেণীর সংখ্যা ২২৮টি বলে জানা যায়। এখন দেখা যাচ্ছে যে, পূর্বের অর্থাৎ ইং১২/০৪/১০ তারিখের তালিকায় আদিবাসীদের সংখ্যা ২৭টি উল্লেখ করা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে ইং২৬/১০/১২ তারিখের পরবর্তীতে তালিকায় আদিবাসীদের সংখ্যা ২২৮টি উল্লেখ করা হয়। তাহলে এখন সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭+২২৮=২৫৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতি। অনেকেই বলতে পারেন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০ সংস্কৃতি রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। তাই আমরা শুধু এখানে সংখ্যাটি গ্রহণ করলাম।পরবর্তীতে ৫০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী গেজেটভুক্ত হয়।

বাংলাদেশে ২৫৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতির মানুষেরা সমগ্র জেলাতেই বসবাস করে থাকেন। তারা ঐতিহ্যগতভাবেই তাড়ি বা হাঁড়িয়া ও পঁচুই সেবন করে থাকেন। এটি মূলত ব্রিটিশ আমল থেকেই শুরু হয়। বর্তমানেও এর প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশের উপজাতীয় ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণ প্রথাগতভাবে লোকায়ত ও দেশজ সনাতন পদ্ধতিতে কোন আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া ঘরোয়া উপকরণ ও সরঞ্জামাদি সহকারে খুব ছোট পরিসরে চোলাই মদ উৎপাদন করে থাকে। আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জনগণ সারাদিন পরিশ্রমের পর সন্ধায় উক্ত মাদক সেবন করে। তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা পার্বণে এখনও সকল ঐতিহ্য দেখা যায়। যেমন-বিবাহ অনুষ্ঠানে, পূজা-পার্বণে, উৎসব, নবান্ন ইত্যাদিতে। এর ফলে বাংলাদেশ সরকার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ সর্বশেষ সংশোধনপূর্বক তৈরি করে। এ আইনের ১১ ধারায় বলা আছে, এ্যালকোহল পান, ইত্যাদি সম্পর্কে বিধি নিষেধ। আইনটি নিম্নে তুলে ধরা হলো

এ্যালকোহল পান, ইত্যাদি

সম্পর্কে বিধি-নিষেধ

২০১৮ সারে প্রণীত আইনের ১১(১) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, পারমিট ব্যতীত কোন ব্যক্তি এ্যালকোহল পান করতে পারবেন না এবং চিকিৎসার প্রয়োজনে সিভিল সার্জন অথবা সরকারী মেডিক্যাল কলেজের অন্যূন কোন সহযোগী অধ্যাপকের লিখিত ব্যবস্থাপত্র ব্যতীত কোন মুসলমানকে এ্যালকোহল পান করার জন্য পারমিট প্রদান করা যাবে না।

(২) উপধারায় বর্ণনা অনুসারে মুচি, মেথর, ডোম, চা-শ্রমিক ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কর্তৃক তাড়ি ও পঁচুই পান করার ক্ষেত্রে এবং রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাসমূহ এবং অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কর্তৃক ঐতিহ্যগতভাবে প্রচলিত অথবা প্রস্তুতকৃত মদ পান করার ক্ষেত্রে উপ-ধারা (১)-এর কোন কিছুই প্রযোজ্য হবে না।

(৩) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, (১) এ যা কিছুই থাকুক না কেন-

(ক) লাইসেন্সপ্রাপ্ত বার-এ বসে বিদেশী ও পারমিটধারী দেশীয় নাগরিকগণ এ্যালকোহল পান করতে পারবেন এবং

(খ) কূটনৈতিক পাসপোর্টধারী বিদেশী নাগরিকরা শুল্ক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত পাসবইধারী অথবা প্রচলিত ব্যাগেজ রুলসের দ্বারা স্বীকৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে, এ্যালকোহল আমদানি, রফতানি, ক্রয়, বহন, সংরক্ষণ অথবা পানের ব্যাপারে কোন কিছুই প্রযোজ্য হবে না।

(৪) উপ-ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, এ্যালকোহল সংক্রান্ত সকল শুল্কমুক্ত কার্যক্রম (Duty Free Operations) এই আইনের অধীন প্রদত্ত লাইসেন্স বলে সম্পাদিত হবে।

১১(১) ধারার বিধান মোতাবেক কোন মুসলমান ওই ধারায় বর্ণিত মতে পারমিট ব্যতীত এ্যালকোহল পান করতে পারবেন না। তবে ১১(৩) ধারায় বর্ণিত বিদেশী মুসলমান উক্ত নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়বে না। সেক্ষেত্রে তাকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত বার-এ তা পান করতে হবে।

উপরোক্ত আইনের বিধান পর্যালোচনায় দেখা যায়, মুচি, মেথর, ডোম, চা-শ্রমিক ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কর্তৃক তাড়ি ও পঁচুই পান করবার ক্ষেত্রে এবং রাঙ্গামাটি, বান্দরবন ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাসমূহ এবং অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কর্তৃক ঐতিহ্যগতভাবে প্রচলিত বা প্রস্তুতকৃত মদ পান বা সেবন করতে পারবেন।

মতামত ॥ মাদকদ্রব্য অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার মানব জাতির জন্য এক ভয়াবহ অভিশাপ। মাদক সমস্যা পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ড ছাড়িয়ে আর্ন্তজাতিকরূপ পরিগ্রহ করেছে। মাদকাসক্তি সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের সর্বত্র এবং সৃষ্টি করেছে ভয়াবহ সমস্যা। মাদকাসক্তি একটি সভ্য সমাজকে নিয়ে যেতে পারে মহাবিপর্যয়ের মুখে; নিয়ে যেতে পারে চরম ধ্বংসের অতলে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশও মাদকের মরণ ছোবল থেকে অব্যাহতি পায়নি। মাদকের অবৈধ পাচার এবং অপব্যবহারের ফলে দেশের অনেক তরুণ ও যুবক বিপথগামী হচ্ছে এবং সৃজনশীল কর্মপ্রয়াসের স্থলে ছিনতাই, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, চুরি ও ডাকাতিসহ বিভিন্ন অনৈতিক অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে, আইনশৃঙ্খলার অবনতিসহ অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। এ অবস্থায় মাদকের ভয়াবহ ছোবল থেকে যুব ও তরুণ সমাজকে বাঁচতে হলে আমাদের সম্মিলিত প্রতিরোধের বিকল্প পথ নেই। তাই মাদকসংক্রান্ত আনুষঙ্গিক বিষয়াবলী সম্পর্কে জানা এবং মাদকাসক্তি প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব।

তবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জনগণ বিদেশী মাদক, ফেনসিডিল, ইয়াবা, হিরোইন, কোকেন থেকে বহুদূরে অবস্থান করছেন। তারা ক্ষতিকর মাদকদ্রব্য ব্যবহার করেন না এবং অলস জীবনযাপন করেন না এবং সকলেই পরিশ্রমী। তারা মূলত প্রথাগত ও ঐতিহ্যগতভাবে বাড়িতে চোলাই মদ ও তালগাছের রস বা তাড়ি বা হাঁড়িয়া পানে অভ্যস্ত। তাদের নিজস্ব তৈরিকৃত মাদকদ্রব্য দ্বারা কখনও সমাজের নতুন প্রজন্ম বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সার্বিক বিশ্লেষণ করেই সরকার ১১ ধারা প্রণয়ন করে আইনগত জটিলতা থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ২৫৫টি জাতিকে মুক্ত বা রেহাই করে দিয়েছে। অর্থাৎ ২৫৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮-এর বিধান মতে চোলাই মদ, তাল গাছের রস বা তাড়ি বা হাঁড়িয়া পান করতে আইনত নিষেধ নেই।

লেখক : সভাপতি, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, জয়পুরহাট জেলা ও এ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট

আরো খবর.......

জনপ্রিয় সংবাদ

গরু বহনকারী ভটভটির ধাক্কায় প্রাণ হারালো  দুই যুবক

অভিমত ॥ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮পাস করেছে

আপডেট টাইম : ১১:৫৩:৪৭ পূর্বাহ্ণ, শনিবার, ৯ জানুয়ারি ২০২১

সম্পাদকীয় রিপোর্টের।।

২০১৮ সালে প্রণীত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন জাতীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত হওয়ার আগে মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত মামলা ও এতদসংক্রান্ত বিষয়াবলী পরিচালনার জন্য ১৯৯০ সালে প্রণীত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর ছিল। এর আগে অনুরূপ বিষয়াবলী Opium Act, 1857 (Act XIII of 1857), Opium Act, 1878 (Act I of 1878), Excise Act, 1909 (Act V of 1909), Dangerous Drugs Act, 1930 (Act II of 1930) Ges Opium Smoking Act 1932 (Act X of 1932) দ্বারা পরিচালিত হতো। যুগের প্রয়োজনে ওই সমস্ত আইন নতুনভাবে সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু সব আইন সংশোধন করা হলে উক্ত বিষয় সংক্রান্ত মামলা মোকদ্দমা পরিচালনাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে জটিলতা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকায় বিষয়টি কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় গ্রহণ করে সব আইন বাতিলক্রমে তার ফলে নতুন করে পূর্ণাঙ্গ একটি আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ফলে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ক্ষমতাবলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ, ১৯৮৯ (অধ্যাদেশ নং-১৯, ১৯৮৯) জারি করেন। পরবর্তীতে জাতীয় সংসদ কর্তৃক উক্ত অধ্যাদেশটি গৃহীত হয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০ নামে আইনে পরিণত হয়। ওই আইনে মোট ৫৬টি ধারা ছিল। ১৯৯০ সালে প্রণীত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন (১৯৯০ সালের ২০নং আইন) যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ২০০০, ২০০২ এবং ২০০৪ সালে তা সংশোধন করা হয়। কিন্তু তদসত্ত্বে¡ও তা ক্রমবর্ধান মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত অপরাধ প্রতিরোধে আশানুরূপ ফল প্রদানে সক্ষম না হওয়ায় নতুন করে একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে বিগত ২৭/১০/২০১৮ খ্রিঃ তারিখে মহান জাতীয় সংসদে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮’ পাস হয়। আইনটি পাস হওয়ার পূর্বে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০ মতে অর্থাৎ বিগত ইং১২/০৪/২০১০ তারিখে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আইনে ২৭টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (আদিবাসী) শ্রেণীর/জাতিসত্তার নাম উল্লেখ করে বাংলাদেশ সরকার গেজেটের মাধ্যমে প্রকাশ করলে দেশের আদিবাসী জনগণ তা ভুল তালিকা বলে দুঃখ প্রকাশ করে প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে সরকারী তালিকা হতে বাদ পড়া আদিবাসী জনগণ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আইনের বিধান মতে তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবিতে দেশের প্রতিটি জেলায় সমাবেশ, সভা, আলোচনা সভা, সেমিনার, মানব বন্ধন, সরকার বরাবর স্মারকলিপি প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে আন্দোলন করতে থাকে। উক্ত তালিকা হতে বাদ পড়া আদিবাসীদের নাম অন্তর্ভুক্তির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আইনে’ অবশিষ্ট/ বাকিদের অন্তর্ভুক্ত করার নিমিত্তে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় হতে প্রতিটি জেলায় জেলায় অর্থাৎ প্রত্যেকে জেলার (ডিসি) জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কাছে গেজেট তালিকাভুক্ত হতে বাদ পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতির/শ্রেণীর নামের তালিকা চেয়ে পত্র প্রেরণ করেন।

উক্ত নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) মহোদয়গণ তদন্ত অনুসন্ধান করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতির/ শ্রেণীর নামের তালিকা তৈরি সম্পন্ন করে উর্ধতন কর্তৃপক্ষ বরাবর অর্থাৎ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পত্রের উত্তর পাঠিয়ে দেন। দেশের সমগ্র জেলা প্রশাসক (ডিসি) মহোদয়গণের পাঠানো উক্ত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (আদিবাসী) জাতির নামের তালিকা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় প্রাপ্ত হলে দৈনিক জাতীয় পত্রিকা ‘দৈনিক প্রথম আলোর মাধ্যমে ইং২৬/১০/১২ তারিখ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জাতির/ শ্রেণীর সংখ্যা ২২৮টি বলে জানা যায়। এখন দেখা যাচ্ছে যে, পূর্বের অর্থাৎ ইং১২/০৪/১০ তারিখের তালিকায় আদিবাসীদের সংখ্যা ২৭টি উল্লেখ করা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে ইং২৬/১০/১২ তারিখের পরবর্তীতে তালিকায় আদিবাসীদের সংখ্যা ২২৮টি উল্লেখ করা হয়। তাহলে এখন সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭+২২৮=২৫৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতি। অনেকেই বলতে পারেন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০ সংস্কৃতি রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। তাই আমরা শুধু এখানে সংখ্যাটি গ্রহণ করলাম।পরবর্তীতে ৫০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী গেজেটভুক্ত হয়।

বাংলাদেশে ২৫৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতির মানুষেরা সমগ্র জেলাতেই বসবাস করে থাকেন। তারা ঐতিহ্যগতভাবেই তাড়ি বা হাঁড়িয়া ও পঁচুই সেবন করে থাকেন। এটি মূলত ব্রিটিশ আমল থেকেই শুরু হয়। বর্তমানেও এর প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশের উপজাতীয় ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণ প্রথাগতভাবে লোকায়ত ও দেশজ সনাতন পদ্ধতিতে কোন আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া ঘরোয়া উপকরণ ও সরঞ্জামাদি সহকারে খুব ছোট পরিসরে চোলাই মদ উৎপাদন করে থাকে। আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জনগণ সারাদিন পরিশ্রমের পর সন্ধায় উক্ত মাদক সেবন করে। তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা পার্বণে এখনও সকল ঐতিহ্য দেখা যায়। যেমন-বিবাহ অনুষ্ঠানে, পূজা-পার্বণে, উৎসব, নবান্ন ইত্যাদিতে। এর ফলে বাংলাদেশ সরকার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ সর্বশেষ সংশোধনপূর্বক তৈরি করে। এ আইনের ১১ ধারায় বলা আছে, এ্যালকোহল পান, ইত্যাদি সম্পর্কে বিধি নিষেধ। আইনটি নিম্নে তুলে ধরা হলো

এ্যালকোহল পান, ইত্যাদি

সম্পর্কে বিধি-নিষেধ

২০১৮ সারে প্রণীত আইনের ১১(১) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, পারমিট ব্যতীত কোন ব্যক্তি এ্যালকোহল পান করতে পারবেন না এবং চিকিৎসার প্রয়োজনে সিভিল সার্জন অথবা সরকারী মেডিক্যাল কলেজের অন্যূন কোন সহযোগী অধ্যাপকের লিখিত ব্যবস্থাপত্র ব্যতীত কোন মুসলমানকে এ্যালকোহল পান করার জন্য পারমিট প্রদান করা যাবে না।

(২) উপধারায় বর্ণনা অনুসারে মুচি, মেথর, ডোম, চা-শ্রমিক ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কর্তৃক তাড়ি ও পঁচুই পান করার ক্ষেত্রে এবং রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাসমূহ এবং অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কর্তৃক ঐতিহ্যগতভাবে প্রচলিত অথবা প্রস্তুতকৃত মদ পান করার ক্ষেত্রে উপ-ধারা (১)-এর কোন কিছুই প্রযোজ্য হবে না।

(৩) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, (১) এ যা কিছুই থাকুক না কেন-

(ক) লাইসেন্সপ্রাপ্ত বার-এ বসে বিদেশী ও পারমিটধারী দেশীয় নাগরিকগণ এ্যালকোহল পান করতে পারবেন এবং

(খ) কূটনৈতিক পাসপোর্টধারী বিদেশী নাগরিকরা শুল্ক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত পাসবইধারী অথবা প্রচলিত ব্যাগেজ রুলসের দ্বারা স্বীকৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে, এ্যালকোহল আমদানি, রফতানি, ক্রয়, বহন, সংরক্ষণ অথবা পানের ব্যাপারে কোন কিছুই প্রযোজ্য হবে না।

(৪) উপ-ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, এ্যালকোহল সংক্রান্ত সকল শুল্কমুক্ত কার্যক্রম (Duty Free Operations) এই আইনের অধীন প্রদত্ত লাইসেন্স বলে সম্পাদিত হবে।

১১(১) ধারার বিধান মোতাবেক কোন মুসলমান ওই ধারায় বর্ণিত মতে পারমিট ব্যতীত এ্যালকোহল পান করতে পারবেন না। তবে ১১(৩) ধারায় বর্ণিত বিদেশী মুসলমান উক্ত নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়বে না। সেক্ষেত্রে তাকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত বার-এ তা পান করতে হবে।

উপরোক্ত আইনের বিধান পর্যালোচনায় দেখা যায়, মুচি, মেথর, ডোম, চা-শ্রমিক ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কর্তৃক তাড়ি ও পঁচুই পান করবার ক্ষেত্রে এবং রাঙ্গামাটি, বান্দরবন ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাসমূহ এবং অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কর্তৃক ঐতিহ্যগতভাবে প্রচলিত বা প্রস্তুতকৃত মদ পান বা সেবন করতে পারবেন।

মতামত ॥ মাদকদ্রব্য অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার মানব জাতির জন্য এক ভয়াবহ অভিশাপ। মাদক সমস্যা পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ড ছাড়িয়ে আর্ন্তজাতিকরূপ পরিগ্রহ করেছে। মাদকাসক্তি সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের সর্বত্র এবং সৃষ্টি করেছে ভয়াবহ সমস্যা। মাদকাসক্তি একটি সভ্য সমাজকে নিয়ে যেতে পারে মহাবিপর্যয়ের মুখে; নিয়ে যেতে পারে চরম ধ্বংসের অতলে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশও মাদকের মরণ ছোবল থেকে অব্যাহতি পায়নি। মাদকের অবৈধ পাচার এবং অপব্যবহারের ফলে দেশের অনেক তরুণ ও যুবক বিপথগামী হচ্ছে এবং সৃজনশীল কর্মপ্রয়াসের স্থলে ছিনতাই, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, চুরি ও ডাকাতিসহ বিভিন্ন অনৈতিক অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে, আইনশৃঙ্খলার অবনতিসহ অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। এ অবস্থায় মাদকের ভয়াবহ ছোবল থেকে যুব ও তরুণ সমাজকে বাঁচতে হলে আমাদের সম্মিলিত প্রতিরোধের বিকল্প পথ নেই। তাই মাদকসংক্রান্ত আনুষঙ্গিক বিষয়াবলী সম্পর্কে জানা এবং মাদকাসক্তি প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব।

তবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জনগণ বিদেশী মাদক, ফেনসিডিল, ইয়াবা, হিরোইন, কোকেন থেকে বহুদূরে অবস্থান করছেন। তারা ক্ষতিকর মাদকদ্রব্য ব্যবহার করেন না এবং অলস জীবনযাপন করেন না এবং সকলেই পরিশ্রমী। তারা মূলত প্রথাগত ও ঐতিহ্যগতভাবে বাড়িতে চোলাই মদ ও তালগাছের রস বা তাড়ি বা হাঁড়িয়া পানে অভ্যস্ত। তাদের নিজস্ব তৈরিকৃত মাদকদ্রব্য দ্বারা কখনও সমাজের নতুন প্রজন্ম বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সার্বিক বিশ্লেষণ করেই সরকার ১১ ধারা প্রণয়ন করে আইনগত জটিলতা থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ২৫৫টি জাতিকে মুক্ত বা রেহাই করে দিয়েছে। অর্থাৎ ২৫৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮-এর বিধান মতে চোলাই মদ, তাল গাছের রস বা তাড়ি বা হাঁড়িয়া পান করতে আইনত নিষেধ নেই।

লেখক : সভাপতি, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, জয়পুরহাট জেলা ও এ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট