বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও উন্নয়নচিন্তার অঙ্গনে নতুন প্রজন্মের সক্রিয় অংশগ্রহণ এখন সময়ের দাবি। যখন দেশে তরুণদের হতাশা, বেকারত্ব, বৈষম্য, সামাজিক বৈপরীত্য ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা নিয়ে আলোচনা সর্বত্র, তখনই উদ্ভাসিত হচ্ছেন কয়েকজন ব্যতিক্রমী তরুণ, যারা নিজেদের পথপ্রদর্শক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। তাদের মাঝেই অন্যতম নাম সালাউদ্দিন সালমান-কলাবাগান থেকে কড়ৈতলী গ্রামের একজন দৃঢ় সততা, মানবিক মূল্যবোধ ও সংগঠনশীলতার মিশ্রণে গড়ে ওঠা তরুণ নেতা।
গ্রাম থেকে উঠে এসে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একাধিক সংগঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র রাজনীতিতে নেতৃত্ব এবং সর্বশেষ চাঁদপুর-৪ আসনে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এর মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী-সব মিলিয়ে সালমান আজকের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত তরুণদের মধ্যে অন্যতম।
শৈশবের দামাল সময় থেকে মূল্যবোধের গঠন : সালাউদ্দিন সালমানের জন্ম কড়ৈতলী গ্রামের এক শিক্ষিত ও নীতিবান পরিবারে। বাবা মো. মোফিজুল ইসলাম এবং মা সালমা বেগম-দু’জনই সন্তানদের বড় করেছেন সততা, ন্যায়পরায়ণতা, পরিশ্রম ও মানবিকতার শিক্ষা দিয়ে। অল্প বয়স থেকেই পরিবারের এই নৈতিক পরিবেশকে নিজের চরিত্রে ধারণ করেন সালমান।
গাজীপুর আহমদিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় দীর্ঘ সময় পড়াশোনা করে তিনি ধর্মীয় শিক্ষা, সামাজিক মূল্যবোধ এবং মানবিক দায়িত্ববোধের গভীর ভিত্তি তৈরি করেন। সহপাঠীরা তাকে চিনত শান্ত, ভদ্র, চিন্তাশীল ও দায়িত্বশীল একজন ছাত্র হিসেবে।
মাদ্রাসায় ফাজিল পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি উচ্চশিক্ষায় নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেন-বর্তমানে তিনি প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী।
ইংরেজি ভাষায় অনুশীলন, বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা এবং সমসাময়িক বিশ্বরাজনীতি সম্পর্কে পড়াশোনার অভ্যাস তাকে সহপাঠীদের কাছে ‘স্টুডেন্ট লিডারশিপ’-এর মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তার উত্থান : বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোতে বৈষম্য আজও বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষাবৈষম্য, নারীর নিরাপত্তা, শ্রম অধিকার, সংখ্যালঘু নির্যাতনএসব বিষয় তরুণদের মনে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষত তৈরি করে রেখেছে। সালমানও সেই পরিবর্তনের স্বপ্ন এবং ক্ষোভ নিয়ে যুক্ত হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে।
তিনি দেখেছেন কিভাবে সমাজের প্রান্তিক মানুষরা বঞ্চনার শিকার হন। সেই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই সংগঠনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা গড়ে ওঠে। এবং খুব দ্রুতই তিনি নেতৃত্বের জায়গায় পৌঁছে যান।
বর্তমানে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কলাবাগান থানা শাখার আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার নেতৃত্বে কলাবাগান এলাকায় বৈষম্যবিরোধী কার্যক্রম আরও সংগঠিত হয়েছে-ছাত্র অধিকার, সাম্যবাদী চিন্তা, মানবিক কর্মসূচি, সচেতনতামূলক সভা এবং সাংগঠনিক প্রশিক্ষণে তরুণদের অংশগ্রহণ বেড়েছে।
এক সহকর্মী বলেন, “সালমান মানেই শান্ত নেতৃত্ব। কথা কম বলেন, কাজ বেশি করেন। তার শৃঙ্খলা ও সৎ সাহস আমাদের অনুপ্রাণিত করে।”
জুলাই মঞ্চ আন্দোলনে আহতদের পাশে মানবিক দায়িত্ব : ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত কয়েকটি রাজনৈতিক অস্থিরতার ঘটনায় বহু তরুণ আহত হন। দেশে তখন ভয়, অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ-সবকিছুর মধ্যে সালমান এগিয়ে আসেন আহতদের পাশে দাঁড়ানোর কাজে।
তিনি মাঠপর্যায়ের কর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় করে আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া, পরিবারকে তথ্য দেওয়া, আইনগত সহযোগিতা নিশ্চিত করা এবং নিরাপদ পরিবেশ তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে তিনি তরুণ সমাজে মানবিক নেতৃত্বের উদাহরণ স্থাপন করেন।
আহতদের একজন বলেন, “আমরা শরীরে আঘাত পেয়েছিলাম, কিন্তু মনোবল ফিরিয়ে দিয়েছিল সালমান।”
আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সংগঠনে সক্রিয় ভূমিকায় বিশ্বমুখী তরুণ : বাংলাদেশের বাইরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তরুণদের অবস্থান তৈরি করা সহজ নয়। কিন্তু সালমান তার ভাষাজ্ঞান, সাংগঠনিক দক্ষতা ও বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সেই জায়গা করে নিয়েছেন।
তিনি যুক্ত হয়েছেন ইউনাইটেড নেশনাল কালচারাল অর্গানাইজেশন অফ রোলার এরিয়া বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ভাষাভিত্তিক প্রকল্পে। এ সংগঠন মূলত- গ্রামীণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, ভাষাগত বৈচিত্র্য রক্ষা, শিল্প-সাহিত্য বিনিময়, তরুণদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ তৈরি -এই বিষয়গুলোর ওপর কাজ করে।
এখানে সালমানের মূল দায়িত্ব হলো বহুভাষিক প্রজন্মের মধ্যে সাংস্কৃতিক সংযোগ গড়ে তোলা এবং আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক কূটনীতি শক্তিশালী করা।
এই অভিজ্ঞতা তাকে বৈশ্বিক সমাজ, সংস্কৃতি এবং পরিবর্তনশীল পৃথিবীর রাজনৈতিকুসামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে।
টেকসই পানি নীতির নেতৃত্ব : বাংলাদেশের পানি-চ্যালেঞ্জ আজও অন্যতম জাতীয় ইস্যু-নদী ভাঙন, পানি দূষণ, শুকনো মৌসুমে পানি সংকট, উদ্বেগজনক ভূগর্ভস্থ পানির ক্ষয়, পরিবেশগত ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা-এসব নিয়ে তরুণদের সচেতন করা অত্যন্ত জরুরি।
ঠিক সেই জায়গায় কাজ করছে বাংলাদেশ ওয়াটার ইউথ পার্লামেন্ট, যেখানে সালমান দায়িত্ব পালন করছেন অর্থ সম্পাদক হিসেবে।
তার কাজের মধ্যে রয়েছে- পানি অধিকার নিয়ে আলোচনা, তরুণদের পরিবেশ-সচেতনতা বৃদ্ধি, কমিউনিটি পর্যায়ে পানি ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ, প্রকল্প বাস্তবায়ন, বাজেট ব্যবস্থাপনা, আন্তর্জাতিক সহযোগীদের সঙ্গে সমন্বয়।
সংগঠনের এক কর্মকর্তা বলেন, “সালমান অত্যন্ত সৎ ও স্বচ্ছভাবে বাজেট পরিচালনা করেন। তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য তার সৃজনশীল পরিকল্পনা প্রশংসনীয়।”
রক্তদান, বন্যাত্রাণসহ অসংখ্য মানবিক কার্যক্রমে উপস্থিতি : সালমান কোনো সংগঠনের পদে থাকলেই কেবল দায়িত্ব পালন করেন না; সমাজের ছোট-বড় বিভিন্ন মানবিক কাজেও তিনি এগিয়ে আসেন। তার অংশগ্রহণ দেখা গেছে- রক্তদান কর্মসূচি, বন্যাত্রাণ সংগ্রহ, অসহায় শিক্ষার্থীদের সহায়তা, রাস্তা নিরাপত্তা সচেতনতা, স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রচারণা।
মানুষের উপকার করা যে তার জীবনের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য-এটি তিনি শব্দে নয়, কাজে প্রমাণ করেন।
বেস্ট ইয়ুথ লিডার ২০২৪ : ২০২৪ সালে সালমান অর্জন করেন বেস্ট ইয়ুথ লিডার ২০২৪ সম্মাননা। তরুণদের জন্য, বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী রাজনৈতিক শিক্ষায় সক্রিয়তার জন্য এই পুরস্কার গুরুত্বপূর্ণ।
পুরস্কার হাতে নিয়ে তার বক্তব্য ছিল, “নেতৃত্ব মানে পদ পাওয়া নয়; নেতৃত্ব মানে দায়িত্ব নেওয়া-মানুষের পাশে দাঁড়ানো।”
চাঁদপুর-৪ আসনে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর প্রার্থী : তার রাজনৈতিক যাত্রার নতুন অধ্যায় শুরু হয় যখন জাতীয় নাগরিক পার্টি (ঘঈচ) তাকে চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনে মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে।
দলের মতে- তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব, বৈষম্যবিরোধী রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, মানবিক নেতৃত্ব, গ্রাম উন্নয়ন-কেন্দ্রিক পরিকল্পনা -এসব কারণে সালমানকে তারা ভবিষ্যতের নেতৃত্ব হিসেবে দেখছেন।
তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো মূলত কেন্দ্র করে- বৈষম্যহীন সমাজ গঠন, গ্রামের উন্নয়ন, শিক্ষা ও গ্রামীণ স্কুল উন্নয়ন, তরুণদের নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ, পানি ও পরিবেশের টেকসই ব্যবস্থাপনা, সংস্কৃতি ও ভাষা রক্ষায় কর্মসূচি।
তিনি বলেন, “আমাদের প্রজন্ম যদি দায়িত্ব না নেয়, বাংলাদেশ এগোবে না। পরিবর্তন অসম্ভব কিছু নয়-তরুণরা চাইলে সব পারে।”
ভবিষ্যতের স্বপ্ন : সালমান ভবিষ্যৎ নিয়ে স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন। তার লক্ষ্য- বৈষম্যবিরোধী রাজনৈতিক শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া, গ্রামীণ শিক্ষার রূপান্তর, তরুণদের দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র স্থাপন, পানি ও পরিবেশুসংরক্ষণমূলক নেতৃত্ব গড়ে তোলা, সংস্কৃতি ও ভাষার ঐতিহ্য সংরক্ষণ, আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের তরুণদের প্রতিনিধিত্ব শক্তিশালী করা।
তিনি বিশ্বাস করেন, “বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে। আমরা যদি সৎ হই, ন্যায়পরায়ণ হই, এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াই-তাহলেই আসবে পরিবর্তন।”
আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তরুণদের প্রতি সন্দেহ বা হতাশা অনেক। কিন্তু সেই বাস্তবতার মধ্যেও সালাউদ্দিন সালমান একজন অনন্য উদাহরণ। একদিকে পরিবার ও পড়াশোনার দায়িত্ব, অন্যদিকে সংগঠন, মানবিক কাজ, আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা, এবং সর্বশেষ জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ-সবকিছুকে তিনি একইসঙ্গে ধরে রেখেছেন।
কড়ৈতলীর গ্রাম্য পরিবেশ থেকে উঠে এসে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে তার উত্থান নতুন প্রজন্মের তরুণদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
একজন তরুণ কীভাবে নীতিবোধ, সততা, সংগঠনশৈলী ও মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে সমাজে প্রভাব ফেলতে পারে-সালমান সেই প্রশ্নের সবচেয়ে বাস্তব উত্তর।
প্রিন্ট
নিজস্ব প্রতিবেদক 



















