ঢাকা ১২:১৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৮ মে ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম ::
আগুলিয়ায় ফেক হোয়াটসঅ্যাপ আইডি ও বিকাশ নম্বর ব্যবহার করে হয়রানির অভিযোগ চন্দ্রগঞ্জ থানা জামায়াতের বাছাইকৃত কর্মী শিক্ষা শিবির অনুষ্ঠিত কাশিমপুরে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নজরদারি ছাড়াই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হচ্ছে ‘হানিফ সরিষার তৈল পোস্ট মাস্টার শ্বশুর জালিয়াতি করে ১৫ বছর যাবৎ দুই পদের বেতন আত্মসাৎ ঠাকুরগাঁওয়ে ঝড়ে গাছ চাপায় গৃহবধূর মৃত্যু গাজীপুরে বকেয়া বেতনের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ শ্রমিকদের ইশরাক সমর্থকদের লংমার্চ কর্মসূচিতে পুলিশের বাধা খুলনায় মাহিন্দ্রা ও লরির সংঘর্ষে নিহত ৩ মাইক্রোক্রেডিট ব্যাংকের জন্য আলাদা আইন করতে হবে: প্রধান উপদেষ্টা ১৭ মে: বাংলাদেশের অনেক ‘প্রথমের’ একদিন

১৭ মে: বাংলাদেশের অনেক ‘প্রথমের’ একদিন

নিজস্ব সংবাদদাতা:
  • আপডেট টাইম : ০৭:০৮:০৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৭ মে ২০২৫
  • / ৩ ১৫০০০.০ বার পাঠক

আট হাজার কিলোর এদিক ওদিকে ভিন্ন টাইম-জোনের দুটো শহরই ২১ বছরের এদিক ওদিকে বাংলাদেশকে, দেশের ক্রিকেটকে ভাসিয়েছিল পরমানন্দে, আজকের এই ১৭ই মে’তে/ফাইল ছবি

হায়দরাবাদ থেকে ম্যালাহাইডের দূরত্ব কতো? মেরেকেটে আট হাজার কিলো হবে। এই আট হাজার কিলোর এদিক ওদিকে ভিন্ন টাইম-জোনের দুটো শহরই ২১ বছরের এদিক ওদিকে বাংলাদেশকে, দেশের ক্রিকেটকে ভাসিয়েছিল পরমানন্দে, আজকের এই ১৭ই মে’তে।

‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’ — সকালের সূর্য দেখেই নাকি আঁচ করা যায় দিনটা কেমন যাবে। ২৭ বছর আগের আজকের এই দিনে হায়দরাবাদ-মহাকাব্যের সঙ্গে কথাটা মিলে যায় খাপে খাপে। কেনিয়ার বিপক্ষে শুরু থেকেই মনে হচ্ছিল, আজ কিছু একটা হলেও হতে পারে। শেষমেশ হয়েছেও তাই।

তবে সে কথাটা ৬ বছর আগের ম্যালাইডের সঙ্গে যায় না কিছুতেই। প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারাতে হতো শিরোপা জিততে হলে। সেটা যে অঙ্ক কষে করল বাংলাদেশ, তাতে সেদিন লেখা হয়েছিল ‘অনন্য’ এক প্রত্যাবর্তনের গল্পও। শুরুটা যেমনই হোক, দুই গল্পের শেষটা এসে মিলেছিল এক বিন্দুতে। আর সে কারণেই ১৭ মে’র আবেদনটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের কাছে হয়ে গেছে অনেক দামি।

এক বছর আগেও ওয়ানডে স্ট্যাটাস ছিল না বাংলাদেশের। আর স্ট্যাটাস নেই বলে আগের সব খুচরো জয়েরও আইসিসির কেতাবে কোনো মূল্য ছিল না। হিসেবের খাতাটা খোলা হয় ১৯৯৭ সালের ১৫ জুন, বাংলাদেশ যেদিন তৎকালীন ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম ফরম্যাটের নবীনতম সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি পেল, সেদিন থেকে।

তবে খাতাটা হাতে পেলেও সে খাতাটা কিছুতেই যেন খোলা যাচ্ছিল না। স্ট্যাটাস মেলার এক বছর ঘনিয়ে আসছিল, কিন্তু অপেক্ষাটা কিছুতেই যেন ফুরোচ্ছিল না বাংলাদেশের। ভারতের মাটিতে ত্রিদেশীয় ওই সিরিজের আগেও বাংলাদেশ ‘স্বীকৃত’ ওয়ানডে খেলেছে অনেক, এশিয়া কাপে নিয়মিতই পা পড়েছে, খেলেছে অস্ট্রেলেশিয়া কাপও। কিন্তু সেসব টুর্নামেন্ট থেকে ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে।

এরপরই এলো ভারতের মাটিতে ওই ত্রিদেশীয় সিরিজ। স্বাগতিকরা তো আছেই, বাংলাদেশ বাদে অন্য দলটার নাম কেনিয়া। আজকাল কেনিয়া হয়তো ক্রিকেটের কেউকেটা গোছের কোনো দল নয়, তবে তখন দলটার ভারই ছিল আলাদা। সে দিনটার বছর দুই আগে পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দুই অঙ্কে অলআউট করে হারিয়ে দিয়েছিল স্টিভ টিকোলো, মরিস ওদুম্বে, দীপক চুদাসামাদের দলটা।

সেই দলটা ছিল আবার বড় অধারাবাহিক, অননুমেয়। নবীন বাংলাদেশের মনের কোণে একটা ক্ষীণ আশা তাই ছিল, যদি দিনটা আমাদের হয়, যদি তাদের দিনটা খারাপ যায়, দুয়ের মিশেল হয়ে গেলেই তো কেল্লাফতে! মনের সে আশার টিমটিমে আলোটা আরও বড় হয়ে উঠল, যখন টস জিতে ব্যাট করতে নামা কেনিয়া মোরশেদ আলী খান, খালেদ মাহমুদ, এনামুল হক মনি আর মোহাম্মদ রফিকদের তোপে পড়ে ২৯ রানে দুই আর ৮৯ রানে চার উইকেট খুইয়ে বসল। অভিষিক্ত রবিন্দু শাহ’র ঝোড়ো ফিফটি কিছুটা বাগড়া দিল অবশ্য, তাতে রানটাও হয়ে গেল ‘বিশাল’, ২৩৬। এখনকার ক্রিকেটে এ রান হয়তো মামুলিও নয়, কিন্তু সে যুগে তাই ছিল প্রমাণ স্কোর, জয়ের জন্য যথেষ্ট পুঁজি।

তবে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী স্টেডিয়ামে সেটাকেও নাগালের খুব কাছে নিয়ে এল বাংলাদেশের ওপেনিং জুটি। বল হাতে তিন উইকেট নেওয়া রফিককে ওপেন করতে নামিয়ে দেওয়া হলো আতহার আলী খানের সঙ্গে। দুজন মিলে খেলা ফেললেন অর্ধেকের বেশি ওভার, রান উঠে গেল প্রয়োজনীয় রান রেটের চেয়েও বেশি। ১৩৭! বাংলাদেশের ওপেনিং জুটি এমন খেল দেখাতে পারেনি এর আগে কখনোই!

১৪ রানে দু’বার জীবন পাওয়া রফিক যখন ৭৭ রানের ঝড় শেষে ফিরলেন, তখন দলের চাই আর মোটে ১০০ রান, ৯ উইকেট হাতে। এমন পরিস্থিতি থেকে জয়টা সহজই ছিল বাংলাদেশের জন্য; আতহার, আমিনুল ইসলাম, আকরাম খানরা পা হড়কাতে দেননি দলকে। ১২ বল আর ৬ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ চলে যায় জয়ের বন্দরে। সঙ্গে সঙ্গে আনন্দের বাঁধ ভাঙে। প্রথম জয়ের দিনে সে বাঁধটা না ভাঙলেই বরং উদ্ভট কিছু হতো!

তবে ‘আনন্দের বাঁধ ভাঙা’ কথাটা বোধ হয় পরিস্থিতিটাকে বুঝাতে পারছে না। সে ম্যাচের পর মাঝরাত পর্যন্ত বিদেশ বিভূঁইয়ে বাংলাদেশের হোটেলের সামনে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ রব তুলেছেন সমর্থকরা। সে হোটেলে ছিলেন অনিল কাপুর, মাধুরী দীক্ষিতের মতো বলিউড তারকারা, সেই তারারাও হোটেলের লবিতে নেমে এসেছিলেন বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানাতে। কোচ গর্ডন গ্রিনিজ ছিলেন ভারি মেজাজের মানুষ, সে তিনিও সারারাত জেগে উদযাপন করেছেন দলের সঙ্গে, গলা মিলিয়েছেন ‘আমার সোনার বাংলা’য়। প্রথম জয়ের মহিমা বুঝি এমনই!

হায়দরাবাদ-আবেগের ওই ম্যাচের পর কেটে গেছে দুটো দশকের একটু বেশি সময়। বাংলাদেশ ক্রিকেট অনেক চড়াই উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে এ সময়ে। গড়েছে টানা ম্যাচ হারের ‘অপ্রীতিকর’ বিশ্বরেকর্ড। হারিয়েছে পাকিস্তান, ভারত, অস্ট্রেলিয়াসহ সবকটা দলকে। দল হিসেবেও হয়েছে সমীহ জাগানিয়া এক অস্তিত্ব।

একটা দলের কাছে এরপরের চাওয়া কী থাকে? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, একটা শিরোপা।

সে অধরা শিরোপার খুব কাছে বাংলাদেশ বহুবার গেছে এ সময়ে। ২০০৯ গ্রামীনফোন কাপের ফাইনালে ৬ রাঙে শ্রীলঙ্কার ৫ উইকেট তুলে নিয়েও হারের বেদনায় পোড়া, কিংবা ২০১২ এশিয়া কাপের ওই ফাইনালে ২ রানের বিষাদ, একটার পর একটা বহুজাতিক টুর্নামেন্টের ফাইনাল বাংলাদেশকে এমন সব ট্র্যাজেডির সাক্ষী বানিয়েছে, সেসব পাশ কাটিয়ে শিরোপাটা ছুঁয়ে দেখা হয়নি দলের।

৬ বছর আগে, ২০১৯ সালের আজকের এই দিনে সে সুযোগটা আবার আসে আরও এক ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে। এর আগে বহু ফাইনালে আশা জাগিয়েও শেষরক্ষা হয়নি বাংলাদেশের। সে ফাইনালেও যে হবে, তেমন আভাস মিলছিল না।

বাংলাদেশের বোলিং সে বছরটা খুব বাজে একটা সময়ই পার করছে। টস হেরে ফিল্ডিংয়ে নেমে দলটা ভুলই করে বসেছিল। নতুন বলটা কাজে লাগানো গেল না, ২০ ওভার পেরিয়ে গেলেও উইকেটের দেখা মিলল না, ফাইনালের প্রতিপক্ষ উইন্ডিজ তুলে ফেলল ১৩১ রান। তখনই ঝমঝমিয়ে নামল বৃষ্টি। তাও যে সে বৃষ্টি নয়, পাক্কা ৫ ঘণ্টা খেলা বন্ধ রইল সে কারণে। ম্যাচটাই ভেসে যায় কি না, তা নিয়েও ছিল শঙ্কা!

সে শঙ্কা ঝেঁটিয়ে বিদায় করে যখন ম্যাচটা মাঠে গড়াল, তখন আবার আরেক ভয়ে প্রমাদ গুণতে হলো, এ ভয়ের নাম ডাকওয়ার্থ লুইস মেথড। ম্যাচটা নেমে এসেছিল ২৪ ওভারে, উইন্ডিজের হাতে ছিল সবকটা উইকেট। ক্যারিবীয়রা যদি শেষ চার ওভারে বড় রান করে ফেলত, তাহলে রানটা এভারেস্টসম হয়ে যেত বাংলাদেশের জন্য।

মেহেদী হাসান মিরাজের ঘূর্ণিতে সেটা করতে পারেনি উইন্ডিজ, ১ উইকেট খুইয়ে থামতে হয়েছে ১৫২ রানে। তবে এরপরও বাংলাদেশের সামনে লক্ষ্যটা দাঁড়ায় ২৪ ওভারে ২১০ রানের। টি-টোয়েন্টির যুগেও কাজটা সহজ নয় আদৌ।

তামিম ইকবালের সঙ্গে সৌম্য সরকারের ৫.৩ ওভারে ৫৯ রানের জুটি, সে পাহাড় ডিঙানোর সাহস দিল। এরপর তামিম আর সাব্বির রহমানের বিদায়ে খনিকের জন্য শঙ্কা চেপে বসেছিল দলে। ৪১ বলে ৬৬ রান করা সৌম্যও যখন বিদায় নিলেন, দলের রান তখন ১০৯। ২২ বলে ৩৬ রানের ইনিংস খেলা মুশফিকও বিদায় নিলেন কিছু পরে, মোহাম্মদ মিঠুনও পথ ধরলেন তার পিছু পিছু, দলের তখন চাই আরও ৬৭ রান, হাতে বল আছে আর ৫০টি। সেই থেকে হালটা ধরলেন মোসাদ্দেক হোসেন, তাকে সঙ্গ দিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ২৭ বলে ৫২ রানের ইনিংসে মোসাদ্দেক দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দিয়ে তবেই থামলেন, যে বন্দরে ভেড়ার প্রত্যাশা বাংলাদেশের শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে, দশ বছর পর সে প্রত্যাশাটা পূরণ হয় দলের।

প্রশ্নটা আবার করা যাক– হায়দরাবাদ থেকে ম্যালাহাইডের দূরত্ব কতো? আপনি বলতে পারেন দূরত্বটা মেরেকেটে ৮ হাজার কিলোর। কিন্তু যদি বলি এই দুই বিন্দুর দূরত্বটা ২১ বছরের, তাহলেও কি খুব ভুল হয়ে যায়? না হয়তো! প্রথম জয় থেকে প্রথম বহুজাতিক শিরোপার দূরত্বটা পাড়ি দিতে যে ঠিক এই সময়টাই পার করতে হয়েছে বাংলাদেশকে।

কাকতাল বলুন আর যাই বলুন, দুটো ‘প্রথম’ই বাংলাদেশের হাতে এসে ধরা দিয়েছে আজকের এই দিনে, এই ১৭ মে’তে। দিনটা দেশের ক্রিকেটের জন্য বিশেষ কিছু, তা নিশ্চয়ই আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না!

আরো খবর.......

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

১৭ মে: বাংলাদেশের অনেক ‘প্রথমের’ একদিন

আপডেট টাইম : ০৭:০৮:০৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৭ মে ২০২৫

আট হাজার কিলোর এদিক ওদিকে ভিন্ন টাইম-জোনের দুটো শহরই ২১ বছরের এদিক ওদিকে বাংলাদেশকে, দেশের ক্রিকেটকে ভাসিয়েছিল পরমানন্দে, আজকের এই ১৭ই মে’তে/ফাইল ছবি

হায়দরাবাদ থেকে ম্যালাহাইডের দূরত্ব কতো? মেরেকেটে আট হাজার কিলো হবে। এই আট হাজার কিলোর এদিক ওদিকে ভিন্ন টাইম-জোনের দুটো শহরই ২১ বছরের এদিক ওদিকে বাংলাদেশকে, দেশের ক্রিকেটকে ভাসিয়েছিল পরমানন্দে, আজকের এই ১৭ই মে’তে।

‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’ — সকালের সূর্য দেখেই নাকি আঁচ করা যায় দিনটা কেমন যাবে। ২৭ বছর আগের আজকের এই দিনে হায়দরাবাদ-মহাকাব্যের সঙ্গে কথাটা মিলে যায় খাপে খাপে। কেনিয়ার বিপক্ষে শুরু থেকেই মনে হচ্ছিল, আজ কিছু একটা হলেও হতে পারে। শেষমেশ হয়েছেও তাই।

তবে সে কথাটা ৬ বছর আগের ম্যালাইডের সঙ্গে যায় না কিছুতেই। প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারাতে হতো শিরোপা জিততে হলে। সেটা যে অঙ্ক কষে করল বাংলাদেশ, তাতে সেদিন লেখা হয়েছিল ‘অনন্য’ এক প্রত্যাবর্তনের গল্পও। শুরুটা যেমনই হোক, দুই গল্পের শেষটা এসে মিলেছিল এক বিন্দুতে। আর সে কারণেই ১৭ মে’র আবেদনটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের কাছে হয়ে গেছে অনেক দামি।

এক বছর আগেও ওয়ানডে স্ট্যাটাস ছিল না বাংলাদেশের। আর স্ট্যাটাস নেই বলে আগের সব খুচরো জয়েরও আইসিসির কেতাবে কোনো মূল্য ছিল না। হিসেবের খাতাটা খোলা হয় ১৯৯৭ সালের ১৫ জুন, বাংলাদেশ যেদিন তৎকালীন ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম ফরম্যাটের নবীনতম সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি পেল, সেদিন থেকে।

তবে খাতাটা হাতে পেলেও সে খাতাটা কিছুতেই যেন খোলা যাচ্ছিল না। স্ট্যাটাস মেলার এক বছর ঘনিয়ে আসছিল, কিন্তু অপেক্ষাটা কিছুতেই যেন ফুরোচ্ছিল না বাংলাদেশের। ভারতের মাটিতে ত্রিদেশীয় ওই সিরিজের আগেও বাংলাদেশ ‘স্বীকৃত’ ওয়ানডে খেলেছে অনেক, এশিয়া কাপে নিয়মিতই পা পড়েছে, খেলেছে অস্ট্রেলেশিয়া কাপও। কিন্তু সেসব টুর্নামেন্ট থেকে ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে।

এরপরই এলো ভারতের মাটিতে ওই ত্রিদেশীয় সিরিজ। স্বাগতিকরা তো আছেই, বাংলাদেশ বাদে অন্য দলটার নাম কেনিয়া। আজকাল কেনিয়া হয়তো ক্রিকেটের কেউকেটা গোছের কোনো দল নয়, তবে তখন দলটার ভারই ছিল আলাদা। সে দিনটার বছর দুই আগে পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দুই অঙ্কে অলআউট করে হারিয়ে দিয়েছিল স্টিভ টিকোলো, মরিস ওদুম্বে, দীপক চুদাসামাদের দলটা।

সেই দলটা ছিল আবার বড় অধারাবাহিক, অননুমেয়। নবীন বাংলাদেশের মনের কোণে একটা ক্ষীণ আশা তাই ছিল, যদি দিনটা আমাদের হয়, যদি তাদের দিনটা খারাপ যায়, দুয়ের মিশেল হয়ে গেলেই তো কেল্লাফতে! মনের সে আশার টিমটিমে আলোটা আরও বড় হয়ে উঠল, যখন টস জিতে ব্যাট করতে নামা কেনিয়া মোরশেদ আলী খান, খালেদ মাহমুদ, এনামুল হক মনি আর মোহাম্মদ রফিকদের তোপে পড়ে ২৯ রানে দুই আর ৮৯ রানে চার উইকেট খুইয়ে বসল। অভিষিক্ত রবিন্দু শাহ’র ঝোড়ো ফিফটি কিছুটা বাগড়া দিল অবশ্য, তাতে রানটাও হয়ে গেল ‘বিশাল’, ২৩৬। এখনকার ক্রিকেটে এ রান হয়তো মামুলিও নয়, কিন্তু সে যুগে তাই ছিল প্রমাণ স্কোর, জয়ের জন্য যথেষ্ট পুঁজি।

তবে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী স্টেডিয়ামে সেটাকেও নাগালের খুব কাছে নিয়ে এল বাংলাদেশের ওপেনিং জুটি। বল হাতে তিন উইকেট নেওয়া রফিককে ওপেন করতে নামিয়ে দেওয়া হলো আতহার আলী খানের সঙ্গে। দুজন মিলে খেলা ফেললেন অর্ধেকের বেশি ওভার, রান উঠে গেল প্রয়োজনীয় রান রেটের চেয়েও বেশি। ১৩৭! বাংলাদেশের ওপেনিং জুটি এমন খেল দেখাতে পারেনি এর আগে কখনোই!

১৪ রানে দু’বার জীবন পাওয়া রফিক যখন ৭৭ রানের ঝড় শেষে ফিরলেন, তখন দলের চাই আর মোটে ১০০ রান, ৯ উইকেট হাতে। এমন পরিস্থিতি থেকে জয়টা সহজই ছিল বাংলাদেশের জন্য; আতহার, আমিনুল ইসলাম, আকরাম খানরা পা হড়কাতে দেননি দলকে। ১২ বল আর ৬ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ চলে যায় জয়ের বন্দরে। সঙ্গে সঙ্গে আনন্দের বাঁধ ভাঙে। প্রথম জয়ের দিনে সে বাঁধটা না ভাঙলেই বরং উদ্ভট কিছু হতো!

তবে ‘আনন্দের বাঁধ ভাঙা’ কথাটা বোধ হয় পরিস্থিতিটাকে বুঝাতে পারছে না। সে ম্যাচের পর মাঝরাত পর্যন্ত বিদেশ বিভূঁইয়ে বাংলাদেশের হোটেলের সামনে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ রব তুলেছেন সমর্থকরা। সে হোটেলে ছিলেন অনিল কাপুর, মাধুরী দীক্ষিতের মতো বলিউড তারকারা, সেই তারারাও হোটেলের লবিতে নেমে এসেছিলেন বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানাতে। কোচ গর্ডন গ্রিনিজ ছিলেন ভারি মেজাজের মানুষ, সে তিনিও সারারাত জেগে উদযাপন করেছেন দলের সঙ্গে, গলা মিলিয়েছেন ‘আমার সোনার বাংলা’য়। প্রথম জয়ের মহিমা বুঝি এমনই!

হায়দরাবাদ-আবেগের ওই ম্যাচের পর কেটে গেছে দুটো দশকের একটু বেশি সময়। বাংলাদেশ ক্রিকেট অনেক চড়াই উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে এ সময়ে। গড়েছে টানা ম্যাচ হারের ‘অপ্রীতিকর’ বিশ্বরেকর্ড। হারিয়েছে পাকিস্তান, ভারত, অস্ট্রেলিয়াসহ সবকটা দলকে। দল হিসেবেও হয়েছে সমীহ জাগানিয়া এক অস্তিত্ব।

একটা দলের কাছে এরপরের চাওয়া কী থাকে? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, একটা শিরোপা।

সে অধরা শিরোপার খুব কাছে বাংলাদেশ বহুবার গেছে এ সময়ে। ২০০৯ গ্রামীনফোন কাপের ফাইনালে ৬ রাঙে শ্রীলঙ্কার ৫ উইকেট তুলে নিয়েও হারের বেদনায় পোড়া, কিংবা ২০১২ এশিয়া কাপের ওই ফাইনালে ২ রানের বিষাদ, একটার পর একটা বহুজাতিক টুর্নামেন্টের ফাইনাল বাংলাদেশকে এমন সব ট্র্যাজেডির সাক্ষী বানিয়েছে, সেসব পাশ কাটিয়ে শিরোপাটা ছুঁয়ে দেখা হয়নি দলের।

৬ বছর আগে, ২০১৯ সালের আজকের এই দিনে সে সুযোগটা আবার আসে আরও এক ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে। এর আগে বহু ফাইনালে আশা জাগিয়েও শেষরক্ষা হয়নি বাংলাদেশের। সে ফাইনালেও যে হবে, তেমন আভাস মিলছিল না।

বাংলাদেশের বোলিং সে বছরটা খুব বাজে একটা সময়ই পার করছে। টস হেরে ফিল্ডিংয়ে নেমে দলটা ভুলই করে বসেছিল। নতুন বলটা কাজে লাগানো গেল না, ২০ ওভার পেরিয়ে গেলেও উইকেটের দেখা মিলল না, ফাইনালের প্রতিপক্ষ উইন্ডিজ তুলে ফেলল ১৩১ রান। তখনই ঝমঝমিয়ে নামল বৃষ্টি। তাও যে সে বৃষ্টি নয়, পাক্কা ৫ ঘণ্টা খেলা বন্ধ রইল সে কারণে। ম্যাচটাই ভেসে যায় কি না, তা নিয়েও ছিল শঙ্কা!

সে শঙ্কা ঝেঁটিয়ে বিদায় করে যখন ম্যাচটা মাঠে গড়াল, তখন আবার আরেক ভয়ে প্রমাদ গুণতে হলো, এ ভয়ের নাম ডাকওয়ার্থ লুইস মেথড। ম্যাচটা নেমে এসেছিল ২৪ ওভারে, উইন্ডিজের হাতে ছিল সবকটা উইকেট। ক্যারিবীয়রা যদি শেষ চার ওভারে বড় রান করে ফেলত, তাহলে রানটা এভারেস্টসম হয়ে যেত বাংলাদেশের জন্য।

মেহেদী হাসান মিরাজের ঘূর্ণিতে সেটা করতে পারেনি উইন্ডিজ, ১ উইকেট খুইয়ে থামতে হয়েছে ১৫২ রানে। তবে এরপরও বাংলাদেশের সামনে লক্ষ্যটা দাঁড়ায় ২৪ ওভারে ২১০ রানের। টি-টোয়েন্টির যুগেও কাজটা সহজ নয় আদৌ।

তামিম ইকবালের সঙ্গে সৌম্য সরকারের ৫.৩ ওভারে ৫৯ রানের জুটি, সে পাহাড় ডিঙানোর সাহস দিল। এরপর তামিম আর সাব্বির রহমানের বিদায়ে খনিকের জন্য শঙ্কা চেপে বসেছিল দলে। ৪১ বলে ৬৬ রান করা সৌম্যও যখন বিদায় নিলেন, দলের রান তখন ১০৯। ২২ বলে ৩৬ রানের ইনিংস খেলা মুশফিকও বিদায় নিলেন কিছু পরে, মোহাম্মদ মিঠুনও পথ ধরলেন তার পিছু পিছু, দলের তখন চাই আরও ৬৭ রান, হাতে বল আছে আর ৫০টি। সেই থেকে হালটা ধরলেন মোসাদ্দেক হোসেন, তাকে সঙ্গ দিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ২৭ বলে ৫২ রানের ইনিংসে মোসাদ্দেক দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দিয়ে তবেই থামলেন, যে বন্দরে ভেড়ার প্রত্যাশা বাংলাদেশের শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে, দশ বছর পর সে প্রত্যাশাটা পূরণ হয় দলের।

প্রশ্নটা আবার করা যাক– হায়দরাবাদ থেকে ম্যালাহাইডের দূরত্ব কতো? আপনি বলতে পারেন দূরত্বটা মেরেকেটে ৮ হাজার কিলোর। কিন্তু যদি বলি এই দুই বিন্দুর দূরত্বটা ২১ বছরের, তাহলেও কি খুব ভুল হয়ে যায়? না হয়তো! প্রথম জয় থেকে প্রথম বহুজাতিক শিরোপার দূরত্বটা পাড়ি দিতে যে ঠিক এই সময়টাই পার করতে হয়েছে বাংলাদেশকে।

কাকতাল বলুন আর যাই বলুন, দুটো ‘প্রথম’ই বাংলাদেশের হাতে এসে ধরা দিয়েছে আজকের এই দিনে, এই ১৭ মে’তে। দিনটা দেশের ক্রিকেটের জন্য বিশেষ কিছু, তা নিশ্চয়ই আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না!