জেলে পল্লীর নীরব কান্না , দুশ্চিন্তাই এখন নিত্যদিনের সঙ্গী!
- আপডেট টাইম : ০৮:৩৮:২১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৫
- / ২ ৫০০০.০ বার পাঠক
বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার আশপাশের নদী ও সাগর গুলোতে জেলেদের জালে মিলছে না আশা অনুরূপ ইলিশ। এখানের জেলেরা সাগরে জাল ফেলা আর তোলার ভিতরেই দিনরাত পার করছে। কিছু জেলেদের জালে ছোট বড় দুই একটি ইলিশ ধরা পড়লেও তা বিক্রি করে ট্রলারের তেলের খরচ হচ্ছে না।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রটি এই উপজেলায় অবস্থিত। এই উপজেলায় আড়াই লক্ষাদিক মানুষের বসবাস। এখানে এক-তৃতীয়াংশ মানুষেরই জীবিকা নির্বাহ হয় সাগর ও নদী থেকে মৎস্য শিকারের মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, এই মৎস্য খাতের উপরে এখানকার বাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সরকারি বেসরকারি ব্যাংক গুলোও অনেকটা নির্ভরশীল। কারণ যেহেতু এটা মৎস্যনির্ভর এলাকা তাই এখানের জেলেদের জালে কাঙ্খিত ইলিশ শিকার না হলে এখানে বাজার-ঘাটে দোকানপাট গুলোতে যেমন বেচাবিক্রি কম হয় তেমনি ব্যাংক গুলোতেও লেনদেনের পরিমাণ কম হয়।
সাগর থেকে পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র (বিএফডিসি) ঘাটে ফেরা কয়েকজন জেলেদের সাথে কথা বললে এফবি মায়ের দোয়া ট্রলারের মাঝি সুলাইমান ফারাজি জানান,”মোগো মতন ছোডো খাটো জাইল্লা পরিবার মনে হয় আর দু’মুঠো ভাত খাইয়া বাইচ্চা থাকতে পারবে না।প্রত্যেক ফির মাহাজন ধারদেনা কইরা বাজার সদাই কিন্না গাঙ্গে পাডায়। যাওয়ার পর জালে যে মাছ ধরা পড়ে হ্যা বেইচ্চা তেলের টাহাই ওডে না। প্রত্যেক ফির খালি হাতে ঘাটে ফেরার পর মাহাজন ও পরিবারের চেহারার দিকে তাকাইতে পারি না। সাগরে মাছ না পাওয়ার কারণ হইলো অবৈধ ট্রলিং জাল।কারণ অবৈধ ট্রলিং জালে নির্বিচারে সাগরের গুঁড়ি গুঁড়ি ইলিশের পোনা মাছ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রজাতির পোনা মাছ ধ্বংস করে ফালায়। সরকারের পক্ষ থেকে যদি এখনই এই অবৈধ ট্রলিং জাল বন্ধ না করা যায়। তবে দুই চার বছর পর সাগরে আর ইলিশ মাছ খুঁজে পাওয়া যাবে না। সরকার একাধিকবার ট্রলিং জাল বন্ধের কথা কইলেও প্রভাবশালীগো ইশারায় এখন পর্যন্ত বন্ধ করে নাই। যদি এভাবে চলে তবে মোগো মতো ছোটো খাডো জাইল্লা না খাইয়া মরতে হইবে।”
এফবি সানাউল্লাহ ট্রলারের মালিক মোঃ সরোয়ার আকন দৈনিক সময়ের কন্ঠকে বলেন,ঋণ আর ধার-দেনায় জর্জরিত।গত তিন বছর আমার ফিশিং ট্রলারটি সাগরে বাজার সদাই দিয়ে পাঠাতে ৫০ লাখ টাকা খরচ করলেও এখন পর্যন্ত মাছ বিক্রির ৫০ টি টাকা নিজের পকেটে ঢুকাতে পারিনি।কিভাবেই বা পকেটে টাকা ঢুকাবো প্রতি বারই সাগর থেকে ট্রলার ঘাটে ফিরে অনেকটা শূন্য হাতে। আর কিছু মাছ পেলেও তা বিক্রি করে তেলের দামি হয় না।সাগর দিনদিন ইলিশ শূন্য হয়ে পড়ছে। এর বড় কারণ হলো অবৈধ টলিং জাল। যদি এই অবৈধ ট্রলিং জাল এখনই বন্ধ করা না যায় তবে দুই-চার বছর পরে সাগরে আর ইলিশ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
নূর মোহাম্মদ নামে এক আড়তৎদার ও ট্রলার মালিক জানান,ঋণের বোঝায় জর্জরিত। বছরে দুইবার মোটা অংকের টাকা প্রত্যকটা ট্রলারে দাদন দেয়া লাগে। এবং প্রত্যেক ট্রিপে প্রত্যেকটা ট্রলারে লক্ষ লক্ষ টাকার বাজার সদাই দিয়া সাগরে পাঠান লাগে। কিন্তু যখন ট্রলার গুলো খালি হাতে ঘাটে ফিরে আসে তখন নিজেরে ঠিক রাখা যায় না। আর ট্রলার গুলো খালি ঘাটে আসবে না তয় কি করবে, ট্রলিং জালের জন্য সাগরে কি কোন মাছ আছে।ছোট বড় সবই তো চুম্বুকের মতো ধ্বংস করে ফেলেছে ট্রলিং জাল।এখন যদি মৎস্য খাতকে বাঁচাতে হয় তবে ট্রলিং জাল বন্ধ করা ছাড়া কোন উপায় নাই। আর সরকার থেকে একাধিকবার ট্রলিং জাল বন্ধের কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত তা বন্ধ করা হয়নি। সরকার কেন ট্রলিং বন্ধ করতে পারছে না, নাকি ট্রলিং মালিকরা প্রভাবশালী ও টাকাওয়ালা বলে।
বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন,দেশের অর্থনীতির একটি বড় খাত হলো মৎস্য খাত।কিন্তু দিনদিন এই মৎস্য খাত ধ্বংস। আর ধ্বংসের কারণ হলো সরকারি অনুমোদনহীন ট্রলিং বোট। অবৈধ ট্রলিং বোটের মাধ্যমে নির্বিচারে মাছ শিকার করায় সমুদ্রে মাছের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মৎস্য আহরণে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে মাছ শূন্য হয়ে পড়বে সমুদ্র। দেশে এই অবৈধ ট্রলিং বোটের কারণে ইতিমধ্যে ৯০% ফিশিং ট্রলার বন্ধ হয়ে গেছে। এখন যে ১০% রয়েছে তাও বন্ধ হয়ে সম্ভাবনা রয়েছে।যদি অবৈধ ট্রলিং বোট গুলো বন্ধ না করা হয়। অবৈধ ট্রলিং বোটগুলো নীতিমালা অনুযায়ী ৪০ মিটার গভীরে মাছ শিকারের কথা থাকলেও, এখন এ নীতিমালা তোয়াক্কা না করে ৫ মিটার গভীরেই মাছ শিকার করছে।
এ বিষয় পাথরঘাটা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা হাসিবুল ইসলাম জানান,ইদানিং সাগরে জেলেদের জালে কাঙ্খিত মাছ ধরা না পড়ার বড় কারণ; হলো একে তো জলবায়ু পরিবর্তন অপরদিকে বিভিন্ন অবৈধ জালের মাধ্যমে নির্বিচারে পোনা মাছ শিকার সহ খাল বিলগুলোতে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার। অবৈধ জাল বন্ধে আমরা প্রতিদিনই অভিযান অব্যাহত রাখছি। বিভিন্ন ধরনের অবৈধ জাল আগুনে পুড়ে ধ্বংস এবং আর্থিক জরিমান করেও এগুলো বন্ধ করা যাচ্ছে না।তবে আশা রাখছি অতি দ্রুত এগুলো বন্ধ হবে।অধিকাংশ জেলেরা সাগরে অবৈধ ট্রলিং বোট বন্ধ করার কথা বলছে। কিন্তু ট্রলিং মালিকরা, ট্রলিং বোট দিয়ে সমুদ্রে মাছ শিকার করার আবেদন জানিয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট করেছেন। এ কারণে আমরা ট্রলিং বন্ধের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারছি না। তারপরও আমরা আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। খুব শীঘ্রই রিট আবেদন নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। তারপর আমরা পুরোদমে ট্রলিং বন্ধের জন্য অভিযান শুরু করবো।’