ঢাকা ০১:১২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৫ মে ২০২৫

“সিনেমায়ও ছিল নজরুলের আধিপত্য”

নিজস্ব সংবাদদাতা:
  • আপডেট টাইম : ০৫:৩৬:৪৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ মে ২০২৫
  • / ১ ১৫০.০০০ বার পাঠক

বাংলা সাহিত্যের আকাশে ধ্রুবতারা কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী আগামীকাল। তার কবিতা, গান, উপন্যাস ও গল্পে বাঙালি জেনেছে বীরত্বের ভাষা ও দ্রোহের মন্ত্র। বাঙালির সব আবেগ, অনুভূতিতে জড়িয়ে আছেন চিরবিদ্রোহী এ কবি। বিভিন্ন সময় সিনেমার পর্দায় ফুটে উঠেছে জাতীয় কবির গল্প, উপন্যাস ও কবিতা। নিজেও সিনেমা পরিচালনা এবং অভিনয় করেছেন। সিনেমায় কবিকে কীভাবে ও কতটা উপস্থাপন করা হয়েছে তা নিয়েই এ প্রতিবেদন।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সিনেমার সঙ্গে ছিলেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তার গল্প উপন্যাসে একাধিক সিনেমা নির্মাণ হয়েছে। নজরুলের লেখা গান যেমন অনেক সিনেমায় ব্যবহার হয়েছে, তেমনি পরিচালনা ও অভিনয়ও করেছেন তিনি। ‘ধুপছায়া’ নামে একটি সিনেমা পরিচালনা করার পাশাপাশি তাতে তিনি অভিনয় করেছিলেন। এতে দেবতা বিষ্ণুর চরিত্রে রুপদান করেন।

তিনি যখন কাজ করেন, ত্রিশ-চল্লিশ দশকের শুরুতে তখন তিনি ছিলেন বিপুল খ্যাতির অধিকারী। সে সময়ে সিনেমার সংগীত পরিচালনা, সিনেমার গানে কণ্ঠ দেয়া, শিল্পীদের গান শেখানো, যারা অভিনয় করতেন তাদের শুদ্ধ উচ্চারণ শেখানোর দায়িত্ব তিনিই পালন করতেন। ত্রিশের দশকে ম্যাডান থিয়েটার্সের ‘সুর ভান্ডারী’ পদে নিযুক্ত হন নজরুল। এ পদটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। সিনেমায় যারা গাইবেন ও অভিনয় করবেন তাদের গান শেখানো ও উচ্চারণ শুদ্ধ করার দায়িত্ব ছিল তার। শুধু তাই নয়, গান লেখা ও সুর করারও দায়িত্ব পালন করতে হতো নজরুলকে।

১৯৩১ সালে প্রথম বাংলা সবাক সিনেমা ‘জামাই ষষ্ঠী’তে সুর ভান্ডারীর কাজ করেন তিনি। ম্যাডান থিয়েটার্স কোম্পানির আরও যেসব সিনেমার সঙ্গে নজরুল সম্পৃক্ত ছিলেন সেগুলো হলো-‘জ্যোৎস্নার রাত’ (১৯৩১), ‘প্রহলাদ’ (১৯৩১), ‘ঋষির প্রেম’ (১৯৩১), ‘বিষ্ণুমায়া’ (১৯৩২), ‘চিরকুমারী’(১৯৩২), ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৯৩২), ‘কলঙ্ক ভঞ্জন’ (১৯৩২), ‘রাধাকৃষ্ণ’ (১৯৩৩) এবং ‘জয়দেব’ (১৯৩৩)। ১৯৩১ সালে বাংলা সবাক সিনেমা ‘জলসা’য় নজরুল নিজের একটি গান গেয়েছিলেন এবং ‘নারী’ কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলেন।

ম্যাডান থিয়েটার্সের একজন অংশীদার ছিলেন মিসেস পিরোজ ম্যাডান। তিনি ১৯৩৩ সালে পায়োনিয়ার ফিল্মস কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রতিষ্ঠান থেকে ‘ধ্রুব’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করা হয়। পুরাণের কাহিনি নিয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখা ‘ধ্রুব চরিত’ অবলম্বনে সিনেমাটি নির্মিত হয়। নজরুল এ সিনেমার গান লেখেন এবং সংগীত পরিচালনা করেন। তিনি দেবর্ষি নারদের চরিত্রে অভিনয়ও করেন এবং একটি গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি এটি মুক্তি পায়।

এছাড়াও সিনেমার গানে নজরুলের আধিপত্য ছিল বিস্তর। গান লেখার পাশাপাশি সংগীত পরিচালনার গুরু দায়িত্বও তিনিই পালন করতেন। ১৯৩৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পাতালপুরী’ সিনেমার সংগীত পরিচালনা করেন নজরুল। তিনি এবং পরিচালক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ছিলেন এ সিনেমার গীতিকার। এর জন্য ‘ঝুমুর’ সুরে গান রচনা করেন নজরুল। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত ১৯৩৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গৃহদাহ’ সিনেমার সুরকার ছিলেন নজরুল। ১৯৩৭ সালে মুক্তি পায় রহস্য কাহিনিভিত্তিক সিনেমা ‘গ্রহের ফের’। এটিরও সংগীত পরিচালক ও সুরকার ছিলেন নজরুল। ১৯৩৭ সালের সেরা সিনেমা ছিল ‘বিদ্যাপতি’। কবি বিদ্যাপতির জীবনীভিত্তিক এ সিনেমার মূল গল্প ছিল নজরুলের। দেবকী বসু পরিচালিত সিনেমাটির সুরকার ছিলেন নজরুল ও রাইচাঁদ বড়াল। ‘বিদ্যাপতি’র সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দিতে নির্মিত হয় এ সিনেমাটি। এতেও সম্পৃক্ত ছিলেন নজরুল। সেটিও সেসময় ব্যবসাসফল হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৩৮ সালে নির্মিত ‘গোরা’ সিনেমাটির সংগীত পরিচালনাও করেছেন আমাদের জাতীয় কবি। বিশ্বভারতী আপত্তি করে যে, সিনেমাটিতে সঠিকভাবে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া হচ্ছে না। নজরুল তখন সোজা চলে যান রবীন্দ্রনাথের কাছে।

রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে সমর্থন করেন এবং বিশ্বভারতীর সমালোচনা করে বলেন, ‘আমার গান কীভাবে গাইতে হবে সেটা কি তোমার চেয়ে ওরা ভালো বুঝবে?’ তিনি নজরুলকে তার গান নিজের খুশিমতো গাইবার ও ব্যবহারের অনুমতিপত্র দিয়ে দেন। নজরুল সেই সিনেমায় রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি নিজের লেখা একটি গান এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বন্দে মাতরম’ গানটি ব্যবহার করেন। ‘গোরা’তে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার হয়েছিল নজরুলের নিজস্ব শৈলীতে, যা প্রশংসিত হয়েছিল শ্রোতাদের মাঝে।

সে সময় মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হাল বাংলা’ নামে আরেকটি সিনেমার গানেও সুর করেছিলেন নজরুল। সেই সিনেমায় ছোট একটি কৌতুক চরিত্রে অভিনয়ও করেন তিনি। ১৯৩৯ সালে মুক্তি পায় ‘সাপুড়ে’। এর কাহিনিকার ও সুরকার ছিলেন নজরুল। পরিচালক ছিলেন দেবকী বসু। বেদে সম্প্রদায়ের জীবনভিত্তিক এ সিনেমাটি দারুণ ব্যবসাসফল হয়েছিল। বেদে জীবন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য নজরুল বেশ কিছুদিন বেদে দলের সঙ্গে ছিলেন। ‘সাপুড়ে’ নামে সিনেমাটির হিন্দি রিমেকও হয়েছিল। তার সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন নজরুল। এছাড়াও ‘রজতজয়ন্তী’ (১৯৩৯), ‘নন্দিনী’ (১৯৪১), ‘অভিনয়’ (১৯৪১), ‘দিকশূল’ (১৯৪১) ইত্যাদি বেশ কয়েকটি সিনেমার গান লিখেছিলেন নজরুল। তার গানগুলো সে সময় লোকের মুখে মুখে ফিরত।

১৯৪১-৪২ সালে ‘মদিনা’ নামে একটি সিনেমার চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন জাতীয় এ কবি। এ সিনেমার জন্য তিনি ১৫টি গান লেখেন। ‘চৌরঙ্গী’ (১৯৪২) সিনেমার গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালকও ছিলেন তিনি। একই বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দিলরুবা’ সিনেমার গীতিকার ও সুরকার হিসাবেও তিনিই ছিলেন। ‘চৌরঙ্গী’ হিন্দিতে নির্মিত হলে সে সিনেমার জন্য ৭টি হিন্দি গান লেখেন নজরুল। এছাড়াও আরও অনেক সিনেমার সঙ্গেই নজরুলের সম্পৃক্ততা ছিল।

এদিকে সিনেমা প্রযোজনায়ও যুক্ত ছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪১ সালে তিনে ‘বেঙ্গল টাইগার্স পিকচার্স’ নামে একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। সেসময় নজরুলের সঙ্গে ছিলেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, হুমায়ূন কবীর, এস ওয়াজেদ আলী, মোহাম্মদ মোদাব্বের, আজিজুল ইসলাম, সারওয়ার হোসেন, আজিজুল হক প্রমুখ।

এদিকে নজরুলের গান ঢাকাই সিনেমায় অসংখ্যবার ব্যবহৃত হলেও তার গল্প উপন্যাস নিয়ে নির্মিত সিনেমার সংখ্যা সীমিত। বাংলাদেশে নজরুলের কাহিনি থেকে প্রথম সিনেমা নির্মাণ করেন খান আতাউর রহমান। কবির পদ্মগোখরা গল্প থেকে নির্মিত এ সিনেমার নাম ‘সুখ-দুঃখ’। অবশ্য এ সিনেমার কাজ শুরু হয় দেশ স্বাধীনের আগেই। মুক্তি পায় স্বাধীনতার বছরে, ১৯৭১ সালে।

স্বাধীন বাংলাদেশে নজরুলের গল্প নিয়ে প্রথম সিনেমা নির্মাণ করেন মুস্তাফিজ। নাম ‘মায়ার বাঁধন’ (১৯৭৬)। এরপর আশির দশকের শেষ প্রান্তে নায়করাজ রাজ্জাক বানান নজরুলের ‘জ্বিনের বাদশাহ’। এতে রাজ্জাকের সঙ্গে অভিনয় করেন তার ছেলে বাপ্পারাজ। তারও দেড় দশক পরে ২০০৪ সালে মতিন রহমান নজরুলের গল্প নিয়ে নির্মাণ করেন ‘রাক্ষুসী’। এতে বড় বউয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন রোজিনা। তার স্বামীর চরিত্রে ফেরদৌস এবং ছোট বউয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন পূর্ণিমা।

২০০৫ সালে গুলজার ও মৌসুমী যৌথভাবে নির্মণ করেন নজরুলের ‘মেহের নেগার’। এতে অভিনয় করেন ফেরদৌস ও মৌসুমী। ২০১৪ সালে গীতালি হাসান নজরুলের ‘অতৃপ্ত কামনা’ গল্প থেকে নির্মাণ করেন ‘প্রিয়া তুমি সুখী হও’। এতে অভিনয় করেন ফেরদৌস ও শায়লা সাবি।

এছাড়া নজরুলের উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’ এবং গল্প ‘ব্যথার দান’ ও ‘পদ্মগোখরা’ অবলম্বনেও সিনেমা নির্মিত হয়েছে। এছাড়া কবির  ‘লিচুচোর’ এবং ‘খুকি ও কাঠবেড়ালি’ কবিতা থেকে দুইটি শিশুতোষ সিনেমাও নির্মিত হয়েছে।

আরো খবর.......

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

“সিনেমায়ও ছিল নজরুলের আধিপত্য”

আপডেট টাইম : ০৫:৩৬:৪৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ মে ২০২৫

বাংলা সাহিত্যের আকাশে ধ্রুবতারা কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী আগামীকাল। তার কবিতা, গান, উপন্যাস ও গল্পে বাঙালি জেনেছে বীরত্বের ভাষা ও দ্রোহের মন্ত্র। বাঙালির সব আবেগ, অনুভূতিতে জড়িয়ে আছেন চিরবিদ্রোহী এ কবি। বিভিন্ন সময় সিনেমার পর্দায় ফুটে উঠেছে জাতীয় কবির গল্প, উপন্যাস ও কবিতা। নিজেও সিনেমা পরিচালনা এবং অভিনয় করেছেন। সিনেমায় কবিকে কীভাবে ও কতটা উপস্থাপন করা হয়েছে তা নিয়েই এ প্রতিবেদন।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সিনেমার সঙ্গে ছিলেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তার গল্প উপন্যাসে একাধিক সিনেমা নির্মাণ হয়েছে। নজরুলের লেখা গান যেমন অনেক সিনেমায় ব্যবহার হয়েছে, তেমনি পরিচালনা ও অভিনয়ও করেছেন তিনি। ‘ধুপছায়া’ নামে একটি সিনেমা পরিচালনা করার পাশাপাশি তাতে তিনি অভিনয় করেছিলেন। এতে দেবতা বিষ্ণুর চরিত্রে রুপদান করেন।

তিনি যখন কাজ করেন, ত্রিশ-চল্লিশ দশকের শুরুতে তখন তিনি ছিলেন বিপুল খ্যাতির অধিকারী। সে সময়ে সিনেমার সংগীত পরিচালনা, সিনেমার গানে কণ্ঠ দেয়া, শিল্পীদের গান শেখানো, যারা অভিনয় করতেন তাদের শুদ্ধ উচ্চারণ শেখানোর দায়িত্ব তিনিই পালন করতেন। ত্রিশের দশকে ম্যাডান থিয়েটার্সের ‘সুর ভান্ডারী’ পদে নিযুক্ত হন নজরুল। এ পদটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। সিনেমায় যারা গাইবেন ও অভিনয় করবেন তাদের গান শেখানো ও উচ্চারণ শুদ্ধ করার দায়িত্ব ছিল তার। শুধু তাই নয়, গান লেখা ও সুর করারও দায়িত্ব পালন করতে হতো নজরুলকে।

১৯৩১ সালে প্রথম বাংলা সবাক সিনেমা ‘জামাই ষষ্ঠী’তে সুর ভান্ডারীর কাজ করেন তিনি। ম্যাডান থিয়েটার্স কোম্পানির আরও যেসব সিনেমার সঙ্গে নজরুল সম্পৃক্ত ছিলেন সেগুলো হলো-‘জ্যোৎস্নার রাত’ (১৯৩১), ‘প্রহলাদ’ (১৯৩১), ‘ঋষির প্রেম’ (১৯৩১), ‘বিষ্ণুমায়া’ (১৯৩২), ‘চিরকুমারী’(১৯৩২), ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৯৩২), ‘কলঙ্ক ভঞ্জন’ (১৯৩২), ‘রাধাকৃষ্ণ’ (১৯৩৩) এবং ‘জয়দেব’ (১৯৩৩)। ১৯৩১ সালে বাংলা সবাক সিনেমা ‘জলসা’য় নজরুল নিজের একটি গান গেয়েছিলেন এবং ‘নারী’ কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলেন।

ম্যাডান থিয়েটার্সের একজন অংশীদার ছিলেন মিসেস পিরোজ ম্যাডান। তিনি ১৯৩৩ সালে পায়োনিয়ার ফিল্মস কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রতিষ্ঠান থেকে ‘ধ্রুব’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করা হয়। পুরাণের কাহিনি নিয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখা ‘ধ্রুব চরিত’ অবলম্বনে সিনেমাটি নির্মিত হয়। নজরুল এ সিনেমার গান লেখেন এবং সংগীত পরিচালনা করেন। তিনি দেবর্ষি নারদের চরিত্রে অভিনয়ও করেন এবং একটি গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি এটি মুক্তি পায়।

এছাড়াও সিনেমার গানে নজরুলের আধিপত্য ছিল বিস্তর। গান লেখার পাশাপাশি সংগীত পরিচালনার গুরু দায়িত্বও তিনিই পালন করতেন। ১৯৩৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পাতালপুরী’ সিনেমার সংগীত পরিচালনা করেন নজরুল। তিনি এবং পরিচালক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ছিলেন এ সিনেমার গীতিকার। এর জন্য ‘ঝুমুর’ সুরে গান রচনা করেন নজরুল। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত ১৯৩৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গৃহদাহ’ সিনেমার সুরকার ছিলেন নজরুল। ১৯৩৭ সালে মুক্তি পায় রহস্য কাহিনিভিত্তিক সিনেমা ‘গ্রহের ফের’। এটিরও সংগীত পরিচালক ও সুরকার ছিলেন নজরুল। ১৯৩৭ সালের সেরা সিনেমা ছিল ‘বিদ্যাপতি’। কবি বিদ্যাপতির জীবনীভিত্তিক এ সিনেমার মূল গল্প ছিল নজরুলের। দেবকী বসু পরিচালিত সিনেমাটির সুরকার ছিলেন নজরুল ও রাইচাঁদ বড়াল। ‘বিদ্যাপতি’র সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দিতে নির্মিত হয় এ সিনেমাটি। এতেও সম্পৃক্ত ছিলেন নজরুল। সেটিও সেসময় ব্যবসাসফল হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৩৮ সালে নির্মিত ‘গোরা’ সিনেমাটির সংগীত পরিচালনাও করেছেন আমাদের জাতীয় কবি। বিশ্বভারতী আপত্তি করে যে, সিনেমাটিতে সঠিকভাবে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া হচ্ছে না। নজরুল তখন সোজা চলে যান রবীন্দ্রনাথের কাছে।

রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে সমর্থন করেন এবং বিশ্বভারতীর সমালোচনা করে বলেন, ‘আমার গান কীভাবে গাইতে হবে সেটা কি তোমার চেয়ে ওরা ভালো বুঝবে?’ তিনি নজরুলকে তার গান নিজের খুশিমতো গাইবার ও ব্যবহারের অনুমতিপত্র দিয়ে দেন। নজরুল সেই সিনেমায় রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি নিজের লেখা একটি গান এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বন্দে মাতরম’ গানটি ব্যবহার করেন। ‘গোরা’তে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার হয়েছিল নজরুলের নিজস্ব শৈলীতে, যা প্রশংসিত হয়েছিল শ্রোতাদের মাঝে।

সে সময় মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হাল বাংলা’ নামে আরেকটি সিনেমার গানেও সুর করেছিলেন নজরুল। সেই সিনেমায় ছোট একটি কৌতুক চরিত্রে অভিনয়ও করেন তিনি। ১৯৩৯ সালে মুক্তি পায় ‘সাপুড়ে’। এর কাহিনিকার ও সুরকার ছিলেন নজরুল। পরিচালক ছিলেন দেবকী বসু। বেদে সম্প্রদায়ের জীবনভিত্তিক এ সিনেমাটি দারুণ ব্যবসাসফল হয়েছিল। বেদে জীবন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য নজরুল বেশ কিছুদিন বেদে দলের সঙ্গে ছিলেন। ‘সাপুড়ে’ নামে সিনেমাটির হিন্দি রিমেকও হয়েছিল। তার সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন নজরুল। এছাড়াও ‘রজতজয়ন্তী’ (১৯৩৯), ‘নন্দিনী’ (১৯৪১), ‘অভিনয়’ (১৯৪১), ‘দিকশূল’ (১৯৪১) ইত্যাদি বেশ কয়েকটি সিনেমার গান লিখেছিলেন নজরুল। তার গানগুলো সে সময় লোকের মুখে মুখে ফিরত।

১৯৪১-৪২ সালে ‘মদিনা’ নামে একটি সিনেমার চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন জাতীয় এ কবি। এ সিনেমার জন্য তিনি ১৫টি গান লেখেন। ‘চৌরঙ্গী’ (১৯৪২) সিনেমার গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালকও ছিলেন তিনি। একই বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দিলরুবা’ সিনেমার গীতিকার ও সুরকার হিসাবেও তিনিই ছিলেন। ‘চৌরঙ্গী’ হিন্দিতে নির্মিত হলে সে সিনেমার জন্য ৭টি হিন্দি গান লেখেন নজরুল। এছাড়াও আরও অনেক সিনেমার সঙ্গেই নজরুলের সম্পৃক্ততা ছিল।

এদিকে সিনেমা প্রযোজনায়ও যুক্ত ছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪১ সালে তিনে ‘বেঙ্গল টাইগার্স পিকচার্স’ নামে একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। সেসময় নজরুলের সঙ্গে ছিলেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, হুমায়ূন কবীর, এস ওয়াজেদ আলী, মোহাম্মদ মোদাব্বের, আজিজুল ইসলাম, সারওয়ার হোসেন, আজিজুল হক প্রমুখ।

এদিকে নজরুলের গান ঢাকাই সিনেমায় অসংখ্যবার ব্যবহৃত হলেও তার গল্প উপন্যাস নিয়ে নির্মিত সিনেমার সংখ্যা সীমিত। বাংলাদেশে নজরুলের কাহিনি থেকে প্রথম সিনেমা নির্মাণ করেন খান আতাউর রহমান। কবির পদ্মগোখরা গল্প থেকে নির্মিত এ সিনেমার নাম ‘সুখ-দুঃখ’। অবশ্য এ সিনেমার কাজ শুরু হয় দেশ স্বাধীনের আগেই। মুক্তি পায় স্বাধীনতার বছরে, ১৯৭১ সালে।

স্বাধীন বাংলাদেশে নজরুলের গল্প নিয়ে প্রথম সিনেমা নির্মাণ করেন মুস্তাফিজ। নাম ‘মায়ার বাঁধন’ (১৯৭৬)। এরপর আশির দশকের শেষ প্রান্তে নায়করাজ রাজ্জাক বানান নজরুলের ‘জ্বিনের বাদশাহ’। এতে রাজ্জাকের সঙ্গে অভিনয় করেন তার ছেলে বাপ্পারাজ। তারও দেড় দশক পরে ২০০৪ সালে মতিন রহমান নজরুলের গল্প নিয়ে নির্মাণ করেন ‘রাক্ষুসী’। এতে বড় বউয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন রোজিনা। তার স্বামীর চরিত্রে ফেরদৌস এবং ছোট বউয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন পূর্ণিমা।

২০০৫ সালে গুলজার ও মৌসুমী যৌথভাবে নির্মণ করেন নজরুলের ‘মেহের নেগার’। এতে অভিনয় করেন ফেরদৌস ও মৌসুমী। ২০১৪ সালে গীতালি হাসান নজরুলের ‘অতৃপ্ত কামনা’ গল্প থেকে নির্মাণ করেন ‘প্রিয়া তুমি সুখী হও’। এতে অভিনয় করেন ফেরদৌস ও শায়লা সাবি।

এছাড়া নজরুলের উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’ এবং গল্প ‘ব্যথার দান’ ও ‘পদ্মগোখরা’ অবলম্বনেও সিনেমা নির্মিত হয়েছে। এছাড়া কবির  ‘লিচুচোর’ এবং ‘খুকি ও কাঠবেড়ালি’ কবিতা থেকে দুইটি শিশুতোষ সিনেমাও নির্মিত হয়েছে।