তনু হত্যার ৯ বছর: এখনও তদন্ত চলছে

- আপডেট টাইম : ০৫:২২:২০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫
- / ৪ ৫০০০.০ বার পাঠক
২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের আবাসিক এলাকায় টিউশনি করাতে গিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী তনু৷ ঘটনার পর সারাদেশে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ প্রথমে থানা পুলিশ, পরে সিআইডি হয়ে এখন মামলাটির তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)৷
সেখানেও একবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে৷ তারপরও মামলার তদন্তে নেই কোনো অগ্রগতি৷ তনু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় তার মরদেহের দুইবার ময়না তদন্ত হয়েছে৷ লাশের জামা কাপড় থেকে নেয়া নমুনার ডিএনএ পরীক্ষায় অন্তত: তিন জন পুরুষের শুক্রাণু পায় সিআইডি৷ কিন্তু ওই তিনজন কে, তা আজো চিহ্নিত করা হয়নি৷
তনুর বাবা ইয়ার হোসেন বৃহস্পতিবার ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘আমি কার কাছে বিচার চাইব? আমি আর বিচার চাই না৷ ৯ বছরে তো কোনো বিচার পাইনি৷ মামলার তদন্তের কোনো অগ্রগতি আমার জানা নেই৷ সেনাপ্রধানকে জিজ্ঞেস করুন৷ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের মধ্যের ঘটনা৷ আপনাদের কাছে বলে আমার কী হবে? আমি তো আসামির নামও বলেছিলাম৷ সার্জেন্ট জাহিদ৷ তাকে তো গ্রেপ্তার করা হয়নি৷”
তনুর বড় ভাই নাজমুল হোসেন বলেন, ‘‘নতুন তদন্ত কর্মকর্তা ফোন করে বলেছেন, আমাদের পরিবারের সবার আবার জবানবন্দি নেবেন৷ আমাদের এতো জবানবন্দি নিয়ে কী হবে? আর কত বার আমরা জবানবন্দি দেব৷ আগের কর্মকর্তারা তো নিয়েছেন৷ তারা তো তদন্তও করেছেন৷ তারা যা পেয়েছেন তা ধরে কাজ করলেই তো হয়৷ একটা ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে ঘটনা৷ সেটা একটা রেস্ট্রিকটেড এরিয়া৷ সেখানে একজন জিওসি আছেন, একজন স্টেশন কমান্ডার আছেন, একজন ব্রিগেড কমান্ডার আছেন৷ তারা থাকার পরও তারা যদি বলেন জানেন না, তাহলে আপনি কী বলবেন? দুনিয়ায় আর কিছু বলার থাকে? আমার বাবা-মা তো বার বার সার্জেন্ট জাহিদের নাম বলেছেন৷ তাকে তো আটক করা হলো না৷ সে এখন কোথায়?”
‘‘এখন মনে হচ্ছে আমাদের মেরে ফেলতে চায়৷ আমাদের হুমকি দেয়া হচ্ছে৷ আমরা দুই ভাই কোথাও যেতে পারছি না৷ আমাদের একরকম ঘেরাও করে রাখা হয়েছে,” বলেন তিনি৷ কারা এসব করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমি কারুর নাম বলতে চাই না৷”
‘তদন্তে অগ্রগতি আছে’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর ইন্সপেক্টর তরিকুল ইসলামের কাছে মামলার তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘মামলার তদন্তে অগ্রগতি আছে৷ তবে এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি৷ অপরাধীদের চিহ্নিত এবং গ্রেপ্তারের বিষয়টি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে৷”
মামলা অভিযোগপত্র দ্রুত দেয়া সম্ভব হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এখনো বলা যাবে না৷ আমরা তদন্ত করছি৷ তদন্ত শেষ হলে বলা যাবে৷ কতজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তাও বলা যাবে না৷ তবে আমরা আবারো নিহতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলব৷”
‘তিনভাগ মামলায় শাস্তি হয়’
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বলছে বাংলাদেশে ধর্ষণসহ নারী-শিশু নির্যাতনের যেসব মামলা হয় তার মধ্যে শতকরা তিনভাগ মামলায় আসামির শাস্তি হয়৷ আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসানও একই কথা বলেন৷ বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷
ইশরাত হাসানের মতে, ‘‘আসলে ধর্ষণ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল কম৷ আর মামলার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে শেষ পর্যন্ত সাক্ষী পাওয়া যায় না৷ থানা সঠিক সময়ে মামলা না নেয়ায় আলামত নষ্ট হয়ে যায়৷ আর ধর্ষণ মামলার আসামি যখন জামিন পায় তখন পরিস্থিতি আরো জটিল হয়৷ প্রভাবশালীরা ভিকটিম ও সাক্ষী সবাইকে হুমকির মধ্যে রাখে৷ ফলে শেষ পর্যন্ত বিচার পান না ধর্ষণের শিকার নারী৷”
মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, ‘‘আমরা যে মামলাগুলোর দায়িত্ব নিই তার প্রায় শতভাগ মামলায় ধর্ষণের শিকার নারী বিচার পান৷ কিন্তু অন্যরা তো পায় না৷ আমরা আইনজীবী নিয়োগ করি৷ সাক্ষীকে আদালতে হাজির করার ব্যবস্থা করি৷ ভিকটিমদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করি৷ সেটা যদি সরকারের পক্ষ থেকে সব মামলার ক্ষেত্রে হতো তাহলে শাস্তির হার বেড়ে যেত৷”
তিনি বলেন, ‘‘কুমিল্লার তনুকে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ভিতরে৷ আমার মনে হয় এটার দায় তারা নিতে চায় না৷ তাই হয়তো ৯ বছরেও এই মামলার তদন্ত শেষ হচ্ছে না৷ এই সরকার এসেও উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ এটার তদন্ত ও বিচার হবে কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে৷”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা ৩০০টি ধর্ষণ মামলা নিয়ে গবেষণা করেছেন৷ তার কথা, ‘‘আমার গবেষণায় আমি দেখেছি ১০ বছর পর্যন্ত যেসব শিশু ধর্ষণের শিকার হয় ওইসব ক্ষেত্রে সময়মতো মামলা হয়৷ ১০ বছরের বেশি বয়সি যারা ১৮ বছর পর্যন্ত যারা তারা কনসিভ করে ফেলে৷ সেক্ষেত্রে অধিকাংশ ঘটনাই সালিশের মাধ্যমে নিস্পত্তি হয়৷”
তিনি বলেন, ‘‘মামলা দায়ের করা থেকে শুরু করে আসামি ধরাসহ সবক্ষেত্রে পুলিশকে টাকা দিতে হয়৷ ফলে টাকার প্রভাবে বিত্তশালী ও প্রভাবশালীরা মামলাগুলোকে শেষ পর্যন্ত অচল করে দেয়৷”
সম্প্রতি বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই দুই মাসে ৮৫টি ধর্ষণ এবং সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷ তবে মামলা হয়েছে ৭০টি৷ আর ৪ থেকে ১২ বছর বয়সি ২০টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ ২০২৪ সালে ৪০১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷
আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ
সম্প্রতি মাগুরায় শিশু ধর্ষণের পর সারাদেশ উত্তাল হয়ে উঠলে সরকার আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়৷ বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সভায় মামলার তদন্তে ১৫ দিন এবং বিচারের জন্য তিন মাস সময় নির্ধারণ করে দিয়ে আইন সংশোধন অনুমোদন করা হয়েছে৷ বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের শাস্তি করা হয়েছে সাত বছরের কারাদণ্ড৷ আর মৃত্যুদণ্ডের বিধান বহাল আছে৷
অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘তদন্ত ও বিচারের সময় কমিয়ে কোনো লাভ নেই৷ প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিচারক ও আদালত৷ আর সময় নির্ধারণ করে দিলেও আপিল আদালতে তো আর সময় নির্ধারণ করে দেয়া যায় না৷”
মালেকা বানু বলেন, ‘‘আইন পর্যাপ্ত আছে৷ প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ এবং বিচার পাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা৷”
বাংলাদেশে যেসব ধর্ষণের ঘটনা আলোচিত হয়, সেইসব মামলায় বিচার পাওয়া যায়৷ দেখা যায় ওই দুই-একটি মামলার বিচার হলেও বাকিগুলোর খবর থাকে না, বলেন ইশরাত হাসান৷
২০২০ সালের ৩ অক্টোবর কুষ্টিয়ার মিরপুর থানা এলাকায় মাদ্রাসার ৮ম শ্রেণির ছাত্রী ধর্ষণ মামলায় দ্রুত তদন্ত ও বিচারের রায় দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়৷ ওই মামলায় ১০ দিনে চার্জশিট এবং বিচার শুরু হওয়ার তিন দিনের মধ্যে রায় দেয়া হয়৷ রায়ে মাদ্রাসার সুপার মাওলানা আব্দুল কাদেরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ২০১৮ সলের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাতে ধানের শীষে ভোট দেয়ায় ধর্ষণের শিকার হন এক গৃহবধু৷ ওই মামলায় রায় দেয়া হয় ২০২৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি৷ রায়ে ১০ জনের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়৷
২০১৯ সালের মার্চে ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী ছাত্রীকে শ্লীলতাহানি ও হত্যা মামলায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলাসহ ১৬ জনকে ওই বছরেরই ২৪ অক্টোবর আদালত ফাঁসির আদেশ দেন৷
কিন্তু ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেট এমসি কলেজ হোস্টেলে তরুণী ধর্ষণ মামলার বিচার এখানো শেষ হয়নি৷
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘নানা প্রক্রিয়ায় ধর্ষণের ঘটনার বিচার বাধাগ্রস্ত করা হয়৷ তারমধ্যে একটি প্রক্রিয়া আছে ধর্ষকের সাথে বিয়ে দিয়ে সমাধান করা৷ নারী অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হলে টাকা পয়সা দিয়ে মীমাংসা করা হয়৷ আর রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা বিচারের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে৷”
তিনি বলেন, ‘‘কুমিল্লার তনু ধর্ষণ এবং হত্যা হয়েছে ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে৷ এই কারণে কর্তৃপক্ষ তাদের গায়ে আঁচড় যাতে না লাগে সেজন্য এই মামলাটির সুরাহা এখনো হয়নি৷ কর্তৃপক্ষ চাইলে অনেক আগেই এর তদন্ত এবং বিচার হয়ে যেত৷।