ক্ষীণতর হচ্ছে সুস্থতার পরিসর
- আপডেট টাইম : ০৬:৪৮:৪১ পূর্বাহ্ণ, মঙ্গলবার, ২১ নভেম্বর ২০১৭
- / ৫৬৬ ৫০০০.০ বার পাঠক
যখন অমর্যাদার মাত্রা জীবনের সব সীমা অতিক্রম করে তখন একান্ত নিজস্বতাটুকুও থাকেনা। তাদের সব গ্রাস করে নেয় চাড়ালরা। সংখ্যালঘুদের একমাত্র আশ্রয় জমি, বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়ার চেষ্টা যখন সম্মিলিতভাবে হয় তখন তাদের আর কোনও উপায় থাকে না। তাদের সামনে বেঁচে থাকার অন্য কোনও বিকল্পও থাকেনা। সর্বনাশের এই তীরে আমরা যারা সহমর্মিতা জানাই তারা নিজেরাও আজ আক্রান্ত। এ এক ভয়ংকর খেলা। এই খেলার নিয়ম, সময় ও প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক যারা তারা ধর্ম ব্যবসায়ী এবং ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’, আবার এইসব অকল্যাণকারীদের জীয়নকাঠি।
অস্থিরতা ছড়াতে যারা সক্রিয় তারা কোন মতামত, কি তাতে বলা হয়েছে তার ধার ধারেনা। শুনেই সবকিছু ধ্বংস করতে পারে। কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের পর রংপুরের তাণ্ডব দেখলাম আমরা। এমন অনেক ঘটনা হর হামেশা ঘটছে। আমাদের দীর্ঘ দিনের প্রচলিত ধারণা, উদারতা ও অসাম্প্রদায়িকতাকে দাঁড়াতেই দিচ্ছেনা একটি চক্র যারা মুখে আবার ইনসাফের বয়ান দেয়। ধর্মের নামে যারা রাজনীতি করছে তাদের নানা পথ, নানা মত। কিন্তু পুরো সমাজকে কলুষিত করতে এরা এখন একত্রিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে হিন্দুদের উপর, রক্তের খেলায় মেতে উঠতে ব্যবহার করছে ফেসবুককে। আবার যারা এসব ঘটনার নিন্দা করে তাদেরও সমস্বরে আক্রমণ করছে এই সভ্যতা বিরোধী শক্তি।
‘প্রশ্ন উঠে মুষ্টিমেয় বিপথগামী উগ্রপন্থীই কি তবে শাসনপ্রণালীর এজেন্ডা স্থির করে দিবে আর প্রশাসন সে অনুযায়ী চলবে? কিন্তু আমরাতো জানি জনসাধারণের মতপ্রকাশের, ভিন্নমত পোষণের কিংবা শুনবার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সাংবিধানিক দায় নির্বাচিত সরকার পরিচালিত প্রশাসনের।’
অপছন্দের মতামত দমন করার শ্রেষ্ঠ উপায় হলো সেই মত পোষণকারী বা প্রচারকারীকে দমন করা। সবচেযে বড় অস্ত্র অশ্লীল কথা বলে মর্মে আঘাত করা। চাপটা এমন যে, যারা কথা বলার তারা হঠাৎই চুপ হয়ে যায়। নয়তো তার বিরুদ্ধে কেউ লেগে যাবে, তাকে ধর্মীয়ভাবে আঘাতের চেষ্টা হবে।
অসহিষ্ণুতা আমাদের দেশে পুরনো এবং পরিচিত ব্যাধি। যখনই কেউ বেচাল কথাবার্তা বলেছেন বা ক্ষমতাবানদের পক্ষে অস্বস্তিকর কোন কাজ করেছেন, বরাবর এবং বারবার তাদের দমনের ব্যবস্থা হয়েছে। গণতান্ত্রিক, খোলামেলা যুক্তির পরিসর সবসময় কাম্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সেই পরিসরটা এ দেশে প্রায় সর্বত্রই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।
এরা আক্রমণ করে, এরা উস্কানি দেয়, এরাই আবার ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর বিবৃতি দিয়ে নিন্দা করে, বলার চেষ্টা করে সংখ্যালঘুরা আমানত। কিন্তু এই আমানতের খেয়ানতে তারাই সামনের কাতারের সৈনিক। তারা শান্তি চায় না, প্রগতি চায় না। চায় অবস্থা উত্তরোত্তর খারাপ হোক, অশান্ততর হোক। এই মরণখেলায় কে হারে কে জেতে সে প্রশ্ন নেই। শুধু একটা কথা ঠিক, মরণখেলার উন্মাদনার চোটে ক্রমেই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে আমাদের সুস্থতার পরিসর।
অসংবেদী প্রতিক্রিয়ার ছায়া পড়ছে সবখানে। কোন কথা কারো জন্য অস্বস্তিকর হতেই পারে। কিন্তু ব্যক্তি আর গোষ্ঠীকে টার্গেট করে হেনস্তা করার মাঝে অসহনশীলতার সংস্কৃতির গন্ধ পাওয়া যায়। এই বাংলাদেশ থেকে লেখকদের এক সময় উন্মত্ততা দেখিয়ে বিদায় করা হতো। কিছুদিন চললো লেখক ব্লগারদের জবাই করা। লেখার জবাব লেখা দিয়ে দেয়া হয়নি। প্রয়োগ হয়েছে গায়ের জোর। কায়েমি স্বার্থান্বেষী মৌলবাদী ও রাজনীতিকদের সংগঠিত চক্রান্ত শুরু হয় যেকোন আলোকিত মানুষের বিরুদ্ধে যখন তখন। সমস্যা হলো, মৌলবাদি এই চক্রান্তের জালে পা দেয় উদারপন্থি দল, গোষ্ঠী এবং ব্যক্তিও।
প্রশ্ন উঠে মুষ্টিমেয় বিপথগামী উগ্রপন্থীই কি তবে শাসনপ্রণালীর এজেন্ডা স্থির করে দিবে আর প্রশাসন সে অনুযায়ী চলবে? কিন্তু আমরাতো জানি জনসাধারণের মতপ্রকাশের, ভিন্নমত পোষণের কিংবা শুনবার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সাংবিধানিক দায় নির্বাচিত সরকার পরিচালিত প্রশাসনের। আমাদের আসলে ঠিক করা প্রয়োজন- দেশ গণতন্ত্রে স্থিত থাকবে, না যূথবদ্ধ অন্যায়ের নিকট আত্মসমর্পণ করবে? সরকার কি বুঝতে পারছে এই গোষ্ঠীর কাছে আত্মসমর্পণ মানে সর্বনাশের পথে হেঁটে যাওয়া?
আমাদের দেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠীটি উগ্র। এদের সাথে যোগ দিয়েছে একটা শিক্ষিত শ্রেণি যারা মুখে বড় পরিসরের কথা বললেও কাজে উল্টোটা করে। ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে এরা চায় নিজেদের ‘মানুষ’, যারা তার হয়ে কাজ করবে। এই দর্শন চায় প্রশ্নহীন আনুগত্য। আর সেই চাহিদা না মিটলেই অসহিষ্ণুতা প্রকট হয়। তারা গালির বন্যা বইয়ে দেয় কারো দেয়ালে গিয়ে। তবুও শান্তির স্বার্থে নির্ভেজাল অন্যায়ের সামনে মৌন অবলম্বন করেই থাকতে হচ্ছে ভদ্র আত্মাদের।
এই গোষ্ঠী ধর্মের সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির বিরোধ তৈরি করতে চায়। যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে দেশে যেভাবে বিরোধিতা হয়েছে, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ আর সহিংসতা ছড়ানো হয়েছে সেগুলো ছিল জাতীয় স্বার্থ বিরোধী। একাত্তরের পরাজিত ঘাতক শক্তিই এই নব্য ধর্মীয় বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে লালন পালন করছে। এদের কেউ কেউ এক সময় প্রগতির রাজনীতি করেছে, কিন্তু অর্থের কাছে নিজেকে সঁপে চরম প্রতিক্রিয়াশীল হয়েছে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সামনে এরা বড় চ্যালেঞ্জ। অভীষ্ট অর্জনে সরকারকে প্রগতিশীলদের আরও কাছে টানতে হবে, বলার ও ভাবার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে আরও উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু উল্টোটাই বেশি লক্ষ্যণীয়। সরকারকে মনে রাখতে হবে উগ্রবাদীদের তোষণ করার নীতি বা কৌশল কোনও মঙ্গল বয়ে আনবে না। উগ্রবাদীদের ঔদ্ধত্যই কেবল বাড়বে, ঘটবে আরও রংপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো ঘটনা।
সাধারণ মানুষের প্রত্যাশায় স্বাধীনতার রাজনীতিই আসল রাজনীতি। যেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা সেখানেই ভেদাভেদ ভুলে একটি সর্বমানুষের মিলনক্ষেত্র তৈরি করতে হবে, একত্রিত হতে হবে। ওদের তোষণ করে শাসক গোষ্ঠীর বর্তমান ও আগামী কোনটাই নিশ্চিত করা যাবেনা।