নিয়োগের পথে ৩ হাজার পুলিশ: কী বলছেন আইনজীবী ও রাজনীতিকরা
- আপডেট টাইম : ০৫:৫৩:০৬ পূর্বাহ্ণ, রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪
- / ৩৬ ৫০০০.০ বার পাঠক
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া তিন হাজারেরও বেশি পুলিশের নিয়োগ চূড়ান্ত হতে যাচ্ছে। এদের একটি বড় অংশ দলীয় বিবেচনায় গোয়েন্দা ছাড়পত্র পেয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া প্রার্থী বাছাইয়ে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের প্রাধান্য দেওয়া হয় বলে বিতর্কিত এই নিয়োগ প্রক্রিয়া অবিলম্বে বাতিল বা বন্ধের দাবি তুলছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতেই উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার বিশাল জনবল নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। সোমবার (১৪ অক্টোবর) থেকে তাদের মৌখিক পরীক্ষা শুরু হবে। মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন হলেই তারা প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হবেন। এটিই পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগের চূড়ান্ত ধাপ হিসাবে বিবেচিত।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের রিক্রুটমেন্ট অ্যান্ড ক্যারিয়ার প্ল্যানিং-২ শাখার বর্তমান এআইজি ড. চৌধুরী মো. যাবের সাদেক যুগান্তরকে বলেন, ৩ হাজার ২৬৯ জন লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছেন, যাদের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার তারিখ দেওয়া হয়েছে। এখানে দলীয় বিবেচনার বিষয়টি আমার জানা নেই। উপর থেকে যেভাবে নির্দেশনা আসে, আমরা কেবল সেটি অনুসরণ করি।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের শুরুর দিকে এসআই (নিরস্ত্র) পদে নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পুলিশ সদর দপ্তর। আবেদনের সময়সীমা ছিল ২ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। মার্চের ৫, ৬ ও ৭ তারিখ সারা দেশে মাঠ বাছাই পরীক্ষা এবং ২২ ও ২৩ মার্চ লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
৯ জুন পুলিশ সদর দপ্তর লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে। এতে ৩ হাজার ২৬৯ জন প্রার্থী উত্তীর্ণ হন বলে ‘রিক্রুটমেন্ট অ্যান্ড ক্যারিয়ার প্ল্যানিং-২ শাখা’র সাবেক এআইজি মোহাম্মদ আমজাদ হোসাইন স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, গত ৭ অক্টোবর পুলিশ সদর দপ্তরের রিক্রুটমেন্ট অ্যান্ড ক্যারিয়ার প্ল্যানিং-২ শাখার বর্তমান এআইজি ড. চৌধুরী মো. যাবের সাদেক স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে মৌখিক পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়।
এতে বলা হয়, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ‘বুদ্ধিমত্তা ও মৌখিক পরীক্ষা’ পুলিশ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত হবে। উত্তীর্ণ প্রার্থীদের প্রবেশপত্র, শিক্ষাগত ও অন্যান্য যোগ্যতার প্রমাণপ্রত্র এবং প্রযোজ্য কোটার প্রমাণ সংক্রান্ত নথিপত্র হাজির করতে হবে। ১৪ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত এ পরীক্ষা চলবে।
আওয়ামী লীগ আমলের বাছাই করা প্রার্থীদের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পুরিশের বহু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। সংস্কারপন্থি একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দলীয় বিবেচনায় ১০ হাজারের মতো এসআই নিয়োগ দিয়ে গেছেন। নিয়োগের ক্ষেত্রে গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরসহ নির্দিষ্ট কয়েকটি জেলা এবং আওয়ামী পরিবার ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং আওয়ামীপন্থি পুলিশের প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট নিয়োগের চূড়ান্ত তালিকা করতেন। গত সরকারের সময় এসআই ছাড়াও অন্যান্য পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও দলীয় বিবেচনা প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তারা বলেন, বর্তমানে ৩ হাজারের বেশি এসআই নিয়োগ নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তাদেরকে আওয়ামী লীগ আমলে বাছাই করা হয়েছে। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এই প্রার্থীদের ক্ষেত্রে আগের মতোই দলীয় বিবেচনা প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যারা কেবলমাত্র আওয়ামী পরিবারের সদস্য তাদের পক্ষেই গোয়েন্দা ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা বলেন, সাবেক আইজিপি শহীদুল ইসলাম, বেনজীর আহমেদ ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের সময়ে বেশিরভাগ নিয়োগে দলীয় পরিচয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামসহ আরও অনেকে নেপথ্যে থেকে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করতেন।
এছাড়া মাঠ পর্যায়ে আরও কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা ভূমিকা পালন করতেন। সেই কর্মকর্তাদের অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। অনেকে আবার খোলস বদলে বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিং নিয়েছেন। আওয়ামী লীগ আমলের সুবিধাভোগী সেসব শীর্ষ কর্মকর্তারাই আওয়ামী আমলে বাছাই করা প্রার্থীদের বর্তমানে নিয়োগ দিতে এত তোড়জোড় করছেন। তাদেরকে নিয়োগ দিয়ে মূলত স্বৈরাচার সরকারকে পুনর্বাসন করতে চাচ্ছেন।
সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ এত বেশি দলীয় নিয়োগ দিয়েছে যে, তারা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছে। শুধু দলীয় লোকদের নিয়োগই দেয় নাই, তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করেছে। এ কারণে আজকে দেশের এ দুরবস্থা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নতুন সরকার আসার পরে সঠিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। ফ্যাসিবাদের দোসররা নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যাচ্ছে। এজন্য স্বৈরাচার সরকারের বাছাই করা লোকদের বাদ দিয়ে সব নিয়োগ নতুনভাবে শুরু করতে হবে।
সুপ্রিমকোর্টের আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, শুধু দলীয় বিবেচনায় বাছাই করা হয়ে থাকলে, সেটি ঠিক হয়নি। এক্ষেত্রে বর্তমানে যারা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আছেন, তাদের বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগরী উত্তরের প্রচার সম্পাদক আতাউর রহমান সরকার যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ কখনো দেশের জন্য কাজ করেনি। দলীয়করণ, আত্মীয়করণ করে প্রশাসন যন্ত্রের প্রতিটি জায়গা ধ্বংস করে ফেলেছে। তাদের আমলে নিজ দলের লোকজনকে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়ার জন্য যাদেরকে মৌখিক পরীক্ষা পর্যন্ত নিয়ে এসেছে, তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় বাতিল করতে হবে। এ ধরনের নিয়োগ দেশবাসী মানবে না।
এদিকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যুক্ত পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এসআই নিয়োগে প্রাথমিক বাছাই, লিখিত পরীক্ষাসহ কয়েকটি ধাপে পরীক্ষা নেয় পুলিশের রেঞ্জ কার্যালয়। পরে পুলিশ সদর দপ্তরের পাঁচ সদস্যের কেন্দ্রীয় দল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার (ভাইভা) নেয়। ওই সাক্ষাৎকারের পর নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়।
পিআরবির ৭৪১ ও ৭৪২ প্রবিধান অনুযায়ী, এসআই পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষা, ভাইভা ও চূড়ান্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষে সারদায় পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। সেখানে উত্তীর্ণরা শিক্ষানবিশ এসআই হিসাবে প্রাথমিক নিয়োগ পান।
এ বিষয়ে রিক্রুটমেন্ট অ্যান্ড ক্যারিয়ার প্ল্যানিং-২ শাখার সাবেক এআইজি মোহাম্মদ আমজাদ হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, দলীয় বিবেচনায় নিয়োগের অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা। ২০২১ সালের পর থেকে গত ৪ বছর ধরে যে নিয়োগ পদ্ধতি চালু হয়েছে, সেখানে লিখিত পরীক্ষার আগে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কোনো সুযোগই নেই। মাঠে সাত দফা পরীক্ষা নিয়ে বাছাই করা হয়। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও পুলিশ সদর দপ্তর করে। প্রশ্নও এক ঘণ্টা আগে ছাপানো হয়। কোনটি কার খাতা সেটি বোঝারই সুযোগ নেই।