ভয়াল সিডর আজ অতিক্রম করল ১৪ বছর: স্থাপিত হয়নি শক্ত বেড়িবাঁধ,আতঙ্ক কাটেনি এই জনপদের।
- আপডেট টাইম : ১০:২৮:৫৭ পূর্বাহ্ণ, সোমবার, ১৫ নভেম্বর ২০২১
- / ২১৯ ৫০০০.০ বার পাঠক
নুরুল আমিন মিল্টন বরগুনা থেকে।।।
আজ ১৫ নভেম্বর। উপকূলবাসীর ইতিহাসে বিভীষিকাময় একটি দিন। প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় উপকূলীয় এলাকা বরগুনা। এই দিনটি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে এখনও এক দুঃস্বপ্ন। ভয়াল ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে সেদিন উপকূলীয় এলাকা দেখেছিলো ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ। শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিল হাজারো মানুষ। নিখোঁজ হয়েছিল আরও সহস্রাধিক। ঘরবাড়ি আর সহায় সম্বল হারিয়ে মানুষ হয়ে পড়ে অসহায়। সিডরের ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত ধকল কাটেনি উপকূলবাসীর। ক্ষত চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন নিহতের স্বজনরা।
২০০৭ সালের এদিনে ঘূর্ণিঝড় সিডরে বরগুনা জেলায় সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১ হাজার ৩৪৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিখোঁজ ছিলেন আরও ১৫৬ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। আর আহতের সংখ্যা ২৮ হাজার ৫০ জন। এ জেলার ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬১ পরিবারের মধ্যে বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৭৮৫ টি, ফসলের ক্ষতি হয়েছে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৩৯৩ একর, গবাদি পশু মারা গেছে ৩০ হাজার ৪৯৯টি, ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ২৩৫, ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা ৪২০ কিলোমিটার। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্য আরো বেশি।
সিডরের ভয়াবহ তান্ডবের ক্ষত ১৪ বছরেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি উপকূলের মানুষ। এর পর একের পরে এক করে আঘাত হানে দানবীয় ঝড় বুলবুল, আইলা, মহাসেন, ফনিসহ বিচিত্র নামের সব ঘূর্ণিঝড়। এতে কম বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলীয় জেলা বরগুনা। বসত বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, গাছপালা, ফসলের মাঠসহ প্রায় প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়েই প্রানহানীর মত ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার।
দূর্যোগকালীন সময়ে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের যথাসময়ে আশ্রয় কেন্দ্রে না যাওয়ার ব্যাপারে এখনো তাঁদের আমরা সচেতন করে গড়ে তুলতে পারিনি। পাশাপাশি দূর্যোগ সহনশীলতার মানসিকতা, অর্থাৎ, যা হয় হোক, ঘরেই থাকবো এমন মানুষিকতার কারণেই এরকম ঘটনা। এ ব্যাপারে আরো কাজ বাকি রয়েছে বলেই আমি মনে করি। আমাদের প্রথমে প্রয়োজন সুরক্ষার স্বার্থে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের সচেতন করে তোলা।
সিডরের এমন ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার যথাসাধ্য উদ্যোগ গ্রহন করে। পাশাপাশি দেশী ও বিদেশী দাতা সংস্থাও এগিয়ে আসে। একের পর এক উন্নয়ণ পরিকল্পনায় ফের যখনই ঘুরে দাড়ানোয় মানুষের প্রানান্ত প্রচেষ্টা, ঠিক তখনি কোনো না কোনো দূর্যোগের ঘনঘটা শুরু হয়। চলে নিয়ন্ত্রহীন দানবীয় ঘূর্ণিঝড়ের একের পর এক তান্ডবলীলা। আর এসব মোকাবেলা করতে এখন অনেকটাই অভ্যস্ত এলাকার মানুষ। ফের সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয় ক্ষত কাটিয়ে ওঠার। সিডরের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বরগুনা সদর উপজেলার নলটোনা ও কাকচিড়া ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের ২৯ জনের মৃত্যু হয়। একের পর এক মরদেহ উদ্ধারের পরে তাদের এক স্থানে দাফন দেয়া হয়। সাড়িসাড়ি সেই কবরের স্থানটিতে এ বছর নির্মিত হয়েছে সিডর স্মৃতিসৌধ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বরগুনা কার্যালয়ের তথ্যমতে, সিডরের আঘাতে জেলার সাড়ে ৯শ’ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের প্রায় সাড়ে পাঁচশ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সিডর পরবর্তি আইলা, মহাসেন, ফণীসহ একাধিক প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে পায়রা বলেশ্বর ও বিষখালী নদী তীরবর্তি বন্যা নিয়ন্তন বাঁধগুলো নাজুক হয়ে পড়ে। বাঁধের কিয়দংশ সংষ্কার ও রিং বেড়িবাধ দিয়ে আপাতত জানমাল রক্ষা হলেও ফের বুলবুলের আঘাতে জেলার ৩৭ কিলোমিটার বাঁধ ঝুকিঁপূর্ণ অবস্থায়। স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতেই ওইসব এলাকা প্লাবিত হয়। পানিতে নিমজ্জিত হয় বসত-ভিটা, লোকালয় ও ফসলী জমি। চরম শংকায় দিন কাটে বাঁধের পাড়ের বাসিন্দাদের, ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক। স্থানীয়দের দাবি, নদী শাসন করে স্থায়ী সুরক্ষা বাঁধ নির্মাণই একমাত্র কার্যকরি সমাধান, এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকার সুরক্ষা সম্ভব না। তাদের অভিযোগ, মানুষের জানমাল রক্ষার্থে কর্তৃপক্ষের মনোভাব অনেকটাই দায়সারা। রিং বাঁধ নির্মাণ করে আপাতত দায় এড়িয়ে যান তারা।
বরগুনায় সিডরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নলটোনা ও কাকচিড়া ইউনিয়নের বাসিন্দারা। এর অন্যতম কারণ ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ না থাকা । এই বাঁধ ভেঙে ও প্লাবিত হয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। আর মধ্যরাতে পানির তোড়ে ভীত মানুষজন ছোটাছুটি করতে গিয়ে গাছ চাপাও প্রবল স্রোতে ভেসে মারা যায়। ১৪ বছর পরেও সেখানকার চিত্রটি অভিন্ন নয়। এখানের এখনো ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার এলাকার বাঁধের এক তৃতীয়াংশ টিকে আছে। তিন তিনবার রিং বাঁধ দেয়া হয়েছে, কিন্ত একটিও টিকে নেই, না থাকারই কথা। কারণ নদী শাসন করে ব্লক দিয়ে স্থায়ী সুরক্ষা ব্যতীত উপকূলীয় এলাকাগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের রক্ষার সুযোগ নেই।
বরগুনা সদরসহ পাথরঘাটা,কাকচিড়া, বামনা, বেতাগী, তালতলী ও আমতলী উপজেলার বিষখালী বলেশ্বর ও পায়রা নদী তীরবর্তি ঝূঁকিপূর্ণ বাঁধ এলাকার বাসিন্দাদের একই অবস্থা। দূর্যোগের ঘনঘটনায় এদের যেমন আতংকে নির্ঘুম রাত কাটে তেমনি অরক্ষিত থাকেন বছরজুড়ে প্রকৃতির রুদ্ররোষে।