বঙ্গবন্ধুর মুক্তিতে ইন্দিরা, আবু সাঈদ চৌধুরীসহ বিশ্ব নেতাদের অবদান
- আপডেট টাইম : ০৬:৩৬:৪৫ অপরাহ্ণ, সোমবার, ৪ জানুয়ারি ২০২১
- / ৩২৭ ৫০০০.০ বার পাঠক
সময়ের কন্ঠ রিপোর্ট।।
৫ অগাস্ট ১৯৭১ ইয়াহিয়া ঘোষণা করে যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে বিচার করা হবে। ইয়াহিয়া আরও বলেছিল, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি নাগরিক বিধায় তার বিচার পাকিস্তানেই হবে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পাকিস্তানি পরিকল্পনা জানার পরপরই যারা তার মুক্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করেছিলেন তাদের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং মুজিবনগরভিত্তিক বাংলাদেশ সরকারের নিযুক্ত বিদেশ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে ইয়াহিয়ার ঘোষণার বহু আগেই জুলাই মাসের শুরুতে হেনরি কিসিঞ্জার দিল্লি এলে ইন্দিরা গান্ধী তাকে পরিষ্কার বলে দেন শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পাকিস্তানি জান্তার ওপর চাপ প্রয়োগ এবং পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য বন্ধ করতে হবে।
তাছাড়া ইন্দিরা গান্ধী জুন মাসেই তার শিল্পমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীকে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, সুইডেন, হল্যান্ড এবং ইতালির সরকার প্রধান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী ওইসব দেশের শীর্ষ নেতাদের সাথে আলাপকালে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির যে কোনো বিকল্প নেই সেই কথা স্মরণ করিয়ে দেন। ইন্দিরা তার অন্য ৩ জন মন্ত্রীকেও বিভিন্ন দেশে একই উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলেন একই সময়।
তবে ইন্দিরার যে পন্থা বিশ্ব নেতাদেরকে পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়োগে সর্বাধিক উদ্বুদ্ধ করেছিল সেটি ছিল তার ১৯৭১ সালের ১০ অগাস্ট বিশ্বের সকল সরকার প্রধানকে লেখা চিঠি। সে চিঠিতে ইন্দিরা বঙ্গবন্ধুর প্রহসনের বিচার বন্ধের জন্য ইয়াহিয়ার ওপর বিশ্ব নেতাদের চাপ দেওয়ার অনুরোধ করে লেখেন, “ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন সামরিক কায়দায় বিচার করতে যাচ্ছে শুনে ভারতের সরকার, জনগণ, সংসদ এবং সংবাদকর্মীরা গভীরভাবে মর্মাহত। আমাদের ভয় এই তথাকথিত বিচারের নামে তারা শেখ মুজিবকে হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনা করছে। এটি পূর্ব বাংলার পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাবে এবং এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ভারতেও ছড়িয়ে পড়বে, কেননা ভারতের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলো এটিকে সহজভাবে নেবে না। আমরা এ খবরে চরম উৎকণ্ঠিত। আপনাদের কাছে আমাদের আবেদন আপনারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে এই কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য তার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন, যা এই অঞ্চলের শান্তি ও শৃঙ্খলার জন্য অপরিহার্য।” (সূত্র ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ১০ অগাস্ট, ১৯৭১)
ইন্দিরা গান্ধী ৭১-এর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য জোরালো দাবি উত্থাপনের জন্য তার অতি পারদর্শী এবং সুবক্তা পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংকে পাঠিয়েছিলেন। বাংলাদেশে পাকিস্তান অমানবিক সমস্যা সৃষ্টি করেছে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে অবশ্যই মুক্তি দিতে হবে ও তার বিচারের চিন্তাকে প্রহসন বলে ২৭ সেপ্টেম্বর শরণ সিং কঠোর ভাষায় বক্তব্য দেওয়া শুরু করলে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আগাশাহী বৈধতার প্রশ্ন তুলে বলেন, “জাতিসংঘে কোনো দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে আলোচনা হতে পারে না।”
কিন্তু সৌদি দূত দাঁড়িয়ে বলেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বাধা দেওয়া যায় না; তবে তার বক্তৃতায় যে অংশে পূর্ব পাকিস্তানের উল্লেখ আছে সে অংশ বাদ দিলে কোনো রূপ আপত্তির কারণ থাকবে না। তখন সে বছর সাধারণ পরিষদের সভাপতি ইন্দোনেশিয়ার আদম মালিক শরণ সিংকে পূর্ব পাকিস্তান অংশ বাদ দিতে রাজি কিনা জিজ্ঞেস করলে শরণ সিং বলেন, “পাকিস্তানের সীমাহীন নিপীড়ন ও নির্যাতনের ফলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে, এটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বললে আন্তর্জাতিক আইনকে উপহাস করা হবে।”
শরণ সিং এ সমস্যার সমাধানকল্পে অবিলম্বে শেখ মুজিবের আশু মুক্তির দাবি জানান। শরণ সিং বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে হলেই সেটিকে শেখ মুজিব এবং অন্যান্য নির্বাচিত সদস্যদের নিকট গ্রহণযোগ্য হতে হবে। শরণ সিংয়ের জোরালো ভাষণে অভিভূত হয়ে মুজিবনগরভিত্তিক বাংলাদেশ সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, যিনি তখন তার ১৬ সদস্যের দল নিয়ে জাতিসংঘের দর্শকদের গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলেন, সৈয়দ আব্দুস সুলতান এবং এ এইচ মাহমুদ আলীকে নিয়ে অধিবেশন শেষে শরণ সিংয়ের হোটেলে গিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আসেন। (সূত্র: বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রণীত ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো’, পৃষ্ঠা-১৭৭)
অগাস্ট মাসে ভারতের এক সময়ের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, সেই সময়ের সংসদ সদস্য কৃষ্ণ মেনন লন্ডনে তার বন্ধু বৎসল প্রভাবশালী নেতাদের নিকট বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার আবেদন নিয়ে যুক্তরাজ্যে গমন করেন। সাথে ছিলেন সুপরিচিত সাংবাদিক তারাপদ বসু। কৃষ্ণ মেনন সেই উদ্দেশ্যে লন্ডনে ব্যস্ত সময় কাটান (বিচারপতি চৌধুরীর উল্লিখিত বই, পৃষ্ঠ ৯৬)
২৭ নভেম্বর ইন্দিরা গান্ধী ইয়াহিয়াকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির দাবি জানিয়ে লিখেছিলেন, “বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানে আসুন এবং অবিলম্বে মুজিবকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা নিন।” ইন্দিরা গান্ধী তার এ দাবি ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্রী অটলের মাধ্যমে প্রেরণ করেন। (সূত্র: দৈনিক আনন্দবাজার, ২৮ নভেম্বর ১৯৭১)
অগাস্ট মাসে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে শেখ মুজিবের জীবন রক্ষার আবেদন করা হয়। ১০ অগাস্ট তার গোপন বিচার শুরুর পর এ তৎপরতা পৃথিবীর সর্বত্র বৃদ্ধি পায়। ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের নিকট এ বেআইনি বিচার বন্ধের জন্য সর্বপ্রকার পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান। (সূত্র: বিচারপতি চৌধুরীর উল্লিখিত বই, পৃষ্ঠা ৯৩)।
ভারতীয় পার্লামেন্টে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পশ্চিমা বিশ্বের সিভিল সোসাইটি এবং জনমত এবং ওইসব দেশের নেতাদের অনেকেই অনুধাবন করতে পেরেছেন যে শেখ মুজিবের মুক্তি অপরিহার্য। ইন্দিরা গান্ধী বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং পশ্চিম জার্মানি ভ্রমণ শেষে পার্লামেন্টে বলেছিলেন ‘বেশিরভাগ দেশই মনে করে যে শেখ মুজিবের মুক্তি একান্ত জরুরি এবং তারা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের এ ব্যাপারটি উপলব্ধি করাতে চাপ প্রয়োগ করতে চান।
৭ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে সেখানকার এনবিসি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, “সমস্যার আজ একমাত্র সমাধান পূর্ব বাংলার জনগণের নেতা শেখ মুজিবের সাথে পাকিস্তানি শাসকদের আলোচনা। তারা শেখ মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক ঘোষণা করে গ্রেপ্তার করেছে, সেটা কোনো বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বহন করে না। এটা ছাড়া কোনো সমাধান হতে পারে না।”
আর এক প্রশ্নের জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, “আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমাদের কোনো বৃহৎ শক্তি ইয়াহিয়াকে বাধ্য করতে পারে শেখ মুজিবের সাথে আলোচনায় বসতে।”
বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে মুজিবনগর ভিত্তিক বাংলাদেশ সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত বিদেশ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর অবদানও অনস্বীকার্য। তিনি এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে কমনওয়েলথ মহাসচিব আর্নল্ড স্মিথের সঙ্গে সাক্ষাতে বাংলাদেশ পরিস্থিতি ব্যক্ত করলে মি. স্মিথ বলেন, তিনি ইয়াহিয়ার কাছে ব্যক্তিগতভাবে লিখবেন বাংলাদেশে রক্তপাত বন্ধ করতে এবং বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে। বিচারপতি চৌধুরী এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম-এর সাথে দেখা করে বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর অনুরোধ করলে জবাবে স্যার আলেক বলেন, বৃটিশ সরকার এ ব্যাপারে যতদূর সম্ভব চাপ দিবেন। (সূত্র: বিচারপতি চৌধুরীর উল্লিখিত বই, পৃষ্ঠা ১৬)
জুলাই মাসের শেষ দিকে সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচারে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বিচারপতি চৌধুরী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নোবেল বিজয়ী আইরিশ নেতা, আইনজীবী শ্যোন ম্যাকব্রাইটকে পাকিস্তানে প্রেরণ করেন। কিন্তু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ শ্যোন ম্যাকব্রাইটকে তা করতে দেয়নি।
১১ অগাস্ট বিচারপতি চৌধুরী বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীকে এই মর্মে চিঠি লেখেন যে, শেখ মুজিব একটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি বিধায় কোনো দেশের অধিকার নেই তার বিচার করার। তিনি চিঠিতে আশা প্রকাশ করেন ব্রিটিশ সরকার এতে হস্তক্ষেপ করবে। (সূত্র: বিচারপতি চৌধুরী উল্লিখিত বইয়ের ৭৭ পৃষ্ঠা)
বিচারপতি চৌধুরী অগাস্টের শুরুতেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর মহাসচিব মার্টিন এনালস এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) নিকট বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আনুষ্ঠানিক দরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ৫ অগাস্ট প্রখ্যাত ব্যারিস্টার অধ্যাপক ড্রেপারকে নিয়ে জেনেভা গমন করেন। সেখানে ব্যারিস্টার ড্রেপার আইসিআরসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার ব্যাপারে চেষ্টা করার দাবি জানান। (বিচারপতি চৌধুরীর উল্লিখিত বই, পৃষ্ঠা ৭২)
২৩ সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী ১৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি দল নিয়ে নিউ ইয়র্ক পৌঁছেন। এ ১৬ জনকে মনোনীত করেন মুজিবনগরভিত্তিক বাংলাদেশ সরকার। এ ১৬ জন ছিলেন- আব্দুস সামাদ আজাদ, এম আর সিদ্দিকী, সৈয়দ আব্দুস সুলতান, ডা. মফিজ চৌধুরী, সেরাজুল হক, ডা. আসহারুল হক, ফণি ভূষণ মুজমদার, ফকির সাহাবুদ্দিন, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, ড. এ আর মল্লিক, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, এ এফ এম আবুল ফতেহ, খুররম খান পন্নী, সৈয়দ আনোয়ারুল করিম, আবুল মাল আব্দুল মুহিত, এ এইচ মাহমুদ আলী। তারা জাতিসংঘে কর্মরত সাংবাদিক জে কে বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতিথিরূপে প্রতিদিন জাতিসংঘ ভবনে প্রবেশ করতেন। সেই সুযোগে তারা জাতিসংঘে বিভিন্ন দূতাবাসে লবি করেন। দূতাবাসগুলো বলতো ভারতের স্বীকৃতির পরই শুধু বাংলাদেশের বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে মুসলিম দূতাবাসগুলোর মনের কোণে সংশয় লক্ষ্য করা গেছে। (বিচারপতি চৌধুরীর উল্লিখিত পৃষ্ঠা : ১৬৯)
ইন্দিরা গান্ধী এবং বিচারপতি চৌধুরীর পরপরই যাদের অবদানের কথা বলতে হয় তারা ছিলেন সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ- ব্রেজনেভ, পদগর্নি এবং কোসিগিন। ২৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় লেখা হয়, ইতোপূর্বে কোনো সোভিয়েত নেতা এত শক্ত ভাষায় বাংলাদেশের বিষয় উল্লেখ করেননি যেমনটি করেছেন সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন। তিনি বলেছিলেন, “পাকিস্তানের কার্যকলাপ একেবারেই সমর্থনীয় নয়। অত্যাচারের ফলে পূর্ব পাকিস্তান আবাস অযোগ্য হয়ে গেছে।”
৩০ সেপ্টেম্বর লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় লেখা হয়েছিল যে, ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সম্পর্কে সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস নিয়েই দেশে ফিরেছেন। ৩ এপ্রিল সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগর্নি বাংলাদেশে নির্যাতন বন্ধের দাবি জানিয়ে বলেছিলেন, শেখ মুজিবুরের গ্রেপ্তার তার মনে গভীর শংকার সৃষ্টি করেছে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে ৩ এপ্রিল পাকিস্তানি ঘোষণার পরই পদগর্নি তার জীবনের নিরাপত্তার দাবি জানান।
আরও যেসব বিশ্ব বরেণ্য নেতারা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য অবদান রেখেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন জার্মান নেতা নোবেল বিজয়ী উইলি ব্রান্ট, আইরিশ নেতা নোবেল বিজয়ী শ্যোন ম্যাকব্রাইট, ফরাসি দার্শনিক আঁদ্রে মালরো, মার্কিন নেতা এডওয়ার্ড কেনেডি, অ্যামনেস্টি প্রধান মার্টিন এনলস, ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম, এমপি জন স্টোন হাউস, স্যার আর্থার বটমলি, ব্রুস ডগলাস ম্যান, মাইকেল বার্নস, পিটার শোর, টবি জেসেল, ওয়ার অন ওয়ান্ট প্রধান ডোনাল্ড চেমওয়ার্থ, কমনওয়েলথ মহাসচিব আর্নল্ড স্মিথ।
১৭ সেপ্টেম্বর আঁদ্রে মালরো ৬৯ বছর বয়সে বজ্রকণ্ঠে বলেন, “আমি পূর্ব পাকিস্তানের গিয়ে বাঙালি সমর নায়কের আদেশ অনুসারে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে প্রস্তুত”, সে খবর লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশের পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল।
বিশ্বের প্রভাবশালী নেতাদের উচ্চকণ্ঠ দাবির মুখে ইয়াহিয়া যে ভেঙ্গে পড়েছিল তার প্রমাণ মিলল ২২ সেপ্টেম্বর হেরাল্ড ট্রিবিউন পত্রিকার খবরে, যাতে লেখা হয়েছিল ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা করতে যাচ্ছেন।
৬ ডিসেম্বর ভারত এবং ভুটান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান পুরো দৃশ্যপট পাল্টে দিল এই অর্থে যে দুটি দেশের কূটনৈতিক স্বীকৃতির পর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু সে দেশের রাষ্ট্রপতির মর্যাদা পেয়ে যান, যার ফলে তাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের দ্রোহী হিসেবে বিচারে তোলা আন্তর্জাতিক আইনে অগ্রহণযোগ্য হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের নাগরিক বলে তার বিচার পাকিস্তানে হবে বলে ইয়াহিয়ার দাবি ভারত ও ভুটানের স্বীকৃতির পর পণ্ড হয়ে যায়, কারণ বাংলাদেশ তখন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দুটি দেশের স্বীকৃতি লাভ করায় ইয়াহিয়া-ভুট্টো বাধ্য হন বঙ্গবন্ধুর বিচার বন্ধ করতে এবং অবশেষে তাকে মুক্তি দিতে। তবে বিষয়টি মোটেও সহজ ছিল না। আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের চাপ ছাড়া এটি কোথায় গিয়ে গড়াত তা আঁচ করা কঠিন।
আরো উল্লেখ্য যে, ১৯৭১-এর ১৩ জুন বাংলাদেশের সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহে চিঠি পাঠিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগের দাবি জানান।
সম্প্রতি এক খ্যাতনামা ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে অন্য আরেকজন ব্যক্তি মুখ্য অবদান রেখেছিলেন বলে যে দাবি করেছেন তা সম্পূর্ণরূপে উদ্ভট কল্পনা। সে ব্যক্তি পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিকভাবে স্বনামধন্য হলেও ৭১-এ তিনি ছিলেন অখ্যাত, অপরিচিত একজন। ৭১-এ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য বাংলাদেশের কোনো অখ্যাত ব্যক্তি বিশেষের এ ব্যাপারে অবদান রাখার দাবি হাস্যকর, কেননা কোনো বাঙালি ব্যক্তি বিশেষ অবদান রাখার মতো অবস্থানে ছিলেন না, মুখ্য অবদান তো দূরের কথা, যা বলার অপেক্ষা রাখে না।