আরও তিন খুনীর
- আপডেট টাইম : ০৭:০১:০৩ অপরাহ্ণ, শুক্রবার, ১৩ আগস্ট ২০২১
- / ২৪৭ ৫০০০.০ বার পাঠক
- পাকিস্তানী পাসপোর্ট ব্যবহার করে পালিয়ে বেড়াচ্ছে বঙ্গবন্ধুর এই ঘাতকরা
- আইএসআইএ’র মদদ
- এদের খুঁজে বের করতে ইন্টারপোলের রেড নোটিস নবায়ন
সময়ের কন্ঠ রিপোর্ট ॥ পাকিস্তানী পাসপোর্ট ব্যবহার করছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক তিন খুনী। পাকিস্তানী পাসপোর্ট ব্যাবহার করার কারণে বঙ্গবন্ধুর তিন খুনী পরিচয় দিয়ে বেড়াচ্ছে তারা পাকিস্তানী নাগরিক। এ জন্য তিন খুনীর অবস্থান কোন দেশে তা খুঁজে বের করতে জটিলতায় পড়েছে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল ও গোয়েন্দা সংস্থা। পাকিস্তানী পাসপোর্ট ব্যবহারকারী তিন খুনীর অবস্থান খুঁজে বের করতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল রেড নোটিস জারি করে তা নবায়ন করছে। বিদেশে পলাতক পাঁচ খুনীকে ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় ও আইনী কার্যক্রম জোরদার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্স গঠন করে কাজ করে যাচ্ছে সরকার।
পলাতক পাঁচ খুনীর মধ্যে যে তিনজন পাকিস্তানী পাসপোর্ট ব্যবহার করছে তারা হচ্ছে, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম, রিসালদার (বরখাস্ত) মোসলেম উদ্দিন। পাকিস্তানী নাগরিকত্ব গ্রহণ করে পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়েছে তারা। পাকিস্তানী পাসপোর্ট গ্রহণকারী তিন খুনীকে সহায়তা দিচ্ছে পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই।
পাকিস্তানী পাসপোর্ট ব্যবহার করার কারণেই কোন দেশে তারা আত্মগোপন করে আছে তার হদিস করতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের এমনটাই দাবি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শোক দিবস পালনের প্রাক্কালে পলাতক পাঁচ খুনীকে ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করেছে সরকার। পলাতক পাঁচ খুনীর মধ্যে মেজর (বরখাস্ত) আবু মোহাম্মদ রাশেদ চৌধুরীর অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রে ও মেজর (বরখাস্ত) এসএইচএমবি নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করার খবরটি জেনে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা হয়েছে। রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরীকে আইন প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনার জন্য কূটনৈতিক প্রক্রিয়া জোরদার করায় তাদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেছে সরকার। কিন্তু পলাতক অপর তিন খুনীর সঠিক অবস্থান জানা না থাকায় বছরের বছর ধরে অন্ধকারে রয়েছে সরকার। পলাতক তিন খুনী রশীদ, ডালিম, মোসলেম উদ্দিন কোন দেশে আত্মগোপন করে আছে তা জানার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের কূটনীতিকদের। এমনকি বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের সাহায্য-সহযোগিতা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পলাতক আসামিদের খুঁজে বের করার জন্য গঠিত টাস্কফোর্স প্রধান সমন্বয়ক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেছেন, রশীদ, ডালিম, মোসলেম উদ্দিন- পলাতক এই তিন খুনী পাকিস্তানী পাসপোর্ট ব্যবহার করায় তারা সঠিক কোন দেশে অবস্থান করছে তা খুঁজে বের করতে দেখা দিয়েছে জটিলতা। পাকিস্তান তাদের শেল্টার দিচ্ছে। ফলে সরকার তাদের অবস্থান জানলেও বলতে পারছে না। ফেরানোর কোন উদ্যোগও নিতে পারছে না। এমনকি আন্তর্জাতিক পুলিশী সংস্থা ইন্টারপোলও পলাতক তিন খুনীর অবস্থান অবহিত হতে জটিলতায় পড়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বর্তমান অবস্থান নিয়ে বলতে গিয়ে এমন তথ্য জানিয়েছেন ওয়ালিউর রহমান যিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে দীর্ঘদিন খুনীদের ফিরিয়ে আনতে কাজ করেছেন বলে জানা গেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, খুনী এ এম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং এনএইচএম বি নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছে- এটা মোটামুটি সবারই জানা। অপর তিনজন খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন এখন কোথায় সেটা অনেকেই জানেন না। পলাতক তিন খুনীই পাকিস্তানী পাসপোর্ট ব্যবহার করছে। এর মধ্যে ডালিম কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে আছে। আর রশিদ ও মোসলেম উদ্দিন আছে লিবিয়ার বেনগাজিতে। গাদ্দাফি জীবিত থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর এই খুনীদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। এরা দুজন পাকিস্তন-বেনগাজি নিয়মিত আসা-যাওয়া করে- এমনটাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্মকর্তার দাবি।
গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, চার মাস আগে ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর প্রচার হয়, ভারতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মোসলেম উদ্দিন। কিন্তু ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে তার আটকের খবরের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়নি। এমনকি বাংলাদেশকেও কিছুই জানায়নি।
ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা অফিসের প্রধান (এনসিবি) ও পুলিশের সহকারী উপমহাপরিদর্শক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেছেন, গণমাধ্যমেই আমরা বঙ্গবন্ধুর খুনী মোসলেম উদ্দিনের গ্রেফতারের বিষয়টি জানতে পারি। এরপর আমরা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ভারতীয় এনসিবির কাছে চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু গত চার মাসেও আমরা ওই চিঠির কোন জবাব পাইনি। এমনকি কিছুদিন আগেও আমরা তাগাদা দিয়ে আরেকটি চিঠি দিয়েছি। কিন্তু সে চিঠিরও কোন জবাব পাইনি। ফলে আমরা নিশ্চিত নই আসলে মোসলেম উদ্দিন গ্রেফতার হয়েছে কিনা।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, মোসলেম উদ্দিনের বিষয়ে একটা কথা আসছিল, আমরা এটা যাচাই-বাছাই করে দেখেছি, এখন পর্যন্ত এর সত্যতা আমরা পাইনি। বৃহস্পতিবার, রাজধানীর গুলশানে সরকারী আবাসিক অফিসে সাংবাদিকরা তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে এ কথা বলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রধান সমন্বয়ক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমানও বলেছেন, মোসলেম উদ্দিন ভারতে থাকার কোন তথ্য তার কাছেও নেই। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনী আবদুর রশীদ পাকিস্তানের পাসপোর্ট ব্যবহার করছে এটা ধারণা করার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। কারণ বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করলে নবায়নের জন্য তাকে আবেদন করতে হতো। বঙ্গবন্ধুকে খুন করার পর খুনীদের শেল্টার দিয়েছে তখনকার পাকিস্তান সরকার। ধারণা করা হয়, রশিদ পাকিস্তান বা আফ্রিকার কোন দেশে পালিয়ে আছে তবে এর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনী ডালিমও পাকিস্তানের পাসপোর্ট ব্যবহার করছে বলে মনে করা হয়। কারণ রশীদ, ডালিম ও মোসলেম উদ্দিন একই সময়ে পাকিস্তানে অবস্থান করেছে। তবে ১৯৯৫ সালে কেনিয়াতে রাষ্ট্রদূত থাকাকালে অবসরে যায় ডালিম। বর্তমানে তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকার। পাকিস্তান, লিবিয়া বা স্পেনে থাকতে পারে ডালিম।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বৃহস্পতিবার ভার্চুয়াল সভায় কানাডায় পলাতক নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা চেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর পাঁচজন খুনী এখনও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পলাতক আছে। এসব খুনীর অবস্থান নির্ণয় ও দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকরে সহায়তার জন্য সকল বন্ধুরাষ্ট্রের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করায় ১৯৭৫-৯৬ সাল পর্যন্ত এসব খুনীকে বিচারের আওতায় আনা যায়নি।
প্রসঙ্গত, জাতির পিতার হত্যা মামলার রায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামির মধ্যে পাঁচজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারিতে। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে যে পাঁচজনের মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করা হয় তারা হচ্ছে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মহিউদ্দিন আহমদ (ল্যান্সার), এ কে বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিনের (আর্টিলারি)। এরপর মুজিববর্ষে গত ১১ এপ্রিল ফাঁসি কার্যকর করা হয় ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদের। আবদুল মাজেদ ভারত থেকে পালিয়ে ঢাকায় আসার পর তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
২০০১ সালের জুনে পলাতক অবস্থায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত অপর আসামি মেজর (অব.) আবদুল আজিজ পাশা মারা যায় জিম্বাবুইয়েতে। পলাতক পাঁচ খুনীর মধ্যে ২ খুনী রাশেদ চৌধুরী আছে যুক্তরাষ্ট্রে এবং কানাডায় আছে নূর চৌধুরী। অপর ৩ খুনীর অবস্থান খুঁজে বের করতে রেড নোটিস জারির পর তা নবায়ন করেছে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল। ২০০৯ সালে এই নোটিস জারির পর পাঁচ বছর পরপর নবায়ন করা হচ্ছে। শোকের মাস আগস্টে, বিদেশে পলাতক খুনীদের দেশে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার।