তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে…
- আপডেট টাইম : ০৫:৩৫:৪৩ অপরাহ্ণ, বৃহস্পতিবার, ৫ আগস্ট ২০২১
- / ৩১৮ ৫০০০.০ বার পাঠক
- বাইশে শ্রাবণ আজ
মোরসালিন মিজান ॥ রবীন্দ্রনাথ যে চিরকালের, সে তো বলাই বাহুল্য। চোখের সামনে তিনি নেই। নেই বটে। ‘আছে সে নয়নতারায় আলোকধারায়।’ বাঙালীর অন্তরাত্মায় যার চির বসবাস তাঁর, না, মৃত্যু হয় না। তবুও একটি আনুষ্ঠানিকতা। চোখের সামনে যে নেই, সে কথাটি স্মরণ করার দিন আজ। আজ শুক্রবার বাইশে শ্রাবণ। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে চিরপ্রস্থান গ্রহণ করেন তিনি।
মৃত্যুকে স্মরণ করে কবিগুরু লিখেছিলেন, ‘তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,/ তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।’ মহাপ্রয়াণের ৮ দশক পর আমরা তাঁকে আরও বেশি করে ডাকছি। কবিগুরু আজ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। আরও অনিবার্য। বাঙালীর আত্মার স্পন্দনে, রক্তধারায় মিশে আছেন তিনি। আলোর অনন্ত উৎস রবীন্দ্রনাথ বাঙালীকে পথ দেখিয়ে চলেছেন। প্রতিবছর বিশেষ দিবসে বিশেষ আয়োজনে স্মরণ করা হয় কবিগুরুকে। তবে বর্তমানে জরাগ্রস্ত পৃথিবী। করোনার প্রাদুর্ভাব আবারও বেড়ে যাওয়ায় ঘরবন্দী মানুষ। এ অবস্থায় আজ বাইরে কোন অনুষ্ঠান আয়োজনের সুযাগ নেই। তবে ঘরে বসে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করবে কৃতজ্ঞ বাঙালী।
প্রথম জীবনে ভানুসিংহের পদাবলীতে কবিগুরু লিখেছিলেন : ‘মরণ রে,/ তুঁহু মম শ্যামসমান… মৃত্যু অমৃত করে দান।’ একইভাবে মৃত্যুকে জীবনের নিস্তার রূপে বর্ণনা করে লিখেছিলেন, ‘প্রেম বলে যে যুগে যুগে, তোমার লাগি আছি জেগে, মরণ বলে আমি তোমার জীবনতরী বাই।’ জীবনের প্রতি নিজের তৃষ্ণার কথা জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’
বলা বাহুল্য, মানবের মাঝে রবীন্দ্রনাথের বেঁচে থাকার স্বপ্ন শতভাগ পূর্ণতা পেয়েছে। কীভাবে যে তিনি বাঙালীর প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে, বোধের সঙ্গে, চর্চার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন আজ আমরা তা নিশ্চিত অনুভব করছি। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সঙ্গীতস্রষ্টা, নট ও নাট্যকার, চিত্রকর, প্রাবন্ধিক, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর সাহিত্য। ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। তাঁর এ প্রাপ্তি বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় অর্জন। নিজ কর্মের মাধ্যমে একটি কালের সূচনা করে গেছেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথ কৈশোর পেরোনোর আগেই বাংলা সাহিত্যের দিগন্ত বদলে দেয়ার আভাস স্পষ্ট করেন। তাঁর পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হয়েছে বাঙালীর শিল্প-সাহিত্য ভান্ডার। বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্য সঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সঙ্কলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খ-ে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য- ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা, চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদ ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তাঁর রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। সাহিত্যের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের গান বাংলা সঙ্গীত ভান্ডারকে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছে। আজকের বদলে যাওয়া সময়েও বিপুল ঐশ্বর্য নিয়ে টিকে আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। এর আবেদন যেন কোনদিন ফুরোবার নয়। বরং যতদিন যাচ্ছে ততই রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাণী ও সুরের ইন্দ্রজালে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে বাঙালী। তাঁদের আবেগ, অনুভূতি কবিগুরুর গানের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জাতীয় সঙ্গীতেরও রচয়িতা তিনি। বহু প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় সত্তর বছর বয়সে নিয়মিত ছবি আঁকা শুরু করেন। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে অঙ্কিত তাঁর স্কেচ ও ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উৎসাহে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে। এরপর সমগ্র ইউরোপেই কবির একাধিক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। তাঁর আঁকা ছবিতে আধুনিক বিমূর্তধর্মিতাই বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে।
মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ মানুষের ওপর দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল ছিলেন। তাঁর মতে, মানুষই পারে অসুরের উন্মত্ততাকে ধ্বংস করে পৃথিবীতে সুরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। তাই ‘সভ্যতার সঙ্কট’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন : ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার কবিকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সেই উপাধি বর্জন করেন তিনি।
সমাজের কল্যাণেও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শন চেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তিনি দেববিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পুজোর কথা বলেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ চার বছর ঘন ঘন অসুস্থতার মধ্য দিয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যে দু’বার অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল কবিকে। ১৯৩৭ সালে একবার অচৈতন্য হয়ে গিয়েছিলেন। আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়েছিল। তখন সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সুস্থ হননি। চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,/মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনা দেনা…। পৃথিবীর সঙ্গে লেনা দেনা সব চুকে দেন তিনি। তবে নিজের সৃষ্টির মাঝে ঠিক বেঁচে আছেন।
৮০তম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে আজ শুক্রবার রাত ৯টায় ভার্চুয়াল সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করবে ছায়ানট। ‘শ্রাবণের আমন্ত্রণে’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে ঘরে বসেই শিল্পীরা গান করবেন। ছায়ানটের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে গিয়ে অনুষ্ঠান উপভোগ করা যাবে।
সংস্কৃতি বন্ধুসভা নামের আরেকটি ফেসবুক পেজ থেকে লাইভ সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করবেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মকবুল হোসেন। স্বনামধন্য অন্য অনেক শিল্পীও ভার্চুয়ালি কথা, কবিতা, গান পরিবেশন করবে বলে জানা গেছে।