শেখ মুজিবের কবিতা লিখে চাটুকারিতায় পিডি শাহ কামালের তেলেসমাতি!

- আপডেট টাইম : ০১:৩৮:০১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫
- / ৭ ১৫০.০০০ বার পাঠক
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের “কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্পের” প্রকল্প পরিচালক ড. মোঃ শাহ কামাল খানের তেলেসমাতিতে সমালোচনার ঝড় উঠেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তার বিরুদ্ধে ‘ভূয়া বিল-ভাউচার দেখিয়ে অর্থ লোপাট’, ‘জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন’, ‘কানাডায় অর্থ পাচার’ এর অভিযোগ জমা পড়েছে দূর্নীতি দমন কমিশনে।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস এসোসিয়েশনের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর পক্ষ থেকে মনির হোসেন গত ২২ এপ্রিল অভিযোগটি দায়ের করেছেন। বিষয়টি যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দেশব্যাপী ‘কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করা হয়। আইসিটি নির্ভর এই গুরুত্বপূর্ণ, স্মার্ট এবং যুগোপযোগী প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণভাবে দেশের কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে অবদান রাখার কথা থাকলেও প্রকল্প পরিচালক শাহ কামাল খানের স্বেচ্ছাচারিতা এবং অনিয়মের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে প্রকল্পটি। মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০১৬ যুগোপযোগী এই প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২১ সালেই প্রকল্পটির শতভাগ বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারিত ছিল। কিন্তু বেশ কয়েকটি কারণে প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়। একনেকের অনুমোদন অনুযায়ী যার মেয়াদ শেষ হবার কথা ছিল ২০২৩ সালের জুনে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশের ৬৪ জেলার ৪৯২টি উপজেলার ৪৫৫৪টি ইউনিয়ন পরিষদেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল। শুরুতে ১১৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা ধরা হলেও পরে বাজেট বাড়িয়ে ২১২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা নির্ধারণ করা এই প্রকল্পটি প্রথম সংশোধিত আকারে ২০২৩ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এরমধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল ১৫ কোটি ২২ লাখ ৬০ হাজার টাকা, এছাড়া প্রকল্প ঋণ বাবদ ব্যায় হয় ১৯৭ কোটি ১৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল আবহাওয়া ও নদনদীর সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কিত উন্নতমানের এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য কৃষকের কাছে পৌঁছানো। সেই সঙ্গে এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উন্নত পদ্ধতি ব্যবহারে কৃষি বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
দুদকে দায়েরকৃত অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে, দূর্নীতিবাজ প্রকল্প পরিচালক শাহ কামাল খান সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না করে অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি ও মন্ত্রণালয়ের কতিপয় কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে প্রকল্পে বিভিন্ন ভূয়া বিল ভাউচারে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার পাশাপাশি দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করে বিদেশ ভ্রমণে আমোদ প্রমোদে সময় পার করেছেন এবং সরকারের কোটি কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যায় করেছেন। এই সময়ে চারবার বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টি নিয়ে প্রকল্পের কর্মকর্তাসহ খামারবাড়ি কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভও ছিল ব্যাপক। প্রকল্পে এমন ধীরগতির পরেও প্রকল্প পরিচালক শাহ কামাল খান অধিদপ্তরের ডিজি ও মন্ত্রণালয়ের কতিপয় কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
অভিযোগপত্রে আরো উল্লেখ রয়েছে, ঢাকার মিরপুরে পুলিশ কনভেনশন হলের পাশে বিজয় রাকিন সিটিতে ৫ কোটি টাকা মূল্যের দুটি অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন। তার ছেলেকে ৫০ লাখ টাকা খরচ করে কানাডায় উন্নতর শিক্ষা অর্জন করতে পাঠিয়েছেন। মূলতঃ অবৈধভাবে উপার্জিত দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থ ছেলের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন মর্মে অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়। এছাড়াও কানাডাতে সেকেন্ড হোম হিসেবে দশ কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট ক্রয় করে ছেলের মাধ্যমে সেখানে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। বগুড়া উপজেলার খাদুলী গ্রামসহ স্ত্রী, শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়-স্বজন এবং নামে বেনামে গড়ে তুলেছেন বিঘায় বিঘায় জমি ও প্লট। এছাড়াও রয়েছে কোটি কোটি টাকার ব্যাংক-ব্যালান্স।
আজকের বাংলার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, কামাল খান ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ঠ দোসর হিসেবে বিভিন্ন মিছিলে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। এছাড়া বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (কৃষি) এসোসিয়েশন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের রেলী ও মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে যেখানে শাহ কামাল খানের নাম ২৫ নম্বরে রয়েছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের কৃষি অঙ্গনের সহযোগী সংগঠন বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদ পরিষদের আজীবন সদস্য এই কর্মকর্তা। তবে ৫ই আগষ্টের পর কামাল খান রং বদলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলার মানুষ ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতার এলাকার বলে জাহির করেন তিনি।
আজকের বাংলার সরেজমিন অনুসন্ধানে এসেছে, ঢাকার মিরপুরে পুলিশ কনভেনশন হলের পাশে বিজয় রাকিন সিটিতে, বি১-টি২-০৪-০২ নং অত্যাধুনিক বিলাশবহুল ভবন, মিরপুর-১৫ তে তার স্ত্রীর নামে দুটি আলিশান ফ্ল্যাট রয়েছে। যার একটি ভাড়া দিয়ে রেখেছেন ও অন্যটিতে নিজেরা বসবাস করছেন। ফ্ল্যাট দুটির আনুমানিক মূল্য ৫ কোটি টাকার উপরে।
অনুসন্ধানকালে একাধিক সূত্র দাবি করেছেন, কানাডায় তার ছেলেকে প্রায় ৫০ লাখ টাকা খরচ করে কানাডা পাঠিয়েছেন। এমনকি পরবর্তীতে অবৈধ পথে উপার্জিত দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থ ছেলের মাধ্যমে টিউশন ফি হিসেবে কানাডায় পাচার করেছেন। এছাড়া ছেলের মাধ্যমে কানাডায় দশ কোটি টাকার একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করে সেখানে ব্যবসা বানিজ্য পরিচালনা করছেন।
সূত্রটি আরও দাবি করছে, বগুড়া উপজেলার খাদুলী গ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজনের নামে-বেনামে জমিজমা ও কোটি কোটি টাকার ব্যাংক-ব্যালেন্স করেছেন।
প্রসঙ্গত, শাহ কামাল ২০০১ সালে ২০তম বিসিএস (কৃষি) ক্যাডারে যোগ দেন এবং ২০২০ সালের ১২ আগস্ট থেকে কৃষি আবহাওয়া প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই প্রকল্পে ১১৯ কোটি টাকার বরাদ্দ বাড়িয়ে ২১২ কোটি করা হয়। কিন্তু সময়মতো কাজ না করে, দায়সারা কার্যক্রম ও চারবার বিদেশ ভ্রমণ করায় প্রকল্পে অগ্রগতি হয়নি। বরং বারবার ধীরগতির কারণে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের ৪৫৫৪টি ইউনিয়নে আইসিটি-নির্ভর আবহাওয়া তথ্য সরবরাহ করা, যাতে কৃষকেরা আগাম আবহাওয়া জেনে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে এ প্রকল্প হয়ে উঠেছে দুর্নীতির অন্যতম উদাহরণ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “কামাল হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। তিনি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করে শুধু বিদেশ ভ্রমণেই মগ্ন ছিলেন।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, একই ব্যাচের এক কর্মকর্তা জানান “প্রকল্পেটির উদ্দেশ্য ভালো ছিলো। কিন্তু যথাযথ প্রয়োগ নেই। উনি অনেকগুলো রেডিও স্টেশন স্থাপন করেছেন, কোনটি কার্যকর নয়। অনেক যন্ত্রপাতির প্যাকেট ও খোলা হয় নি।”
কৃষি সার্ভিস এসোসিয়েশনের সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মুকুল আজকের বাংলাকে বলেন, “আমাদের দপ্তরে ৩০ টি প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্প ফ্যাসিস্ট সরকারে আমলে হরিলুট করার জন্যই নেয়া হয়েছে। এখনো সেসব পিডি বহাল রয়েছে। আমরা মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার লিখিতভাবে জানিয়েছি। আমরা এসব দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপসারণ চাই।”
ড. মো. শাহ কামাল খান নিজেকে অত্যন্ত সাহিত্য অনুরাগী বলে জাহির করেন। তবে তার কবি প্রতিভা শুধুই ফ্যাসিস্টের তোষামোদিতেই সীমাবদ্ধ। শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থ ‘মাতৃভূমি’-তে গ্রন্থে তার লেখা কবিতা ‘ঐতিহাসিক ১৭ মার্চ’ ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (কৃষি) অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘ঠিকানা বঙ্গবন্ধু’ স্মারকগ্রন্থে প্রবন্ধ ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : এক অবিসংবাদিত নেতার নাম’ লিখে সে ফ্যাসিস্ট সরকারের বুদ্ধিবৃত্তিক রসদ জুগিয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা। এছাড়াও বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র্র্র (বিপিএটিসি) হতে প্রকাশিত স্মরণিকায় তার আওয়ামী আঙ্গনে সমাদৃত ছিলো বলে জানা যায়। অভিযোগ রয়েছে এসব লেখনী দিয়ে সে তৎকালীন সরকারের আস্থা অর্জন করে বিশ্বব্যাংকের ঋনের টাকায় ভূতুড়ে প্রকল্প বাগিয়ে নিয়েছেন।
এব্যাপারে শাহ কামাল খানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি আওয়ামীলীগের তোষামোদির বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমি কবি মানুষ তো লিখতেই পারি।
অবৈধ পথে সম্পদ অর্জনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার সবকিছু ট্যাক্স ফাইলে আছে। আয়ের সাথে সম্পদ সঙ্গতিপূর্ণ না হলে ট্যাক্স ফাইলে থাকলেও বৈধ হয় কিনা? এমন প্রশ্ন শেষ করার আগেই তিনি ফোন কেটে দেন। আবারও যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি ফোন ধরেননি।
বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাপারে পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছাইফুল আলমের অফিসে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ফোনে যোগাযোগ, এমনকি ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
অভিযোগ প্রসঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের মোবাইলে যোগাযোগ ও ক্ষুদে বার্তা দিলেও তিনি ফোন ধরেননি।