প্রবাস থেকে ‘নাগরিক টিভি’র নামে ডিজিটাল চাঁদাবাজি # টিটো-সাকিব সিন্ডিকেটের ভয়ঙ্কর নেটওয়ার্ক

- আপডেট টাইম : ০২:৩০:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫
- / ১ ৫০০০.০ বার পাঠক
সাংবাদিকতার নাম ব্যবহার করে বিদেশে বসেই গড়ে উঠেছে একটি সংঘবদ্ধ ডিজিটাল চাঁদাবাজ চক্র। ইউটিউবভিত্তিক বিতর্কিত চ্যানেল ‘নাগরিক টিভি’র আড়ালে এই অপরাধ সিন্ডিকেট পরিচালনা করছেন কানাডা প্রবাসী টিটো রহমান এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী নাজমুস সাকিব। তথ্য ও অনুসন্ধানের নামে ভয় দেখিয়ে দেশের প্রভাবশালী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করাই এদের মূল উদ্দেশ্য বলে অভিযোগ উঠেছে।
মূলত সাংবাদিকতার আড়ালে চাঁদাবাজির এই নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে শুরু হয় ইউটিউবে নিয়মিত ভিডিও আপলোডের মাধ্যমে। দেশবিরোধী কনটেন্ট, রাজনৈতিক মিথ্যাচার এবং পরিচিত ব্যক্তিবর্গের নামে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দ্রুত পরিচিতি পায় ‘নাগরিক টিভি’। সেই পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে একে একে টার্গেট করতে থাকে দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পগোষ্ঠীকে।
চাঁদাবাজির ফর্মুলা: অনুসন্ধান নয়, অর্থ আদায়ের হাতিয়ার
নিয়মিত অনুসন্ধানের নামে একটি করে “এক্সপোজ” ঘোষণা করা হয় ‘নাগরিক টিভি’র ফেসবুক ও ইউটিউব পেইজে। প্রথমে তৈরি হয় একটি পোস্টার বা ভিডিও কার্ড, যাতে বলা হয় “চমকপ্রদ অনুসন্ধান আসছে”। এর সঙ্গে ব্যক্তির নাম ও ছবি দিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন তারা দুর্নীতির ভয়ঙ্কর অভিযুক্ত। এর পরপরই যোগাযোগ শুরু হয় ওই ব্যক্তি বা তার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। প্রস্তাব আসে, যদি সম্মান রক্ষা করতে চান? তবে অর্থের বিনিময়ে ভিডিওটি বন্ধ রাখা যেতে পারে।
এই একই পদ্ধতিতে একাধিকবার চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। ২০২১ সালে থার্মেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির মোল্লাকে নিয়ে “মুখোশ উন্মোচন” শিরোনামে একটি ভিডিও প্রকাশ করে তারা। তবে ভিডিওটি কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রচার হয় এবং এতে তথ্যভিত্তিক কিছুই ছিল না। অভিযোগ রয়েছে, চাঁদা না পাওয়ায় ওই ভিডিও প্রচার করা হয়।
২০২২ সালে “দুর্নীতি ও টাকা পাচারের তিন খলনায়ক” শিরোনামে ইউনুস গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ ও আল-হারামাইন গ্রুপের চেয়ারম্যানদের ছবি দিয়ে একটি পোস্টার প্রকাশ করে নাগরিক টিভি। বলা হয়, এই তিনজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। কিন্তু তিন বছর পার হলেও সেই ভিডিও কখনো প্রকাশিত হয়নি। কারণ হিসেবে জানা যায়, সংশ্লিষ্ট গ্রুপের সঙ্গে সমঝোতা হয় এবং ভিডিও প্রকাশ না করার শর্তে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয় এই প্রতারক চক্র।
বসুন্ধরা গ্রুপকে ৬ কোটি টাকার প্রস্তাব: ফাঁস কলরেকর্ড
সবচেয়ে আলোচিত অভিযোগটি আসে ২০২২ সালে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক শিল্পগ্রুপ বসুন্ধরা গ্রুপকে টার্গেট করে ৬ কোটি টাকার চাঁদা দাবি করে সাকিব ও টিটো। দাবি ছিল, ভিডিও প্রকাশ না করার শর্তে এই অর্থ দিতে হবে। ওই সময় একটি কলরেকর্ড ফাঁস হয়, যেখানে স্পষ্ট শোনা যায়-এই দুই ইউটিউবার কিভাবে ভয় দেখিয়ে চাঁদার প্রস্তাব দিচ্ছেন। এই ঘটনায় প্রবাসে থাকা জনপ্রিয় ইউটিউবার ও অ্যাক্টিভিস্টরা তাদের প্রকাশ্যে তিরস্কার করেন।
সামাজিক ও নৈতিক বিচ্যুতি: সাকিবের অতীত আরও ভয়াবহ
চাঁদাবাজির অভিযোগ ছাড়াও সাকিবের বিরুদ্ধে রয়েছে ভয়ানক যৌন অপরাধের অভিযোগ। স্থানীয় সূত্রের বরাতে জানা যায়, ঢাকার সবুজবাগে একাধিক ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত ছিলেন তিনি। ২০১১ সালে একটি শিশুকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হয়। পরে অর্থ দিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়া হয়। এছাড়াও এক ভাড়াটিয়ার স্ত্রী এবং নিজের খালাতো বোনকে ধর্ষণের মতো ঘটনাও তার নামে রয়েছে। পরবর্তী সময়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে তাকে বিবাহে বাধ্য করা হয়। সেই স্ত্রী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে থাকলেও তাদের দাম্পত্য কলহ প্রায়শই সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
সাম্প্রতিক সময়ে চাঁদনী আক্তার ওরফে আধুরা চৌধুরী নামে এক নারীর সঙ্গে গোপনে বিবাহের দলিল ও ছবি ভাইরাল হয়। জানা যায়, নতুন স্ত্রী আধুরা চৌধুরী সাকিবের বিকৃত যৌন আচার ও বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে ব্ল্যালমেইল করার ফোন রেকর্ড ফাঁস করার ভয় দেখালে তাঁকে বিয়ে করতে বাধ্য হয় সাকিব।
ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ
দেশের শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠীগুলোর বলছে, প্রবাস থেকে বসে এই ধরনের ডিজিটাল চাঁদাবাজি ও সামাজিক সম্মানহানী চেষ্টার কারণে দেশে নিরাপদ ব্যবসার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। তারা বলেন, আজ বসুন্ধরা, কাল থার্মেক্স-এভাবে একের পর এক প্রতিষ্ঠান টার্গেট হলে সবার জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে।
নাম প্রকাশ না করার দেশের শীর্ষস্থানীয় এক শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বলেন, বিদেশে বসে এই ধরনের সাইবার অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে। বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী হলেও প্রবাসে বসে দেশের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কাজ করা একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ, যেটির জন্য ইন্টারপোল ও সংশ্লিষ্ট দেশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সহযোগিতা চাওয়া যেতে পারে।
তিনি বলেন, টিটো-সাকিব জুটির ‘নাগরিক টিভি’ মূলত একটি ডিজিটাল চাঁদাবাজির প্ল্যাটফর্ম, যা সাংবাদিকতার নাম ভাঙিয়ে জনগণ ও ব্যবসায়ী শ্রেণির উপর ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করছে। এই চক্রকে বিচারের আওতায় আনাই এখন সময়ের দাবি।