ঢাকা ০৪:৪৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪
সংবাদ শিরোনাম ::
পীরগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত কঠিন সময়ে কীভাবে পাশে ছিলেন স্ত্রী, জানালেন কোহলি ইতালিতে জি৭ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আলোচনার তালিকায় নেতানিয়াহুর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সরকারকে ধন্যবাদ দিয়ে আরো যা ‘পদক্ষেপ’ নিতে বললেন নূরুল কবির মেগা মানডে’: ৩ কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্র যাত্রাবাড়ী অর্থের লোভ দেখিয়ে ‘গণঅভ্যুত্থানের’ ব্যর্থ চেষ্টা, নেপথ্যে কারা? ইমরান খানের হাজারো সমর্থক গ্রেপ্তার প্রতারক বাবু যেন কাশিমপুর থানার একচ্ছত্র অধিপতি ১০ সাংবাদিকের ব্যাংক হিসাব জব্দ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন প্রধান উপদেষ্টা, বাকিদের কথা ব্যক্তিগত

সিআইসি’র অনুসন্ধান প্রভাবশালীদের ফ্ল্যাট কেনায় কর ফাঁকি

নিজস্ব প্রতিবেদন
  • আপডেট টাইম : ১১:৪৩:৪৮ পূর্বাহ্ণ, বুধবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
  • / ৮৭ ৫০০০.০ বার পাঠক

তালিকায় আছেন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, আইনজীবী
কর গুলশান, বনানী, বারিধারা ও ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকায় প্রভাবশালীদের ফ্ল্যাট কেনায় ভয়াবহ আয়কর ফাঁকির প্রমাণ মিলেছে। স্বনামধন্য ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, আইনজীবী, জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় আছেন এ তালিকায়। আবাসিক ও বাণিজ্যিক ফ্লোর কেনার প্রকৃত অর্থ গোপন করে আয়কর ফাঁকি দিয়েছে ডজনখানেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

আবার অনেকে বিনিয়োগের তথ্য রিটার্নে উল্লেখ করেননি। এতে সরকার অর্ধশত কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।

সূত্র জানায়, ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান, বারিধারা, বনানীতে জমি, ফ্ল্যাট বা ফ্লোর স্পেসের মূল্য আকাশছোঁয়া হলেও এসব এলাকায় বহুতল ভবনে স্পেস বিক্রি বা হস্তান্তর দলিলে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে অনেক কম মূল্য দেখানো হচ্ছে। ফ্ল্যাট নির্মাণে প্রতি বর্গফুটে যে খরচ হয়, ডেভেলপার কোম্পানি ও ক্রেতা যোগসাজশ করে তার চেয়েও কম দাম দেখাচ্ছে। সিআইসির প্রাথমিক অনুসন্ধানে কোম্পানি, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী শ্রেণির করদাতারা বাণিজ্যিক/আবাসিক স্পেস ক্রয়ে অর্ধশত কোটি টাকার কর ফাঁকির ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি বনানী-তেজগাঁও লিংক রোডের একটি বাণিজ্যিক ভবন এবং গুলশান অ্যাভিনিউ রোডের একটি আবাসিক ভবনের কাগজপত্র এবং এসব ভবনে ফ্ল্যাট ক্রেতার আয়কর নথি অনুসন্ধান করে সিআইসি দেখতে পায়, একাধিক ক্রেতা ক্রয়কৃত ফ্ল্যাট বা স্পেসের বিনিয়োগ মূল্য আয়কর নথিতে আদৌ প্রদর্শন করেননি, করলেও প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক কমে নামমাত্র মূল্য প্রদর্শন করেছেন। আবার কেউ কেউ তিন-চার বছর ধরে কিস্তিতে অগ্রিম টাকা পরিশোধ করে এলেও পরিশোধকৃত কিস্তির টাকা অগ্রিম হিসাবে আয়কর নথিতে প্রদর্শন করেননি। পরবর্তী সময়ে কম মূল্যে ফ্ল্যাট বা স্পেস রেজিস্ট্রেশন করেছেন।

সিআইসির অনুসন্ধানে দেখা যায়, উত্তর গুলশানে দক্ষিণমুখী লেকের পাড়ে অবস্থিত একটি বহুতল ভবনে ঢাকার একটি চক্ষু হাসপাতালের স্বনামধন্য একজন চক্ষুবিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ফ্ল্যাট কেনেন। ডাক্তারি পেশা থেকে অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধ করার জন্য ৪৩৭৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ১৩ কোটি টাকায় কিনলেও সাড়ে ৪ কোটি টাকা মূল্যে রেজিস্ট্রেশন নেন। বাকি সাড়ে ৮ কোটি টাকার সম্পদ খুব সহজেই বৈধ করে নিয়েছেন। জাতীয় ক্রিকেট দলের একজন ক্রিকেটার আবাসিক ভবনটিতে ১২ কোটি ৪০ লাখ টাকায় ফ্ল্যাট ক্রয় করলেও তিনি তা আয়কর নথিতে প্রদর্শন করেননি। আবার একটি সিকিউরিটিজ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ৯৭০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটি ৪৯ কোটি টাকায় কিনলেও ১০ কোটি টাকায় রেজিস্ট্রেশন নিয়েছেন। এতে ওই ব্যক্তি ৩৯ কোটি টাকার সম্পদের উৎসের ওপর কর ফাঁকি দিয়েছেন। ভবনে অন্য একজন ক্রেতা হচ্ছেন সুপ্রিমকোর্টের স্বনামধন্য ব্যারিস্টার। তিনি ফ্ল্যাট ক্রয়ে প্রায় ১৩ কোটি টাকা পরিশোধ করলেও এখনো ফ্ল্যাটটি আয়কর নথিতে প্রদর্শন করেননি। অন্যদিকে একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী গুলশান ৫০ নম্বর রোডের বহুতল ভবনে প্রায় ২৮ কোটি টাকার স্পেস ক্রয় করলেও আয়কর রিটার্নে তা প্রদর্শন করেননি।

অন্যদিকে বনানী-তেজগাঁও লিংক রোডের বাণিজ্যিক ভবনটিতে স্পেস কিনেছে-এমন একটি সিকিউরিটিজ কোম্পানির অডিট রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সিকিউরিটিজ কোম্পানিটি স্পেস ক্রয়ে ৭৩ কোটি টাকা পরিশোধ করলেও অডিট রিপোর্টে প্রদর্শন করেছেন মাত্র ৫৫ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে পুরো বিনিয়োগের প্রায় ৭২ কোটি টাকা কর ফাঁকি দিয়ে বৈধ করা হয়েছে। অন্যদিকে একই ভবনে অপর কোম্পানি স্পেস কেনার ক্ষেত্রে খরচ করেছে ১৩ কোটি টাকা; কিন্তু অডিট রিপোর্টে তা প্রদর্শন করা নেই। আবার একটি নামকরা সাইকেল প্রস্তুত ও বাজারজাতকারী কোম্পানি ৩৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা মূল্যের বাণিজ্যিক স্পেস ক্রয় করলেও তা আয়কর নথিতে প্রদর্শন করেনি। এরকম রাজস্ব ফাঁকির আরও ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইসির এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে যেসব ব্যক্তি ও কোম্পানি করদাতার আয়কর নথিতে তথ্য গোপনের প্রমাণ পাওয়া গেছে, সেসব করদাতাকে তলব করে বিনিয়োগের ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, গুলশান, বনানী এলাকায় কর ফাঁকির আরও বেশকিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো পর্যালোচনা করতে একটি টিম কাজ করছে।

কালোটাকা সাদা করার সহজ পথ : আবাসন খাত কালোটাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সহজ পথে পরিণত হয়েছে। কারণ, নতুন আয়কর আইনে ‘বিশেষ’ হারে কর দেওয়ার মাধ্যমে বিনিয়োগ প্রদর্শনের সুযোগ রাখা হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে যেখানে একজন করদাতাকে নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে টাকা বৈধ করতে হয়, সেখানে আবাসন খাতে ‘বিশেষ’ ব্যবস্থা রাখায় ২-৪ শতাংশ জরিমানা দিয়েই টাকা বৈধ করা যাচ্ছে। উচ্চশ্রেণির এক গোষ্ঠী করদাতা সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে।

নতুন আয়কর আইন অনুযায়ী, যে কোনো ব্যক্তি গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকায় ২০০ বর্গমিটার বা ২১৫২ বর্গফুটের (১ বর্গমিটার= ১০.৭৬ বর্গফুট) কম আয়তনবিশিষ্ট ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে বর্গমিটারপ্রতি ৪ হাজার টাকা কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করতে পারছেন। আর ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, ডিওএইচএস, উত্তরা এলাকার জন্য এই কর ৩ হাজার টাকা নির্ধারিত আছে। একাধিক ফ্ল্যাট থাকলে আলোচ্য করের ২০ শতাংশ বেশি এবং কর বিভাগ অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের তথ্য উদ্ঘাটন করলে আলোচ্য করের শতভাগ অর্থাৎ দ্বিগুণ জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এক ব্যক্তি গুলশান এলাকায় অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রতি বর্গফুট ২০ হাজার টাকা দরে ১৫০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনলেন। এক্ষেত্রে ফ্ল্যাটের মোট দাম পড়ল (রেজিস্ট্রেশন ব্যতীত) ৩ কোটি টাকা। যেহেতু তিনি অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে ফ্ল্যাট কিনেছেন, তাই বিশেষ হারে কর দেওয়ার মাধ্যমে ফ্ল্যাটটি রিটার্নে দেখানোর সুযোগ রয়েছে। এজন্য তাকে মাত্র ৫ লাখ ৫৭ হাজার টাকা (১৩৯ বর্গমিটারের ফ্ল্যাটের জন্য) আয়কর দিতে হবে। অর্থাৎ বিনিয়োগকৃত অর্থের মাত্র এক দশমিক ৮৫ শতাংশ কর দিতে তিনি কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ পেয়েছেন।

যদি তিনি বিনিয়োগের তথ্য কর বিভাগে ঘোষণা না দেন (রিটার্নে উল্লেখ না করলে) এবং পরবর্তী সময়ে কর বিভাগ বা অন্য সংস্থার হাতে ধরা পড়েন, তাহলে আয়কর আইন অনুযায়ী দ্বিগুণ কর পরিশোধ করলে তার বিরুদ্ধে সরকারি অন্য কোনো দপ্তর বা সংস্থা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে ১১ লাখ ১৪ হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে। তাহলে কর বিভাগ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে না। অর্থাৎ ৩ দশমিক ৭ শতাংশ কর দিয়ে দায়মুক্তি পাবেন।

অন্যদিকে এই ব্যক্তি যদি স্বাভাবিক নিয়মে (ব্যক্তিশ্রেণীর সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ) ৩ কোটি টাকার ওপর কর দিতেন, তাহলে তাকে ৭৫ লাখ টাকা আয়কর দিতে হতো। কিংবা নির্ধারিত হারের ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করতেন, তাহলে তাকে ৭৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা আয়কর দিতে হতো। আর অর্থনৈতিক অঞ্চল বা হাইটেক পার্কে শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগ করলে তাকে ৩০ লাখ টাকা আয়কর দিতে হতো।

কর কর্মকর্তারা বলছেন, অভিজাত এলাকার ফ্ল্যাটগুলো কালোটাকা মালিকদের বিনিয়োগের নতুন কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। যৎসামান্য কর দিয়ে তারা আয়কর রিটার্নে টাকা বৈধ করছেন। বছর খানেক পর সেই ফ্ল্যাট বিক্রি করে পুরো অর্থ রিটার্নে দেখাচ্ছেন, যা সৎ ও নিয়মিত করদাতাদের নিরুৎসাহিত করতে পারে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খান যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের প্রভিশন চিরস্থায়ী ভিত্তিতে রাখা ঠিক নয়। অর্থনীতির প্রয়োজনে সাময়িকভাবে এ ধরনের সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হলেও আবাসন খাত থেকে বেশি রাজস্ব আসছে না। তাই এ বিধান রাখার যৌক্তিকতা নেই। তিনি আরও বলেন, এতে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হন এবং অপ্রদর্শিত অর্থ উপার্জনের বা অর্থ লুকানোর প্রবণতা তৈরি হয়। এর পরিবর্তে কর বিভাগের দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি অটোমেশনের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত অর্থ উৎপত্তির পথ বন্ধ করার পন্থা খোঁজা উচিত।

আরো খবর.......

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

সিআইসি’র অনুসন্ধান প্রভাবশালীদের ফ্ল্যাট কেনায় কর ফাঁকি

আপডেট টাইম : ১১:৪৩:৪৮ পূর্বাহ্ণ, বুধবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

তালিকায় আছেন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, আইনজীবী
কর গুলশান, বনানী, বারিধারা ও ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকায় প্রভাবশালীদের ফ্ল্যাট কেনায় ভয়াবহ আয়কর ফাঁকির প্রমাণ মিলেছে। স্বনামধন্য ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, আইনজীবী, জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় আছেন এ তালিকায়। আবাসিক ও বাণিজ্যিক ফ্লোর কেনার প্রকৃত অর্থ গোপন করে আয়কর ফাঁকি দিয়েছে ডজনখানেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

আবার অনেকে বিনিয়োগের তথ্য রিটার্নে উল্লেখ করেননি। এতে সরকার অর্ধশত কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।

সূত্র জানায়, ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান, বারিধারা, বনানীতে জমি, ফ্ল্যাট বা ফ্লোর স্পেসের মূল্য আকাশছোঁয়া হলেও এসব এলাকায় বহুতল ভবনে স্পেস বিক্রি বা হস্তান্তর দলিলে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে অনেক কম মূল্য দেখানো হচ্ছে। ফ্ল্যাট নির্মাণে প্রতি বর্গফুটে যে খরচ হয়, ডেভেলপার কোম্পানি ও ক্রেতা যোগসাজশ করে তার চেয়েও কম দাম দেখাচ্ছে। সিআইসির প্রাথমিক অনুসন্ধানে কোম্পানি, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী শ্রেণির করদাতারা বাণিজ্যিক/আবাসিক স্পেস ক্রয়ে অর্ধশত কোটি টাকার কর ফাঁকির ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি বনানী-তেজগাঁও লিংক রোডের একটি বাণিজ্যিক ভবন এবং গুলশান অ্যাভিনিউ রোডের একটি আবাসিক ভবনের কাগজপত্র এবং এসব ভবনে ফ্ল্যাট ক্রেতার আয়কর নথি অনুসন্ধান করে সিআইসি দেখতে পায়, একাধিক ক্রেতা ক্রয়কৃত ফ্ল্যাট বা স্পেসের বিনিয়োগ মূল্য আয়কর নথিতে আদৌ প্রদর্শন করেননি, করলেও প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক কমে নামমাত্র মূল্য প্রদর্শন করেছেন। আবার কেউ কেউ তিন-চার বছর ধরে কিস্তিতে অগ্রিম টাকা পরিশোধ করে এলেও পরিশোধকৃত কিস্তির টাকা অগ্রিম হিসাবে আয়কর নথিতে প্রদর্শন করেননি। পরবর্তী সময়ে কম মূল্যে ফ্ল্যাট বা স্পেস রেজিস্ট্রেশন করেছেন।

সিআইসির অনুসন্ধানে দেখা যায়, উত্তর গুলশানে দক্ষিণমুখী লেকের পাড়ে অবস্থিত একটি বহুতল ভবনে ঢাকার একটি চক্ষু হাসপাতালের স্বনামধন্য একজন চক্ষুবিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ফ্ল্যাট কেনেন। ডাক্তারি পেশা থেকে অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধ করার জন্য ৪৩৭৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ১৩ কোটি টাকায় কিনলেও সাড়ে ৪ কোটি টাকা মূল্যে রেজিস্ট্রেশন নেন। বাকি সাড়ে ৮ কোটি টাকার সম্পদ খুব সহজেই বৈধ করে নিয়েছেন। জাতীয় ক্রিকেট দলের একজন ক্রিকেটার আবাসিক ভবনটিতে ১২ কোটি ৪০ লাখ টাকায় ফ্ল্যাট ক্রয় করলেও তিনি তা আয়কর নথিতে প্রদর্শন করেননি। আবার একটি সিকিউরিটিজ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ৯৭০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটি ৪৯ কোটি টাকায় কিনলেও ১০ কোটি টাকায় রেজিস্ট্রেশন নিয়েছেন। এতে ওই ব্যক্তি ৩৯ কোটি টাকার সম্পদের উৎসের ওপর কর ফাঁকি দিয়েছেন। ভবনে অন্য একজন ক্রেতা হচ্ছেন সুপ্রিমকোর্টের স্বনামধন্য ব্যারিস্টার। তিনি ফ্ল্যাট ক্রয়ে প্রায় ১৩ কোটি টাকা পরিশোধ করলেও এখনো ফ্ল্যাটটি আয়কর নথিতে প্রদর্শন করেননি। অন্যদিকে একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী গুলশান ৫০ নম্বর রোডের বহুতল ভবনে প্রায় ২৮ কোটি টাকার স্পেস ক্রয় করলেও আয়কর রিটার্নে তা প্রদর্শন করেননি।

অন্যদিকে বনানী-তেজগাঁও লিংক রোডের বাণিজ্যিক ভবনটিতে স্পেস কিনেছে-এমন একটি সিকিউরিটিজ কোম্পানির অডিট রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সিকিউরিটিজ কোম্পানিটি স্পেস ক্রয়ে ৭৩ কোটি টাকা পরিশোধ করলেও অডিট রিপোর্টে প্রদর্শন করেছেন মাত্র ৫৫ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে পুরো বিনিয়োগের প্রায় ৭২ কোটি টাকা কর ফাঁকি দিয়ে বৈধ করা হয়েছে। অন্যদিকে একই ভবনে অপর কোম্পানি স্পেস কেনার ক্ষেত্রে খরচ করেছে ১৩ কোটি টাকা; কিন্তু অডিট রিপোর্টে তা প্রদর্শন করা নেই। আবার একটি নামকরা সাইকেল প্রস্তুত ও বাজারজাতকারী কোম্পানি ৩৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা মূল্যের বাণিজ্যিক স্পেস ক্রয় করলেও তা আয়কর নথিতে প্রদর্শন করেনি। এরকম রাজস্ব ফাঁকির আরও ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইসির এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে যেসব ব্যক্তি ও কোম্পানি করদাতার আয়কর নথিতে তথ্য গোপনের প্রমাণ পাওয়া গেছে, সেসব করদাতাকে তলব করে বিনিয়োগের ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, গুলশান, বনানী এলাকায় কর ফাঁকির আরও বেশকিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো পর্যালোচনা করতে একটি টিম কাজ করছে।

কালোটাকা সাদা করার সহজ পথ : আবাসন খাত কালোটাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সহজ পথে পরিণত হয়েছে। কারণ, নতুন আয়কর আইনে ‘বিশেষ’ হারে কর দেওয়ার মাধ্যমে বিনিয়োগ প্রদর্শনের সুযোগ রাখা হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে যেখানে একজন করদাতাকে নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে টাকা বৈধ করতে হয়, সেখানে আবাসন খাতে ‘বিশেষ’ ব্যবস্থা রাখায় ২-৪ শতাংশ জরিমানা দিয়েই টাকা বৈধ করা যাচ্ছে। উচ্চশ্রেণির এক গোষ্ঠী করদাতা সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে।

নতুন আয়কর আইন অনুযায়ী, যে কোনো ব্যক্তি গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকায় ২০০ বর্গমিটার বা ২১৫২ বর্গফুটের (১ বর্গমিটার= ১০.৭৬ বর্গফুট) কম আয়তনবিশিষ্ট ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে বর্গমিটারপ্রতি ৪ হাজার টাকা কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করতে পারছেন। আর ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, ডিওএইচএস, উত্তরা এলাকার জন্য এই কর ৩ হাজার টাকা নির্ধারিত আছে। একাধিক ফ্ল্যাট থাকলে আলোচ্য করের ২০ শতাংশ বেশি এবং কর বিভাগ অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের তথ্য উদ্ঘাটন করলে আলোচ্য করের শতভাগ অর্থাৎ দ্বিগুণ জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এক ব্যক্তি গুলশান এলাকায় অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রতি বর্গফুট ২০ হাজার টাকা দরে ১৫০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনলেন। এক্ষেত্রে ফ্ল্যাটের মোট দাম পড়ল (রেজিস্ট্রেশন ব্যতীত) ৩ কোটি টাকা। যেহেতু তিনি অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে ফ্ল্যাট কিনেছেন, তাই বিশেষ হারে কর দেওয়ার মাধ্যমে ফ্ল্যাটটি রিটার্নে দেখানোর সুযোগ রয়েছে। এজন্য তাকে মাত্র ৫ লাখ ৫৭ হাজার টাকা (১৩৯ বর্গমিটারের ফ্ল্যাটের জন্য) আয়কর দিতে হবে। অর্থাৎ বিনিয়োগকৃত অর্থের মাত্র এক দশমিক ৮৫ শতাংশ কর দিতে তিনি কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ পেয়েছেন।

যদি তিনি বিনিয়োগের তথ্য কর বিভাগে ঘোষণা না দেন (রিটার্নে উল্লেখ না করলে) এবং পরবর্তী সময়ে কর বিভাগ বা অন্য সংস্থার হাতে ধরা পড়েন, তাহলে আয়কর আইন অনুযায়ী দ্বিগুণ কর পরিশোধ করলে তার বিরুদ্ধে সরকারি অন্য কোনো দপ্তর বা সংস্থা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে ১১ লাখ ১৪ হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে। তাহলে কর বিভাগ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে না। অর্থাৎ ৩ দশমিক ৭ শতাংশ কর দিয়ে দায়মুক্তি পাবেন।

অন্যদিকে এই ব্যক্তি যদি স্বাভাবিক নিয়মে (ব্যক্তিশ্রেণীর সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ) ৩ কোটি টাকার ওপর কর দিতেন, তাহলে তাকে ৭৫ লাখ টাকা আয়কর দিতে হতো। কিংবা নির্ধারিত হারের ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করতেন, তাহলে তাকে ৭৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা আয়কর দিতে হতো। আর অর্থনৈতিক অঞ্চল বা হাইটেক পার্কে শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগ করলে তাকে ৩০ লাখ টাকা আয়কর দিতে হতো।

কর কর্মকর্তারা বলছেন, অভিজাত এলাকার ফ্ল্যাটগুলো কালোটাকা মালিকদের বিনিয়োগের নতুন কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। যৎসামান্য কর দিয়ে তারা আয়কর রিটার্নে টাকা বৈধ করছেন। বছর খানেক পর সেই ফ্ল্যাট বিক্রি করে পুরো অর্থ রিটার্নে দেখাচ্ছেন, যা সৎ ও নিয়মিত করদাতাদের নিরুৎসাহিত করতে পারে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খান যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের প্রভিশন চিরস্থায়ী ভিত্তিতে রাখা ঠিক নয়। অর্থনীতির প্রয়োজনে সাময়িকভাবে এ ধরনের সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হলেও আবাসন খাত থেকে বেশি রাজস্ব আসছে না। তাই এ বিধান রাখার যৌক্তিকতা নেই। তিনি আরও বলেন, এতে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হন এবং অপ্রদর্শিত অর্থ উপার্জনের বা অর্থ লুকানোর প্রবণতা তৈরি হয়। এর পরিবর্তে কর বিভাগের দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি অটোমেশনের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত অর্থ উৎপত্তির পথ বন্ধ করার পন্থা খোঁজা উচিত।