মুক্তিযুদ্ধ একদিকে যেমন স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, তেমনই কেড়ে নিয়েছে বহু বুদ্ধিজীবী, আত্মার আত্মীয়দের৷ বহু নারী হয়েছেন স্বামী, সন্তান হারা৷ অনেকের কাছেই যুদ্ধের স্মৃতি হয়ে উঠেছে এক তমসাচ্ছন্ন রাত্রি৷
- আপডেট টাইম : ০৪:৩৮:২৪ পূর্বাহ্ণ, শনিবার, ২৫ মার্চ ২০২৩
- / ১৫৪ ৫০০০.০ বার পাঠক
মুক্তিযুদ্ধ একদিকে যেমন স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, তেমনই কেড়ে নিয়েছে বহু বুদ্ধিজীবী, আত্মার আত্মীয়দের৷ বহু নারী হয়েছেন স্বামী, সন্তান হারা৷ অনেকের কাছেই যুদ্ধের স্মৃতি হয়ে উঠেছে এক তমসাচ্ছন্ন রাত্রি৷
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস ছিল উত্তাল ঘটনাবহুল মাস। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ হঠাৎ এক হটকারী সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার আপামর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর ২৫ মার্চ পর্যন্ত নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন রূপ নেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে।
উত্তাল মার্চ, ১৯৭১
ঘটনাক্রম
১৯৭১ সালের ১ মার্চ স্বৈরাচার ইয়াইয়া খান মার্চ বেতারে ঘোষণা দিয়ে ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করে, তখন উত্তাল হয়ে ওঠে সারা দেশ। দেশব্যাপী ২ ও ৩ মার্চ হরতালের ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য রাতেই পাকিস্তানি জান্তারা কার্ফ্যু ঘোষণা করে। কিন্তু তাদের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে মিছিল বের করে শ্রমিক-ছাত্র-জনতা। একাধিক স্থানে মিছিলের ওপর গুলি চালায় হানাদাররা। ২ মার্চ অচল হয়ে পড়ে পুরো বাংলাদেশ। এদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ওড়ানো হয় বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা। ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন আধাবেলা হরতালের ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু।
২ মার্চ দিন ও রাতে, ঢাকাসহ সারাদেশে হানাদার বাহিনীর গুলিতে শতাধিক ব্যক্তি নিহত ও কয়েকশ’ মানুষ আহত হয়। কিন্তু তাতে দমে না গিয়ে, উল্টো আন্দোলনের গতি বৃদ্ধি পায় ৩ মার্চ। বিকালে পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে পাঠ করা হয় স্বাধীনতার ইশতেহার। জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমারেখা, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ও রাষ্ট্রের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়।
৪ মার্চ আরো উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ, দাবানলের মতো ছড়িয়ে যেতে থাকে আন্দোলন। চট্টগ্রামে নিহত হয় শতাধিক ব্যক্তি। ‘পিন্ডি না ঢাকা- ঢাকা, ঢাকা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো দেশ।
৫ ও ৬ মার্চেও একই অবস্থা বিদ্যমান থাকে। অফিস-আদালত ও খাজনা বন্ধ রেখে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যেতে বলেন বঙ্গবন্ধু। এমনকি ৭ তারিখে সার্বিক নির্দেশনা দেবেন বলেও জানান।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতা সংগ্রামের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এসে সমবেত হয় ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।বেলা ৩টার পর মঞ্চে ওঠেন বাঙালির আশা-আকাঙক্ষার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার জন্য সার্বিক নির্দেশনা দেন তিনি। পাকিস্তানকে পুরোপুরিভাবে অচল করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এরপর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ।
১১ মার্চ, সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান। এমনকি সিনেমা শুরুর আগে, সিনেমা হলেও পাকিস্তানের জাতীয় সংগীতের পরিবর্তে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি বাজানো শুরু হয়।
১৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুসারে দেশের প্রতিটি এলাকায় এলাকায় গঠিত হয় সংগ্রাম কমিটি। পাকিস্তানের পুরো শাসন ব্যবস্থা কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার বিবৃতিতে বলেন, ‘… আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধররা যাতে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে এবং মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারে, সেজন্য আমরা মরতেও প্রস্তুত।… মুক্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাব।… বাংলাদেশের মুক্তির উদ্দীপনা নিভিয়ে দেওয়া যাবে না।’
পাকিস্তানি স্বৈরাচার জেনারেল ইয়াহিয়া ঢাকায় আসে ১৫ মার্চ। কালো পতাকা দেখানো হয় তাকে। কোথাও কোথাও স্বাধীন বাংলার পতাকাও ওড়ানো হয়।
১৬ মার্চ থেকে শুরু হয় আলোচনা। মূলত আলোচনার নামে পাকিস্তানিরা সময়ক্ষেপণ করছিল এবং তাদের সেনাবাহিনী ও অস্ত্র আনছিল। বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পর, ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসকে ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালনের নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ধানমন্ডির নিজ বাড়িতেও স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন এদিন। দেশজুড়ে শুরু হয় পাকিস্তানি পণ্য বর্জন।
২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান সাদা পোশাকে গোপনে ঢাকা ছেড়ে চলে যান। এই খবর পাওয়া মাত্র দলীয় নেতাকর্মীদের মাধ্যমে দেশের সব প্রান্তে স্বাধীনতার চূড়ান্ত বার্তা পাঠাতে শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনারা। সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
২৫ মার্চ রাত ১২টার পর তথা ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘…এটাই সম্ভবত আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।… পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন….।’ (অনূদিত)। বঙ্গবন্ধুর নিজের কণ্ঠের এই ঘোষণা বিশেষ ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সম্প্রচারিত করা হয়। শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ।
সংগ্রহ-দৈনিক সময়ের কন্ঠ