বাংলার জন্ম
- আপডেট টাইম : ১২:১৪:০৫ অপরাহ্ণ, রবিবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৩
- / ২৬২ ৫০০০.০ বার পাঠক
নিরক্ষর হলেও মোঘল সম্রাট আকবর একজন সত্যিকারের রাজনীতিক ছিলেন। তাঁর আমলে গৌড়-বঙ্গের সর্বত্র বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও তিনি যখন দেখতে পেয়েছিলেন যে, বামিয়ান গিরিবর্ত্ম থেকে চট্টগ্রাম এবং কাশ্মীর থেকে খান্দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল ভূখণ্ডের উপরে তাঁর অধিকার প্রসারিত হয়েছে, এবং মান সিংহ, মুনাইম খাঁ প্রভৃতি শক্তিশালী যোদ্ধারা বিদ্রোহীদের দমন করবার দায়িত্ব নিয়েছেন, তখন তাঁর বুঝতে বাকি থাকেনি যে, অদূর ভবিষ্যতে মোঘল অধিকার সেই বিশাল জনপদের উপরে দৃঢ়ভাবেই প্রতিষ্ঠিত হবে। তাই বাংলার শেষ আফগান সুলতান দাউদ কররানির আত্মসমর্পণের পরে তিনি রাজা টোডরমলকে রাজধানীতে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে তাঁর সদ্যগঠিত সাম্রাজ্যের রাজস্ব তালিকা প্রণয়ন ও শাসন প্রণালী নির্ধারণের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। সেই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করবার জন্য টোডরমল মোঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পদস্থ রাজপুরুষ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে আগ্রায় আহ্বান জানিয়ে তাঁদের সাহায্যে সমগ্র মোঘল সাম্রাজ্যকে তেরটি সুবায় ভাগ করেছিলেন। সেই সময়ে, গৌড় থেকে যাঁরা আগ্রায় গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে কররানিদের কানুনগো দফতরের দু’জন পদস্থ অফিসার – ‘শ্রীহরি’ ও তাঁর ভাই ‘জানকীবল্লভ গুহ’ ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করবার পরে তিনি তিনটি স্বতন্ত্র জনপদ – রাঢ়, বরেন্দ্র ও বঙ্গকে সংযুক্ত করে যে প্রদেশটি গঠিত করেছিলেন, সেটিই ছিল মোঘল যুগের ‘সুবা বাংলা’। সুবা বাংলার গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই যুগ যুগান্তরের গৌড় ভারতের ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। রাজা টোডরমলের সেই বিভাগকে ‘আবুল ফজল’ তাঁর ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে যেভাবে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন, তা থেকে জানা যায় যে, ওই সময়ে উড়িষ্যাসহ সুবা বাংলার পূর্বদিকে সমুদ্র, উত্তর ও দক্ষিণে (?) পর্বত এবং পশ্চিমে সুবা বিহার অবস্থিত ছিল। ঢাকা ও ময়মনসিংহের অংশ বিশেষ নিয়ে গঠিত ভাটি রাজ্যটি তখন বাংলার পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত একটি বিদ্রোহী জনপদ ছিল। ত্রিপুরা তখনও পর্যন্ত একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। সেই রাজ্যের তৎকালীন অধিপতি ‘যশোমাণিক্যের’ সৈন্য সংখ্যা ছিল এক সহস্র হস্তী ও দুই লক্ষ পদাতিক; তবে তাঁর কোন অশ্বারোহী বাহিনী ছিল না বললেই চলে। বাংলার উত্তর সীমান্তে অবস্থিত কুচবিহার তখন আরেকটি স্বাধীন রাজ্য ছিল, এবং সেটির সৈন্য সংখ্যা ছিল – এক হাজার অশ্বারোহী ও এক লক্ষ পদাতিক। কামরূপ সেই রাজ্যের একটি অংশ ছিল; তখন সেটিকে ‘কুচহাজো’ও বলা হত। তার ওপারে অবস্থিত আসাম তখন খুবই শক্তিশালী রাজ্য ছিল। আসামের সন্নিহিত দেশ তিব্বতের গা ঘেঁষে চলে গিয়েছিল ‘খিতাই’; তখন যেটির প্রকৃত নাম ছিল ‘মহাচীন’। বাংলার উত্তর-পূর্ব (?) সীমান্তে আরাকান তখন একটি স্বতন্ত্র দেশ ছিল, এবং চট্টগ্রাম বন্দর সেই দেশেই অবস্থিত ছিল।
আবুল ফজল লিখেছিলেন, “বাংলা ১৯ সরকার ও ৬৮২ মহলে বিভক্ত। সেগুলির মধ্যে সরকার জিন্নতাবাদের স্থান অতি উচ্চ। জিন্নতাবাদ খুবই প্রাচীন নগর। পূর্বে এর নাম ছিল লখনৌতি – গৌড়ও বলা হত। মহামান্য স্বৰ্গীয় সম্রাট জিন্নতবানী আসিয়ানী (হুমায়ুন) এখানে অবস্থান করবার সময়ে নিজ নামানুসারে বর্তমান নামটি প্রদান করেন। এখানে একটি চমৎকার দুর্গ আছে। … মামুদাবাদের দুর্গ জলায় ঘেরা। শের শাহ এই দুর্গ জয় করলে রাজার হাতীগুলি নিকটবর্তী জঙ্গলে পালিয়ে যায়; সেখানে তাদের সংখ্যা এখন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার খলিফাবাদেও হাতী পাওয়া যায়। সরকার বাকলা সমুদ্র তীরে অবস্থিত। মহামান্য আকবরের রাজ্যারম্ভের ২৯তম বছরে এখানে সমুদ্র থেকে প্রচণ্ড ঝড় ও বন্যা এসে দুই লক্ষ লোকের প্রাণহানি ঘটায়। একটি হিন্দু মন্দির ছাড়া সব কিছুই তখন বন্যার জলে ডুবে যায়। সেখানকার রাজা ওই মন্দিরের উপরে উঠে প্রাণ নিজের বাঁচান। … সরকার ঘোড়াঘাট পট্টবস্ত্রের জন্য বিখ্যাত। এখানে যথেষ্ট ঘোড়াও পাওয়া যায়। বরবকাবাদ সরকারে গঙ্গাজল নামে যে সূক্ষ্ম বস্ত্র প্রস্তুত হয় তার খ্যাতি সর্বত্র। সরকার বাজুহাতে যে সব বড় বড় গাছ জন্মায় সেগুলি থেকে নৌকা ও কড়িবরগার কাঠ সংগৃহীত হয়। এখানে একটি লোহার খনি আছে। … সরকার সোনারগাঁয়ে কসবা বস্ত্র তৈরী হয়। এখানকার চরসিন্ধুর শহরে যে জলাশয়টি আছে তার জলে কাপড় কাচলে সেই কাপড় খুব সাদা হয়। সরকার সিলেট পর্বতময়। এখানে সান্তারা নামে যে ফল পাওয়া যায় তা ঠিক কমলালেবুর মত। এখানকার লোকেরা বর্ষার সময়ে গাছ কেটে কয়েক মাস পরে সেগুলি ঘরে তোলে। সিলেটের বনরাজ পাখীর রং কালো, চোখ লাল, লেজ লম্বা ও ডানা বিচিত্র বর্ণের। এই সরকার থেকে বহু খোজা সংগৃহীত হয়। … চট্টগ্রাম সমুদ্র তীরবর্তী বৃহৎ বন্দর ও বাণিজ্য প্রধান স্থান। ব্যবসায়ের জন্য বহু খৃষ্টান এখানে এসে বাস করে। এই সরকারটি আসলে আরাকান রাজ্যে অবস্থিত। সরকার সরিফাবাদে বৃহদাকার ষাঁড়, ছাগল ও মুরগী পাওয়া যায়। সাতগাঁয়ে দুটি বৃহৎ বাজার রয়েছে। একটির নাম সাতগাঁ ও অন্যটির নাম হুগলী। দুটিই বর্তমানে ফিরিঙ্গীদের অধিকারে।”
রাজা টোডরমলের যে রাজস্বতালিকা থেকে আবুল ফজল সুবা বাংলার উপরোক্ত যে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন, সেটাকে মোঘল যুগে ‘তকসীম জমা’ বা ‘আসল তুমার জমা’ বলা হত। ওই তালিকায় বাংলাকে ১৯টি সরকার ও ৬৮২টি মহলে ভাগ করা হয়েছিল। সেগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ –
(১) সরকার তাড়া: মহল – ৫২, রাজস্ব – ২,৪০,৭৯, ৩৯৯.৫০ দাম।
(২) সরকার জিন্নতাবাদ: মহল – ২৬, রাজস্ব – ১৫,৭৩,১৯৬ দাম।
(৩) সরকার ফতাহাবাদ: মহল – ৩১, রাজস্ব – ৭৯,৬৯,৫৬৭ দাম, অশ্বারোহী – ৯০০, পদাতিক – ৫০,৭০০।
(৪) সরকার মামুদাবাদ: মহল – ৮৮, রাজস্ব – ১,১৬,১০,২৫৬ দাম, অশ্বারোহী – ২০০, পদাতিক – ১০,০০।
(৫) সরকার খলিফাবাদ: মহল – ৩৫, রাজস্ব – ৫৪,০২,১৪০ দাম, অশ্বারোহী – ১০০, পদাতিক – ১৫,১৫০।
(৬) সরকার বাকলা: মহল – ৪, রাজস্ব – ৭১,৩০,৬৪৫ দাম, অশ্বারোহী – ৩২০, পদাতিক – ১৫,০০০।
(৭) সরকার পূর্ণিয়া: মহল – ৯, রাজস্ব – ৬৪,০৮, ৭৯৮ দাম, অশ্বারোহী – ১০০, পদাতিক – ৫,০০০।
(৮) সরকার তাজপুর: মহল – ২৯, রাজস্ব – ৬৪,৮৩,৮৫ ৭ দাম, অশ্বারোহী – ১০০, পদাতিক – ৭,০০০।
(৯) সরকার ঘোড়াঘাট: মহল – ৮৪, রাজস্ব – ৮৩,৮৩,০৭২. ৫০ দাম, হস্তী- ৫০, অশ্বারোহী – ৯০০, পদাতিক – ৩২,৬৮০।
(১০) সরকার জিঞ্জিরা: মহল – ২১, রাজস্ব – ৫৮,০৩,২৭৫ দাম, অশ্বারোহী – ৫০, পদাতিক – ৭,০০০।
(১১) সরকার বরবকাবাদ: মহল – ৩৮, রাজস্ব – ১,৭৪,৫১,৫৩২ দাম, অশ্বারোহী – ৫০, পদাতিক – ৭,০০০।
(১২) সরকার সিলেট: মহল – ৮, রাজস্ব – ৬৬,৮১,৬২০ দাম, হস্তী – ১৯০, অশ্বারোহী – ১,১০০, পদাতিক – ৪২,৯২০।
(১৩) সরকার চট্টগ্রাম: মহল – ৭, রাজস্ব – ১১,৪২,৩১০ দাম, অশ্বারোহী – ১০০, পদাতিক – ১,৫০০।
(১৪) সরকার সরিফাবাদ: মহল – ২৬, রাজস্ব – ২,২৪,৮৮,৭৫০ দাম, অশ্বারোহী – ২০০, পদাতিক – ৫,০০০।
(১৫) সরকার সেলিমাবাদ: মহল – ৩১, রাজস্ব – ১,৭৬,২৯,৭৬৪ দাম, অশ্বারোহী – ১০০, পদাতিক – ৫,০০০।
(১৬) সরকার বাজুহা: মহল – ৩২, রাজস্ব – ৩,৯৫, ১৬,৮৭১ দাম, হস্তী – ১০, অশ্বারোহী – ১,৭০০, পদাতিক – ৪৫,৩০০।
(১৭) সরকার সোনারগাঁ: মহল – ৩২, রাজস্ব – ১,০৩,৩১,৩৩৩ দাম, হস্তী – ২০০; অশ্বারোহী – ১,৫০০, পদাতিক – ৪৬,০০০।
(১৮) সরকার সাতগাঁ: মহল – ৫৩, রাজস্ব – ১,৬৭,২৪, ৭২০ দাম, কলিকাতা + মেকুমা + বরবাকপুর = ৯,৩৬,২১৫ দাম; অশ্বারোহী – ৫০, পদাতিক – ৬,০০০।
(১৯) সরকার মান্দারণ: মহল – ১৬, রাজস্ব – ৯৪,০৩,৪০০ দাম।
কুচবিহার ও বিষ্ণুপুর-বাঁকুড়া তখন স্বতন্ত্র রাজ্য এবং মেদিনীপুর সুবা উড়িষ্যার সরকার জলেশ্বরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই কারণে বাংলার রাজস্ব তালিকায় ওই অঞ্চলগুলির স্থান হয়নি। সরকার সিলেট, সরকার চট্টগ্রাম ও সরকার সোনারগাঁ তখনও শত্রু কবলিত থাকলেও, সেগুলির পুনরুদ্ধার যে আসন্ন ছিল, তার ইঙ্গিত উপরোক্ত রাজস্ব তালিকায় পাওয়া যায়। তখন সুবা বাংলার রাজস্ব সর্বসাকুল্যে ১,৪৯,৬৭, ৪৮২ টাকা ৬ আনা ৭ পাই ছিল। কিন্তু সে সবই ছিল কাগজে কলমে। কারণ বারো ভূঁইয়াদের অনেকেই তখন মোঘল বিরোধী, তাঁরা কোন রাজস্ব দিতেন না। তাই যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হত তা অন্যান্য সুবা থেকে আনতে হত। তবে তখন ‘খালসা জমি’ অর্থাৎ বাদশাহের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন জমির পরিমাণ কিছু কম ছিল না। সেখানকার প্রজারা সরকারী কোষাগারে মুদ্রায় রাজস্ব জমা দিতেন। মোঘল সাম্রাজ্যের অন্যান্য সুবার মত উৎপন্ন শস্যের পরিবর্তে নগদ অর্থে রাজস্ব প্রদান বাংলা সুবার চিরাচরিত রীতি ছিল। আকবর সেই রীতিকে মেনে নিয়ে ১৫৯২ খৃষ্টাব্দের ১২ই ফেব্রুয়ারী তারিখে ‘রায় রামদাস’কে বাংলার তহশীলদার নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু তিনি যে কত টাকা আদায় করতেন, সেসবের বিবরণ কোথাও লিপিবদ্ধ নেই।