সাভার মডেল থানার কাউন্দিয়া পুলিশ ফাঁড়ির অসৎ পুলিশ সদস্যের নিয়ন্ত্রণে চলছে মাদক ব্যবসা পর্ব – ২

- আপডেট টাইম : ০১:১৭:১২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫
- / ৪ ৫০০০.০ বার পাঠক
সরকার জামাল :- ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিচ্ছে মাদক কারবারিরা। পুলিশের তল্লাশিচৌকি (চেকপোস্ট), টহল ও অভিযান না থাকায় সারাদেশে সক্রিয় হয়ে উঠেছে তারা। এই সুযোগে মাদকের কয়েকটি বড় চালান বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢুকেছে। মাদক পাচারের নতুন রুটেরও খোঁজ মিলেছে।
রাজধানীর উপকন্ঠ সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়ন দিন দিন পরিণত হচ্ছে মাদকের অভয়ারণ্যে। রাজধানীর মিরপুর, গাবতলী ও আমিনবাজার লাগোয়া কাউন্দিয়া ইউনিয়নে গ্রামের সংখ্যা ২২টি। তুরাগ নদীবেষ্ঠিত কাউন্দিয়ায় যাতায়াতের একমাত্র ভরসা নৌকা। এ কারণে মাদক ব্যবসায়ী ও সেবীরা চারিদিকে নদীবেষ্টিত এ দ্বীপ এলাকাকে নিরাপদ স্পট হিসেবে বেছে নিয়েছে।
সারাদেশে আইনশৃংখলা বাহিনী এ ব্যাপারে তৎপর থাকলেও কতিপয় পুলিশ সদস্য ও তাদের সোর্সদের সাথে মাদক ব্যবসায়ীদের সখ্যতার কারণে মাদকের মূল গডফাদাররা রয়ে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ফলে মাদকের করাল গ্রাসে ধ্বংসের পথে যুবসমাজ। স্কুল কলেজগামী শিক্ষার্থীরা আসক্ত হয়ে পড়ছে মাদকের এ মরণ নেশায়। মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে অনেক সময় তারা চুরি, ছিনতাই, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে এলাকাবাসীসহ অভিভাবকরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর মিরপুর, গাবতলি ও আমিনবাজার সংলগ্ন চারিদিকে নদীবেষ্টিত কাউন্দিয়ায় প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ মাদকের চালান প্রবেশ করছে। এসব চালানের মধ্যে রয়েছে গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা ও ফেনসিডিল। আর এসব মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে কাউন্দিয়া ফাঁড়ি পুলিশের ইনচার্জ কাজী আব্দুর রহিম। তার ছত্রছায়ায় মাদক কারবারিরা নির্বিঘ্নে মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় সৃষ্টি হয়েছে মাদকের ভয়াবহ পরিস্থিতি।
এসব মাদক ব্যবসায়ী ও অসৎ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও পত্রপত্রিকায় একাধিক সংবাদ প্রকাশ হলেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না বরং অপকর্ম ঢাকতে মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে দু’এক জন মাদক ব্যবসায়ীকে ধরে চালান দেন তিনি। আর এ কাজে তাকে সহযোগিতা করে থাকে নামধারী কিছু সাংবাদিক বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় এলাকায় বেড়ে গেছে মাদকের ছড়াছড়ি, অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছে মাদক ব্যবসা।
গত বুধবার (২৩ এপ্রিল) ‘কাউন্দিয়া ফাঁড়ি’র ইনচার্জের ছত্রছায়ায় চলছে মাদকের রমরমা বাণিজ্য’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর মাদক ব্যবসায়ী ধরতে তৎপর হয় কাউন্দিয়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ কাজী আব্দুর রহিম। তিনি এতটাই তৎপর হন যে বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীকে সেভ করে পরদিন বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) বাবুল নামের এক প্রতিবন্ধীকে গ্রেফতার করে মাদক মামলায় চালান দেয়। অভিযোগ উঠেছে কাউন্দিয়া মধ্যপাড়ার হাতকাটা বাবুল (দু’হাত কব্জিসহ কাটা) ও তার স্ত্রীকে গাঁজা বিক্রির অভিযোগ এনে তাদেরকে আটক করা হয়।
জানা যায়, ফাঁড়ির ইনচার্জ আব্দুল রহিম কামাল নামের এক যুবককে ১০০ গ্রাম গাঁজাসহ গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী বাবুলের বাসায় যায় এসআই আব্দুর রহিমসহ পুলিশের একটি টিম। সেখানে গিয়ে সারা বাড়ি তল্লাশি করে ১৫০ গ্রাম গাঁজা পাওয়া যায় বলে জানা যায়। এসময় বাবুল ও তার স্ত্রীকে অবৈধ গাঁজা রাখার অপরাধে আটক করে ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে ১০০ গ্রাম গাঁজাসহ কামালকে গ্রেফতার করা হলেও তাকে ছেড়ে দিয়ে প্রতিবন্ধী হাত কাটা বাবুলকে মাদকের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়।
এদিকে বাবুলের স্ত্রী বলেন, মাদক মামলা থাকায় প্রতি মাসে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত নানান ভয়ভীতি দেখিয়ে কাউন্দিয়া ফাঁড়ির পুলিশ নিয়ে যায়। এ নিয়ে ফাঁড়ি পুলিশের মধ্যে চলতে থাকে দ্বন্দ্ব। ধারাবাহিক পুলিশের এ চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে এলাকার কিছু মাদক ব্যবসায়ী। তাদের দাবি, এলাকায় অর্ধ শতাধিক মাদক কারবারির কাছ থেকে মাসোহারা নিয়ে থাকে ফাঁড়ি পুলিশ। মাসোহারা না দিলে বা নানা ঘাত প্রতিঘাতে অনেকে মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিয়েও রেহাই পাচ্ছে না এসব অসৎ পুলিশের হাত থেকে। মূল ব্যবসায়ীদের আড়াল করে মাদক সেবীদের গ্রেফতার করে ও তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করে পুলিশ তাদের মাদক বিরোধী তৎপরতা দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অথচ মূল ব্যবসায়ীরা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
পুলিশের এই ক্ষমতাবলে নিরীহদের মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে, জমি বিক্রেতার টাকা খোয়ানোর কৌশলে ও স্থানীয় মাদকসেবীদের মাদক বিক্রেতা সাজিয়ে মামলা দেওয়াসহ নানা অপকর্ম চালানোর অভিযোগও পাওয়া গেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে একাধিক জুয়ার আসরও। সেখান থেকেও প্রতিনিয়ত ভাগ যাচ্ছে পুলিশ ফাঁড়িতে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, এসব টাকা ফাঁড়ির ইনচার্জ নিজে ও তার বিশ্বস্ত লোক দিয়ে কালেকশন করে থাকেন। এসব বিশ্বস্ত লোকেরা আবার প্রকৃত মাদক কারবারিদের কাছ থেকে মাসোহারা ও সাপ্তাহিক আদায় করে নিজের ভাগেরটা রেখে অসাধু পুলিশ সদস্যদের তা দিয়ে থাকেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এভাবেই নির্বিঘ্নে পরিচালিত হচ্ছে মাদকের কারবার।
কাউন্দিয়া এলাকার চিহ্নিত ও বীরদর্পে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এমন কতিপয় মাদক কারবারিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – কাউন্দিয়া পশ্চিমপাড়ার লিটন @ কাল্লু, সাগর, কাঙ্গালিবাড়ির মিলন, পশ্চিমপাড়া পুকুরপাড়ের হিরা, মধ্যপাড়ার বাবুল@হাতকাটা বাবুল, জসিম@কসাই জসিম, জালাল, বাঘসাত্রার জলিল @ টাইগার জলিল, দেলু @ স্প্রিং দেলু, শামীম, বাবু, আলী @ পিচ্চি আলী, নুরুল @ নুন্নি, হযরত, আপেল, ৩০ ফিটের মামুন @ গোয়াল মামুন, বুড়িরটেকের মোবারক, শরীফ, আরিফ, সেকান্দার, ডিপজল প্লটের শিল্পী, রোজী, সাকিল, কুমারবাড়ি চিতাখোলার শেহের আলী, মানকেরটেকের কাইয়ুম, কুলসুম, কনা, তপু, আমজাদ, ফরিদা, সাহা, পারভেজ @ কালী পারভেজ, বিজয়, বেলতলার জাহাঙ্গীর, মনির, আসমা, রাজু@কাল্লু, নবী @ ইটা নবী, শাহাদাত, পাঁচকানীর আরমান, বাবুল @ টাইগার বাবুল, রনি @ মিস্ত্রি রনি, কামাল, জামাল, শামসুল, আলম, রুবেল, ফরহাদ, মিম, ঘাসিরদাহ’র খোরশেদ @ খুশিলাল, শরীফ, কাজিমুদ্দিন, সিংগাসাইরের আলী।
সম্প্রতি একটি সংস্থার গোয়েন্দা শাখার প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ শুধু মাদক কারবারিরাই নিচ্ছে না, মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করা দু-একজন অসাধু কর্মকর্তাও জড়িয়ে গেছেন মাদক পাচারে। এসব রোধে দ্রুত মাঠপর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মাদক নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় করতে হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর বিক্ষুব্ধ মানুষ সারাদেশে থানাসহ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। আত্মগোপন করেন পুলিশের অনেক কর্মকর্তা। ভেঙে পড়ে পুলিশি ব্যবস্থা। সড়কে পুলিশ দেখা যায়নি। এ পরিস্থিতির সুযোগ নেয় মাদক কারবারিরা। সীমান্ত পেরিয়ে আসা মাদক বিনা বাধায় নিয়ে যায় বিভিন্ন স্থানে। তবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) তৎপরতায় কিছু মাদক ধরা পড়েছে।
বিজিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, মাদক কারবারিরা চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগে জুলাই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর মাদকের একাধিক বড় চালান দেশে ঢুকিয়েছে বলে তথ্য রয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি মাসে যেখানে সারাদেশে অন্তত ৫-৭ হাজার করে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়, সেখানে গত মাসে (আগস্ট) মামলা হয়েছে মাত্র ১৫টি। অর্থাৎ মাদকবিরোধী কোনো অভিযান গত মাসে হয়নি।
জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের গোয়েন্দা উপ-পরিচালক বলেন, সরকার পতনের কোনো প্রভাব অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ওপর সরাসরি পড়েনি। অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মাঠে সক্রিয় থাকলেও অভিযানে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। শুরু থেকে অস্ত্র ছাড়া ঝুঁকি নিয়ে অভিযান চালাচ্ছেন অধিদপ্তরের সদস্যরা। অভিযান চালাতে গিয়ে নিরাপত্তাজনিত কোনো ঝামেলা হলে স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতা নেওয়া হতো। কিন্তু পুলিশিং কার্যক্রম সেরকম না থাকায় সেই সুযোগও নাই।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, শুধু এই পরিস্থিতির জন্য নয়, মাদক প্রতিরোধে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। যেভাবেই হোক মাদক আসা বন্ধ করতে হবে। না হলে অনেক তরুণ বিপথগামী হবে।