ঢাকা ০৩:৪০ অপরাহ্ন, সোমবার, ০৬ জানুয়ারী ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম ::
সেগুনবাগিচায় জামায়াতে ইসলামী শাহবাগ পূর্ব থানার কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত ২৪ দফার ইশতেহার নিয়ে সামনে আসছে তরুণদের দল আজই পদত্যাগ করতে পারেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো ১৭ বছরে ভোটার হলে কী প্রভাব পড়তে পারে আগামী নির্বাচনে? ৫০ বছর পর প্রকাশ্যে মেজর ডালিম, শেখ মুজিবকে নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য ইঁদুরের ঔষধ খেয়ে তিন সন্তানের জননীর আত্মহত্যা ২০ জানুয়ারি থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ মতিঝিল পূর্ব থানা জামায়াতের উদ্যোগে শীতবস্ত্র উপহার প্রদান কর্মসূচী সম্পন্ন বিএনপির কেউ দখলবাজি, টেন্ডারবাজি করলে আমাকে রিপোর্ট করুন,এডভোকেট আহমেদ আযম খান দেশের সম্মান ও গৌরব অটুট রাখতে কাজ করে যাচ্ছে সেনাবাহিনী: প্রধান উপদেষ্টা

রাজধানী বনশ্রীর সি ব্লক দিয়ে রামপুরার দিকে হেঁটে

সময়ের কন্ঠ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : ০৭:০৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ, শনিবার, ৪ জানুয়ারি ২০২৫
  • / ৫ ৫০০০.০ বার পাঠক

যাচ্ছিলেন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা সাল্লাহউদ্দিন বাবু (৪৭)। মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) দুপুরে মেরাদিয়া থেকে রামপুরা পর্যন্ত অটোরিকশা নিয়েও মাঝপথে এসে সেটি ছেড়ে দিয়েছেন। যানজটে থামকে আছে গোটা এলাকার অলিগলি। রিকশায় বসে সময় নষ্ট করার ফুরসত নেই। কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললেন, ‘আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে উঠলেও বনশ্রী এখন আর সেই চরিত্র ধরে রাখতে পারেনি। স্কুল, মাদরাসা, রেস্তোরাঁ, হাসপাতালসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভরে গেছে এলাকাটি। সবকিছু করা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। এতে বসবাসের পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে।’

বিশেষজ্ঞদের দাবি, কেবল বনশ্রীই না, অভিজাত এলাকা হিসেবে খ্যাত ধানমণ্ডি, গুলশান, বারিধারা ও বনানীও হারিয়েছে আবাসিক চরিত্র। মোহাম্মদপুর আর ওয়ারী এখন ঘিঞ্জি এলাকা। ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলোর খুব কম ভবনই আছে, যেটা শুধু আবাসিক।

তারা বলেন, আবাসিক এলাকা মানুষকে অনেক কিছু দেয়। শুধু ঘুমানোর জন্য আবাসিক এলাকা না, সেখানে মানুষের থাকার জন্য মৌলিক প্রয়োজনগুলো থাকতে হবে, হতে হবে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবান্ধব। আবার আবাসিক এলাকায় নতুন ভবন নির্মাণে বেশি শব্দ করা যাবে না, বেশি জোরে মাইক বাজানো যাবে না। পানি ও পয়োঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থাটা থাকতে হবে যথাযথভাবে। কিন্তু ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলোতে এসবের কিছুরই বালাই নেই অভিযোগ করে আসছেন নগর ও পরিবেশবিদরা।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) কোষাধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম সুজন সেই কথাই বলছিলেন এই প্রতিবেদককে। তিনি বলেন, ‘রাজধানীর অনেক আবাসিক এলাকা মিশ্র ও বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। যেমন, ধানমন্ডি। এটির মিশ্র মিশ্র ব্যবহার হচ্ছে। এটাকে এখন আর আবাসিক এলাকা বলা যাচ্ছে না।’

‘আশির দশকের শুরুর দিকে গড়ে উঠতে শুরু করে রাজধানীর উত্তরা। এখানের কোনো কোনো এলাকা, বিশেষ করে মূল রাস্তা থেকে দূরের এলাকাগুলো আবাসিক আছে। দিয়াবাড়িতে কিছু এলাকা আবাসিক হিসেবে গড়ে উঠছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার কোনো কোনো এলাকা মিশ্র, কোনো কোনোটা আবাসিক,’ যোগ করেন তিনি।

এই পরিবেশবিদ বলেন, ‘আগে বাণিজ্যিক এলাকা বলতে মতিঝিল ও দিলকুশাকে বুঝতাম। এখন বিভিন্ন আবাসিক এলাকার কাছেও বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে উঠছে। যেমন গুলশান—এখানে মূল সড়কের কাছাকাছি এলাকা বাণিজ্যিক। ফলে এটাকে পুরোপুরি আবাসিক এলাকা না বলে মিশ্র বলা যায়। আবার, বারিধারার ডিওএইচএস এখনও আবাসিক এলাকা আছে। মানুষের প্রয়োজনের কারণেই আবাসিক এলাকা মিশ্র ও বাণিজ্যিক হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

কেমন হওয়া উচিত আবাসিক এলাকা?
কেবল মানুষ ঘুমানোর জন্য কোনো এলাকাকে আবাসিক এলাকা নামে আখ্যা দেওয়া যায় না বলে জানান সুজন। তিনি বলেন, ‘এসব এলাকার কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। মানুষের মৌলিক প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের সুযোগ থাকতে হবে। যেমন: খাবার ও ব্যবহার্য পানি, রান্নার জন্য গ্যাস/জ্বালানি, স্যানিটেশন/পয়ঃনিষ্কাশন, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা (স্যুয়ারেজ), বিদ্যুৎ, প্রয়োজনীয় গাছপালা ও উন্মুক্ত স্থান—এগুলো মানসম্মতভাবে থাকতে হবে।’

‘মানুষের বিনোদন, শরীর চর্চা, খেলাধুলার সুযোগ থাকতে হবে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি (চাল-ডাল-তেল-লবণ, শিশুখাদ্য ও ওষুধ) নাগালে পাওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। আবাসিক এলাকা থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়), কর্মস্থল (ব্যবসা বা শিল্প প্রতিষ্ঠান) বা অন্যত্র যাতায়াতের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনায় বিদ্যমান বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করে সেখানকার স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই আমরা একটি পরিপূর্ণ ও মানসম্মত আবাসিক এলাকা পেতে পারি,’ যোগ করেন এই পরিবেশবিদ।

সুজন বলেন, ‘ঢাকায় মানসম্মত আবাসিক এলাকার ঘাটতি প্রকট। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতা ও জবাবদিহিতার অভাবকে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসাবে দেখি। এক্ষেত্রে রাজউক-এর ব্যর্থতাকে মুখ্য বলে মনে করি। একইসঙ্গে রাজউক, সিটি উত্তর ও দক্ষিণ করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ), পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয় জরুরি।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘হোম হচ্ছে সুইটহোম। সুইটহোম আবাসিক এলাকার একটা চরিত্র থাকে। দিনশেষে যখন এলাকায় ফিরবেন, তার একটি আবাসিক চরিত্র থাকতে হবে। সেটা আপনাকে অগ্নিকাণ্ড থেকে শুরু করে কোলাহল—সব ধরনের উৎপাত থেকে সুরক্ষা দেবে।’

মিশ্র ও বাণিজ্যিক হয়ে গেছে আবাসিক এলাকা
আবাসিক চরিত্র হারিয়ে ঢাকা শহর এখন মিশ্র ও বাণিজ্যিক রূপ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের এই অধ্যাপক। ইউএনবিকে তিনি বলেন, ‘এটা সত্যি যে ঢাকা শহর নিজের আবাসিক চরিত্র হারিয়েছে। বিশেষ করে পুরো ঢাকা এখন একটা মিশ্র ব্যবহারের এলাকা হয়ে গেছে। আমাদের সর্বপ্রথম পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা ছিল ওয়ারী। আর আধুনিককালে পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা ধানমণ্ডি, বনানী ও গুলশান। আর হালের উত্তরা। এগুলো আবাসিক হিসেবেই পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল।’

ক্ষোভ প্রকাশ করে এই নগর-পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘এখন ওয়ারী থেকে গুলশান, উত্তরা—মিশ্র ব্যবহারের নাম দিয়ে সবগুলোরই চরিত্র বদল করা হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (উন্নয়ন) উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা। আমাদের পরিকল্পনায় মিশ্র ব্যবহারের একটা ধারণা এসেছে। কিন্তু সেটা নিয়ন্ত্রিত মিশ্র ব্যবহার হতে হবে, যেগুলো আবাসিক প্রয়োজন মেটাবে। কিন্তু আমরা অনিয়ন্ত্রিত মিশ্র ব্যবহারকে অনুমোদন দিয়েছি।’

তারা আরও বলেন, উদহারণ হিসেবে বলা যায়, আবাসিক এলাকায় যদি মুদি দোকান লাগে, পরিকল্পনা অনুসারেই সেটা করা যায়। দৈনন্দিন প্রয়োজনগুলো মেটাতে যা দরকার, সেগুলো রেখেই পরিকল্পনামাফিক আবাসিক এলাকা করা যায়। কিন্তু মিশ্র এলাকার নামে আবাসিক এলাকাকে আমরা বাণিজ্যিক রূপ দিচ্ছি।

তিনি বলেন, ধানমণ্ডি, গুলশান ও বনানীর মতো আবাসিক এলাকার কিছু সড়ককে অনাবাসিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটা আমরা করেছি। আর এই বাণিজ্যিক করতে গিয়ে সেখানে বহুতল ভবনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এভাবে দেখা গেল, ধানমণ্ডিতে সারি সারি রেস্তোরাঁ হয়ে গেল। অন্যান্য ভবন করা হয়েছে। গুলশান আবাসিক এলাকাও বাণিজ্যিক হয়ে গেছে।

আদিল মুহাম্মদ খান অভিযোগ করে বলেন, পরিকল্পিত আবাসিক এলাকার বাইরেও যেখানে মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তরা থাকেন, সেখানে নির্বিচার মিশ্র ও বাণিজ্যিকের অনুমোদন করা হয়েছে।

এজন্য নগর পরিকল্পনা সম্পর্কে রাজউকের জ্ঞানের ঘাটতিকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘সারা দুনিয়ায় শহরের একটি ক্ষুদ্র এলাকায় মিশ্র ব্যবহার থাকে। আর অধিকাংশ এলাকা থাকে আবাসিক। আবাসিক মানে আবাসিকই। কিন্তু ঢাকা শহর তার বিপরীত গতিতে এগোচ্ছে।’

দুর্ঘটনার জন্য দায়ী অতিরিক্ত মিশ্র ব্যবহার
আবাসিকের মধ্যে মিশ্র ব্যবহারের দুধরনের নীতি থাকে জানিয়ে এই নগর-পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘একটি হচ্ছে উল্লম্ব মিশ্র ব্যবহার, আরেকটি আনুভূমিক। আনুভূমিক মিশ্র ব্যবহার বলতে একটা আবাসিক এলাকায় হয়ত একটা ছোট্ট অঞ্চল থাকবে, যেখানে বাজার থেকে শুরু করে যাবতীয় নিত্যপণ্য কেনা যাবে। কিন্তু আমরা সেটা না করে উল্লম্ব মিশ্র ব্যবহারে গেলাম। অর্থাৎ কয়েক তলায় আবাসিক, কয়েক তলায় রেস্তোরাঁ, আবার কয়েক তলায় ব্যাংক, আবার কোনো তলায় খাবারের দোকান করা হয়েছে। এ ধরনের উল্লম্ব মিশ্র ব্যবহার ঢাকা শহরে ভয়ঙ্করভাবে দেখা দিয়েছে।’

এ কারণেই ঢাকা শহরে প্রচুর অগ্নিকাণ্ডও ঘটে বলে দাবি করেন এই নগরপরিকল্পনাবিদ। তিনি বলেন, ‘এতে আবাসিকের মানুষও হতাহত হন। পুরো ঢাকা শহরে সত্যিকারের আবাসিক এলাকা এখন খুবই কম। আসলে পরিকল্পনা করা হয়েছিল শৃঙ্খলা আনার জন্য। অনাবাসিক চরিত্র থেকে দূরে থাকার জন্য। কিন্তু সত্যিকারের আবাসিক এলাকা কম থাকায় আমাদের যাপিত জীবন সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোলাহল, উৎপাত, ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। যে কারণে সাম্প্রতিক বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) মিশ্র ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। নিখাদ আবাসিক এলাকা রাখতেই হবে।’

কিন্তু এ বিষয়ে রাজউকের কোনো উৎসাহ নেই বলে অভিযোগ করেন আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ‘আবার ভবন মালিকরাও চান যে মিশ্র ব্যবহার হলে তাদের ভাড়া বাড়ে। কিন্তু নগর পরিকল্পনা করা হয় সব মানুষের কল্যাণ ও শহরকে বাসযোগ্য রাখতে। কিন্তু ঢাকা শহরে খারাপভাবে মিশ্র ব্যবহারের ধারণাকে ব্যবহার করেছে, এই প্রবণতা থামানোও যাচ্ছে না।’

‘উত্তরা, বনানী ও গুলশানের বড় বড় রাস্তার পাশে মিশ্র ব্যবহারের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু এর পরিণতি কী হবে? তা তারা কখনোই ভাবেনি। এর পিছনে স্থানীয় ভবনমালিকদের একটি চক্র কাজ করছে। কারণ আবাসিক এলাকা বাণিজ্যিকে রূপান্তর হলে তারা বহুতল ভবন করে নিচ্ছেন, তাদের ভাড়াও বাড়ছে।’

আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘ভবনমালিকদের আগ্রহ ও কিছুটা আবাসন ব্যবসায়ীদের চাপে যদি ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা নষ্ট করলে তো পরিকল্পনা হবে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাজউক এমন একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে যে তারা নগর-পরিকল্পনা বোঝে না। কোথা থেকে টাকা-পয়সা আয় করা যায়, তারা কেবল সেটিই বোঝে। কারণ রাজউক কনভার্সন (রূপান্তর) ফি পায়। এরমধ্যে একটা হচ্ছে বৈধ আরেকটি অবৈধ কনভার্সন ফি, যেটা রাজউকের কর্মকর্তারা নিয়ে থাকেন। এ কারণে শহরের বাসযোগ্যতা নিয়ে রাজউকের কোনো চিন্তা নেই।’

আবাসিক এলাকায় কতটা বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চলতে পারবে?
একটি আবাসিক এলাকায় ৩০ কিংবা ৩৫ শতাংশের বেশি বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চলতে পারে না বলে জানিয়েছেন নগর-পরিকল্পনাবিদ আকতার মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘আবাসিক এলাকায় সেলুন, ফটোকপি দোকান, মুদির দোকান, চিকেন মার্কেট, ডাক্তারখানা থাকতে পারে। তার মানে এই নয় যে বিশাল হাসপাতাল থাকতে পারবে। ইউএন হ্যাবিটেট বলছে যে আবাসিক এলাকার তৎপরতাকে সহায়তা করার জন্য কিছু বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চলতে পারে। কিন্তু সেটার পরিমাণও নির্ধারণ করে দেওয়া আছে, অর্থাৎ ৩০ কিংবা পঁয়ত্রিশ শতাংশের বেশি হতে পারবে না।’

‘কিন্তু ধানমণ্ডিতে অতিরিক্ত মাত্রায় বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে। ধানমণ্ডির মূলসড়কগুলোতে ব্যাপক যানজট হচ্ছে। কারণ, এখানে খাবারের দোকান, রেস্তোরাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল এতো বেশি হয়েছে যে এটা একটি জনাকীর্ণ জায়গা হয়ে গেছে।’

রাজউকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘এটি একটি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান। এটির উচিত ছিল, স্কুল ও কেনাকাটার দোকান সেই পরিমাণ সীমাবদ্ধ রাখা, সেই পরিমাণ সীমাবদ্ধ রাখলে একটি আবাসিক এলাকার আবাসিক চরিত্র হারিয়ে না যায়। কিন্তু তারা ঢালাওভাবে সব ছেড়ে দিয়েছে।’

‘মতিঝিল ও ফার্মগেটের মতো আরও বাণিজ্যিক এলাকা থাকলে আবাসিক এলাকার ওপর চাপ পড়তো না। কিন্তু এখন মানুষ আবাসিক ভবন বাণিজ্যিক রূপ দিচ্ছে। হাসপাতাল ও রেস্তোরাঁ তৈরি করছে, যেটার জন্য ওই এলাকা প্রস্তুত না, যে কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। যেই ভূমি যেটার জন্য প্রস্তুত না, সেটিকেই সেই রূপ দিলেই অসুবিধা তৈরি হবে,’ যোগ করেন আকতার মাহমুদ।

রাজউক অসহায়
আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের প্রধান নগর-পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘আমিও চাই না, আবাসিক এলাকায় কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক। কিন্তু চাহিদার কারণেই এসব হয়েছে। কোনো একটি আবাসিক এলাকার পরিকল্পনার করার আগে সেখানকার একটি অনুমিত জনসংখ্যা থাকে। ধরেন, পঞ্চাশ হাজার লোকের জন্য একটি আবাসিক এলাকার নকশা করা হয়েছে, সেই অনুসারে সেখানে স্কুল, হাসপাতাল, পার্ক ও মাঠ রাখা হয়।’

‘যখন ধানমণ্ডি এলাকার ডিজাইন করা হয়, তখন সেখানে একবিঘা আকারের প্লট ছিল। বলা ছিল, সেখানে দোতলার বেশি উঁচু বাড়ি করা যাবে না। এক-তৃতীয়াংশ জায়গা খালি রাখতে হবে, দুই তৃতীয়াংশ জায়গায় বাড়ি করা যাবে। পরে সরকার সিদ্ধান্ত নিল, দোতলাকে ছয়তলা পর্যন্ত করা হবে। এটা সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল, রাজউকের না। এখন পঞ্চাশ হাজার জনসংখ্যার কথা মাথায় রেখে দোতলা ভবনের কথা বলা হয়েছিল। এরপর ছয়তলা ভবন করায় সেখানে জনসংখ্যাও বেড়ে গেল। এভাবে ছয়তলা থেকে যখন চৌদ্দতলা ভবনের অনুমোদন দেওয়া হলো, তখন জনসংখ্যাও কয়েকগুণ বেড়ে গেল।’

তিনি বলেন, ‘এতে সেখানে স্কুল ও হাসপাতালের চাহিদাও বেড়ে গেল। এ কারণে আবাসিক ভবন ভাড়া নিয়ে এসব কিছু করা হচ্ছে। অর্থাৎ চাহিদার কারণেই আবাসিক ভবনগুলো বাণিজ্যিক রূপান্তর ঘটছে। বিপরীতে খেলার মাঠ হচ্ছে না, কারণ সেখানে কোনো ব্যবসা নেই। জায়গাও খালি নেই। মূল পরিকল্পনায়ই ভুল ছিল। এখন রাজউক প্রতিদিন পুলিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও এসব বন্ধ করা যাবে না।’

‘আগে পুরো ধানমণ্ডি এলাকায় একটি গ্রামের মানুষ বাস করতেন, এখন সেখানে দশটি প্লটে একটি গ্রামের মানুষ বাস করেন। বাংলাদেশের ২০ কিংবা ৫০টি গ্রামের মানুষকে ধানমণ্ডি এলাকায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই পরিস্থিতি গুলশানেও।’

তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত ছিল, মূল যে লেআউটে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেটি কঠোরভাবে মেনে চলা। কিন্তু সরকারি নীতির কারণে সেই ডিজাইন ব্যর্থ হয়েছে। রাজউক তো এখানে অসহায়।’

ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার পরিকল্পনা করা হয় ১৯৬০ সালে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তখন আমরা পূর্ব পাকিস্তান ছিলাম। ধানমণ্ডি এলাকায় ডেকে ডেকে প্লট দিতে পারতো না, বাঙালি অফিসার কয়জন ছিলেন! বেশিরভাগ পেতেন সিএসএস অফিসাররা, পশ্চিম পাকিস্তানের অফিসাররা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সব লোক হুমড়ি খেয়ে ঢাকায় আসা শুরু করলেন। ১৯৬০ সালে তো কেউ ভাবতেই পারেননি যে এতবড় জিনিস বাংলাদেশে ঘটে যাবে। তাহলে পরিকল্পনা করা হবে কোথা থেকে?

‘যখন চাহিদা তৈরি হবে, তখন সাপ্লাইও তৈরি হবেই। এটাই বাস্তবতা। রাজউকের তখন তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার নেই। এ অবস্থায় যখন নগর-পরিকল্পনাবিদদের মতামতকে উপেক্ষা করা হবে, তখন এমন অবস্থা তৈরি হবেই। যে পরিকল্পনা যে আলোকে তৈরি হবে, সেই আলোকে যদি কঠোর অবস্থানে থাকা যায়, তখন সেটা বাস্তবায়ন করা যাবে। রাজউকের হয়ত দায় আছে, কিন্তু আবাসিক থেকে মিশ্র কিংবা বাণিজ্যিক রূপান্তর বন্ধ করে কী করবেন? তাকে বিকল্প সুযোগ দিতে হবে। যদি ধানমণ্ডি এলাকার সব স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন যদি বলে স্কুলের জায়গা দিতে হবে, কিন্তু সেই জায়গা তো অবশিষ্ট নেই।’

তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশে স্কুল জোনের একটি সিস্টেম আছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে তার জনসংখ্যার অনুপাতে স্কুল ও হাসপাতালের সংখ্যা নির্ধারণ করে প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করে হলেও সুষমভাবে ভূমি বিতরণ করা গেলেই এই রূপান্তর বন্ধ করা সম্ভব। এছাড়া এভাবে অপরিকল্পিত উন্নয়ন ঘটতেই থাকবে।’

ঢাকা শহরের আবাসিক চরিত্র হারানো ঠেকাতে সিটি কর্পোরেশন কোনো ভূমিকা নিয়েছে কিনা; জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর-পরিকল্পনাবিদ (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এস. এম. শফিকুর রহমান বলেন, ‘এটার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হচ্ছে রাজউক। আমরা সবসময়ই এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করি। মোহাম্মদপুর এলাকা পুরোপুরি আবাসিক ছিল একসময়, সেটা এখন বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। ন্যাশনাল হাউজিংয়ের যে এলাকাগুলো, গুলশান, বনানী। অপ্রীতিকর কথা হচ্ছে, প্রভাবশালীরা রাজনৈতিক চাপ দিয়ে এগুলো করান।’

তবে রাজউক যতক্ষণ না সজাগ হবে কিংবা পদক্ষেপ নেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটির কোনো সমাধান হবে না বলে জানান এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, রাজউক যদি বলে যে এই অঞ্চলটি পুরো আবাসিক হবে, আমরা তখন পদক্ষেপ নেব। আমরা তো রাজউকের সঙ্গে সমান্তরালভাবে কাজ করি।
সোর্স/ ইউএনবি

আরো খবর.......

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

রাজধানী বনশ্রীর সি ব্লক দিয়ে রামপুরার দিকে হেঁটে

আপডেট টাইম : ০৭:০৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ, শনিবার, ৪ জানুয়ারি ২০২৫

যাচ্ছিলেন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা সাল্লাহউদ্দিন বাবু (৪৭)। মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) দুপুরে মেরাদিয়া থেকে রামপুরা পর্যন্ত অটোরিকশা নিয়েও মাঝপথে এসে সেটি ছেড়ে দিয়েছেন। যানজটে থামকে আছে গোটা এলাকার অলিগলি। রিকশায় বসে সময় নষ্ট করার ফুরসত নেই। কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললেন, ‘আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে উঠলেও বনশ্রী এখন আর সেই চরিত্র ধরে রাখতে পারেনি। স্কুল, মাদরাসা, রেস্তোরাঁ, হাসপাতালসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভরে গেছে এলাকাটি। সবকিছু করা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। এতে বসবাসের পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে।’

বিশেষজ্ঞদের দাবি, কেবল বনশ্রীই না, অভিজাত এলাকা হিসেবে খ্যাত ধানমণ্ডি, গুলশান, বারিধারা ও বনানীও হারিয়েছে আবাসিক চরিত্র। মোহাম্মদপুর আর ওয়ারী এখন ঘিঞ্জি এলাকা। ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলোর খুব কম ভবনই আছে, যেটা শুধু আবাসিক।

তারা বলেন, আবাসিক এলাকা মানুষকে অনেক কিছু দেয়। শুধু ঘুমানোর জন্য আবাসিক এলাকা না, সেখানে মানুষের থাকার জন্য মৌলিক প্রয়োজনগুলো থাকতে হবে, হতে হবে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবান্ধব। আবার আবাসিক এলাকায় নতুন ভবন নির্মাণে বেশি শব্দ করা যাবে না, বেশি জোরে মাইক বাজানো যাবে না। পানি ও পয়োঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থাটা থাকতে হবে যথাযথভাবে। কিন্তু ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলোতে এসবের কিছুরই বালাই নেই অভিযোগ করে আসছেন নগর ও পরিবেশবিদরা।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) কোষাধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম সুজন সেই কথাই বলছিলেন এই প্রতিবেদককে। তিনি বলেন, ‘রাজধানীর অনেক আবাসিক এলাকা মিশ্র ও বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। যেমন, ধানমন্ডি। এটির মিশ্র মিশ্র ব্যবহার হচ্ছে। এটাকে এখন আর আবাসিক এলাকা বলা যাচ্ছে না।’

‘আশির দশকের শুরুর দিকে গড়ে উঠতে শুরু করে রাজধানীর উত্তরা। এখানের কোনো কোনো এলাকা, বিশেষ করে মূল রাস্তা থেকে দূরের এলাকাগুলো আবাসিক আছে। দিয়াবাড়িতে কিছু এলাকা আবাসিক হিসেবে গড়ে উঠছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার কোনো কোনো এলাকা মিশ্র, কোনো কোনোটা আবাসিক,’ যোগ করেন তিনি।

এই পরিবেশবিদ বলেন, ‘আগে বাণিজ্যিক এলাকা বলতে মতিঝিল ও দিলকুশাকে বুঝতাম। এখন বিভিন্ন আবাসিক এলাকার কাছেও বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে উঠছে। যেমন গুলশান—এখানে মূল সড়কের কাছাকাছি এলাকা বাণিজ্যিক। ফলে এটাকে পুরোপুরি আবাসিক এলাকা না বলে মিশ্র বলা যায়। আবার, বারিধারার ডিওএইচএস এখনও আবাসিক এলাকা আছে। মানুষের প্রয়োজনের কারণেই আবাসিক এলাকা মিশ্র ও বাণিজ্যিক হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

কেমন হওয়া উচিত আবাসিক এলাকা?
কেবল মানুষ ঘুমানোর জন্য কোনো এলাকাকে আবাসিক এলাকা নামে আখ্যা দেওয়া যায় না বলে জানান সুজন। তিনি বলেন, ‘এসব এলাকার কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। মানুষের মৌলিক প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের সুযোগ থাকতে হবে। যেমন: খাবার ও ব্যবহার্য পানি, রান্নার জন্য গ্যাস/জ্বালানি, স্যানিটেশন/পয়ঃনিষ্কাশন, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা (স্যুয়ারেজ), বিদ্যুৎ, প্রয়োজনীয় গাছপালা ও উন্মুক্ত স্থান—এগুলো মানসম্মতভাবে থাকতে হবে।’

‘মানুষের বিনোদন, শরীর চর্চা, খেলাধুলার সুযোগ থাকতে হবে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি (চাল-ডাল-তেল-লবণ, শিশুখাদ্য ও ওষুধ) নাগালে পাওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। আবাসিক এলাকা থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়), কর্মস্থল (ব্যবসা বা শিল্প প্রতিষ্ঠান) বা অন্যত্র যাতায়াতের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনায় বিদ্যমান বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করে সেখানকার স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই আমরা একটি পরিপূর্ণ ও মানসম্মত আবাসিক এলাকা পেতে পারি,’ যোগ করেন এই পরিবেশবিদ।

সুজন বলেন, ‘ঢাকায় মানসম্মত আবাসিক এলাকার ঘাটতি প্রকট। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতা ও জবাবদিহিতার অভাবকে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসাবে দেখি। এক্ষেত্রে রাজউক-এর ব্যর্থতাকে মুখ্য বলে মনে করি। একইসঙ্গে রাজউক, সিটি উত্তর ও দক্ষিণ করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ), পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয় জরুরি।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘হোম হচ্ছে সুইটহোম। সুইটহোম আবাসিক এলাকার একটা চরিত্র থাকে। দিনশেষে যখন এলাকায় ফিরবেন, তার একটি আবাসিক চরিত্র থাকতে হবে। সেটা আপনাকে অগ্নিকাণ্ড থেকে শুরু করে কোলাহল—সব ধরনের উৎপাত থেকে সুরক্ষা দেবে।’

মিশ্র ও বাণিজ্যিক হয়ে গেছে আবাসিক এলাকা
আবাসিক চরিত্র হারিয়ে ঢাকা শহর এখন মিশ্র ও বাণিজ্যিক রূপ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের এই অধ্যাপক। ইউএনবিকে তিনি বলেন, ‘এটা সত্যি যে ঢাকা শহর নিজের আবাসিক চরিত্র হারিয়েছে। বিশেষ করে পুরো ঢাকা এখন একটা মিশ্র ব্যবহারের এলাকা হয়ে গেছে। আমাদের সর্বপ্রথম পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা ছিল ওয়ারী। আর আধুনিককালে পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা ধানমণ্ডি, বনানী ও গুলশান। আর হালের উত্তরা। এগুলো আবাসিক হিসেবেই পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল।’

ক্ষোভ প্রকাশ করে এই নগর-পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘এখন ওয়ারী থেকে গুলশান, উত্তরা—মিশ্র ব্যবহারের নাম দিয়ে সবগুলোরই চরিত্র বদল করা হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (উন্নয়ন) উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা। আমাদের পরিকল্পনায় মিশ্র ব্যবহারের একটা ধারণা এসেছে। কিন্তু সেটা নিয়ন্ত্রিত মিশ্র ব্যবহার হতে হবে, যেগুলো আবাসিক প্রয়োজন মেটাবে। কিন্তু আমরা অনিয়ন্ত্রিত মিশ্র ব্যবহারকে অনুমোদন দিয়েছি।’

তারা আরও বলেন, উদহারণ হিসেবে বলা যায়, আবাসিক এলাকায় যদি মুদি দোকান লাগে, পরিকল্পনা অনুসারেই সেটা করা যায়। দৈনন্দিন প্রয়োজনগুলো মেটাতে যা দরকার, সেগুলো রেখেই পরিকল্পনামাফিক আবাসিক এলাকা করা যায়। কিন্তু মিশ্র এলাকার নামে আবাসিক এলাকাকে আমরা বাণিজ্যিক রূপ দিচ্ছি।

তিনি বলেন, ধানমণ্ডি, গুলশান ও বনানীর মতো আবাসিক এলাকার কিছু সড়ককে অনাবাসিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটা আমরা করেছি। আর এই বাণিজ্যিক করতে গিয়ে সেখানে বহুতল ভবনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এভাবে দেখা গেল, ধানমণ্ডিতে সারি সারি রেস্তোরাঁ হয়ে গেল। অন্যান্য ভবন করা হয়েছে। গুলশান আবাসিক এলাকাও বাণিজ্যিক হয়ে গেছে।

আদিল মুহাম্মদ খান অভিযোগ করে বলেন, পরিকল্পিত আবাসিক এলাকার বাইরেও যেখানে মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তরা থাকেন, সেখানে নির্বিচার মিশ্র ও বাণিজ্যিকের অনুমোদন করা হয়েছে।

এজন্য নগর পরিকল্পনা সম্পর্কে রাজউকের জ্ঞানের ঘাটতিকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘সারা দুনিয়ায় শহরের একটি ক্ষুদ্র এলাকায় মিশ্র ব্যবহার থাকে। আর অধিকাংশ এলাকা থাকে আবাসিক। আবাসিক মানে আবাসিকই। কিন্তু ঢাকা শহর তার বিপরীত গতিতে এগোচ্ছে।’

দুর্ঘটনার জন্য দায়ী অতিরিক্ত মিশ্র ব্যবহার
আবাসিকের মধ্যে মিশ্র ব্যবহারের দুধরনের নীতি থাকে জানিয়ে এই নগর-পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘একটি হচ্ছে উল্লম্ব মিশ্র ব্যবহার, আরেকটি আনুভূমিক। আনুভূমিক মিশ্র ব্যবহার বলতে একটা আবাসিক এলাকায় হয়ত একটা ছোট্ট অঞ্চল থাকবে, যেখানে বাজার থেকে শুরু করে যাবতীয় নিত্যপণ্য কেনা যাবে। কিন্তু আমরা সেটা না করে উল্লম্ব মিশ্র ব্যবহারে গেলাম। অর্থাৎ কয়েক তলায় আবাসিক, কয়েক তলায় রেস্তোরাঁ, আবার কয়েক তলায় ব্যাংক, আবার কোনো তলায় খাবারের দোকান করা হয়েছে। এ ধরনের উল্লম্ব মিশ্র ব্যবহার ঢাকা শহরে ভয়ঙ্করভাবে দেখা দিয়েছে।’

এ কারণেই ঢাকা শহরে প্রচুর অগ্নিকাণ্ডও ঘটে বলে দাবি করেন এই নগরপরিকল্পনাবিদ। তিনি বলেন, ‘এতে আবাসিকের মানুষও হতাহত হন। পুরো ঢাকা শহরে সত্যিকারের আবাসিক এলাকা এখন খুবই কম। আসলে পরিকল্পনা করা হয়েছিল শৃঙ্খলা আনার জন্য। অনাবাসিক চরিত্র থেকে দূরে থাকার জন্য। কিন্তু সত্যিকারের আবাসিক এলাকা কম থাকায় আমাদের যাপিত জীবন সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোলাহল, উৎপাত, ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। যে কারণে সাম্প্রতিক বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) মিশ্র ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। নিখাদ আবাসিক এলাকা রাখতেই হবে।’

কিন্তু এ বিষয়ে রাজউকের কোনো উৎসাহ নেই বলে অভিযোগ করেন আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ‘আবার ভবন মালিকরাও চান যে মিশ্র ব্যবহার হলে তাদের ভাড়া বাড়ে। কিন্তু নগর পরিকল্পনা করা হয় সব মানুষের কল্যাণ ও শহরকে বাসযোগ্য রাখতে। কিন্তু ঢাকা শহরে খারাপভাবে মিশ্র ব্যবহারের ধারণাকে ব্যবহার করেছে, এই প্রবণতা থামানোও যাচ্ছে না।’

‘উত্তরা, বনানী ও গুলশানের বড় বড় রাস্তার পাশে মিশ্র ব্যবহারের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু এর পরিণতি কী হবে? তা তারা কখনোই ভাবেনি। এর পিছনে স্থানীয় ভবনমালিকদের একটি চক্র কাজ করছে। কারণ আবাসিক এলাকা বাণিজ্যিকে রূপান্তর হলে তারা বহুতল ভবন করে নিচ্ছেন, তাদের ভাড়াও বাড়ছে।’

আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘ভবনমালিকদের আগ্রহ ও কিছুটা আবাসন ব্যবসায়ীদের চাপে যদি ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা নষ্ট করলে তো পরিকল্পনা হবে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাজউক এমন একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে যে তারা নগর-পরিকল্পনা বোঝে না। কোথা থেকে টাকা-পয়সা আয় করা যায়, তারা কেবল সেটিই বোঝে। কারণ রাজউক কনভার্সন (রূপান্তর) ফি পায়। এরমধ্যে একটা হচ্ছে বৈধ আরেকটি অবৈধ কনভার্সন ফি, যেটা রাজউকের কর্মকর্তারা নিয়ে থাকেন। এ কারণে শহরের বাসযোগ্যতা নিয়ে রাজউকের কোনো চিন্তা নেই।’

আবাসিক এলাকায় কতটা বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চলতে পারবে?
একটি আবাসিক এলাকায় ৩০ কিংবা ৩৫ শতাংশের বেশি বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চলতে পারে না বলে জানিয়েছেন নগর-পরিকল্পনাবিদ আকতার মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘আবাসিক এলাকায় সেলুন, ফটোকপি দোকান, মুদির দোকান, চিকেন মার্কেট, ডাক্তারখানা থাকতে পারে। তার মানে এই নয় যে বিশাল হাসপাতাল থাকতে পারবে। ইউএন হ্যাবিটেট বলছে যে আবাসিক এলাকার তৎপরতাকে সহায়তা করার জন্য কিছু বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চলতে পারে। কিন্তু সেটার পরিমাণও নির্ধারণ করে দেওয়া আছে, অর্থাৎ ৩০ কিংবা পঁয়ত্রিশ শতাংশের বেশি হতে পারবে না।’

‘কিন্তু ধানমণ্ডিতে অতিরিক্ত মাত্রায় বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে। ধানমণ্ডির মূলসড়কগুলোতে ব্যাপক যানজট হচ্ছে। কারণ, এখানে খাবারের দোকান, রেস্তোরাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল এতো বেশি হয়েছে যে এটা একটি জনাকীর্ণ জায়গা হয়ে গেছে।’

রাজউকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘এটি একটি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান। এটির উচিত ছিল, স্কুল ও কেনাকাটার দোকান সেই পরিমাণ সীমাবদ্ধ রাখা, সেই পরিমাণ সীমাবদ্ধ রাখলে একটি আবাসিক এলাকার আবাসিক চরিত্র হারিয়ে না যায়। কিন্তু তারা ঢালাওভাবে সব ছেড়ে দিয়েছে।’

‘মতিঝিল ও ফার্মগেটের মতো আরও বাণিজ্যিক এলাকা থাকলে আবাসিক এলাকার ওপর চাপ পড়তো না। কিন্তু এখন মানুষ আবাসিক ভবন বাণিজ্যিক রূপ দিচ্ছে। হাসপাতাল ও রেস্তোরাঁ তৈরি করছে, যেটার জন্য ওই এলাকা প্রস্তুত না, যে কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। যেই ভূমি যেটার জন্য প্রস্তুত না, সেটিকেই সেই রূপ দিলেই অসুবিধা তৈরি হবে,’ যোগ করেন আকতার মাহমুদ।

রাজউক অসহায়
আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের প্রধান নগর-পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘আমিও চাই না, আবাসিক এলাকায় কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক। কিন্তু চাহিদার কারণেই এসব হয়েছে। কোনো একটি আবাসিক এলাকার পরিকল্পনার করার আগে সেখানকার একটি অনুমিত জনসংখ্যা থাকে। ধরেন, পঞ্চাশ হাজার লোকের জন্য একটি আবাসিক এলাকার নকশা করা হয়েছে, সেই অনুসারে সেখানে স্কুল, হাসপাতাল, পার্ক ও মাঠ রাখা হয়।’

‘যখন ধানমণ্ডি এলাকার ডিজাইন করা হয়, তখন সেখানে একবিঘা আকারের প্লট ছিল। বলা ছিল, সেখানে দোতলার বেশি উঁচু বাড়ি করা যাবে না। এক-তৃতীয়াংশ জায়গা খালি রাখতে হবে, দুই তৃতীয়াংশ জায়গায় বাড়ি করা যাবে। পরে সরকার সিদ্ধান্ত নিল, দোতলাকে ছয়তলা পর্যন্ত করা হবে। এটা সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল, রাজউকের না। এখন পঞ্চাশ হাজার জনসংখ্যার কথা মাথায় রেখে দোতলা ভবনের কথা বলা হয়েছিল। এরপর ছয়তলা ভবন করায় সেখানে জনসংখ্যাও বেড়ে গেল। এভাবে ছয়তলা থেকে যখন চৌদ্দতলা ভবনের অনুমোদন দেওয়া হলো, তখন জনসংখ্যাও কয়েকগুণ বেড়ে গেল।’

তিনি বলেন, ‘এতে সেখানে স্কুল ও হাসপাতালের চাহিদাও বেড়ে গেল। এ কারণে আবাসিক ভবন ভাড়া নিয়ে এসব কিছু করা হচ্ছে। অর্থাৎ চাহিদার কারণেই আবাসিক ভবনগুলো বাণিজ্যিক রূপান্তর ঘটছে। বিপরীতে খেলার মাঠ হচ্ছে না, কারণ সেখানে কোনো ব্যবসা নেই। জায়গাও খালি নেই। মূল পরিকল্পনায়ই ভুল ছিল। এখন রাজউক প্রতিদিন পুলিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও এসব বন্ধ করা যাবে না।’

‘আগে পুরো ধানমণ্ডি এলাকায় একটি গ্রামের মানুষ বাস করতেন, এখন সেখানে দশটি প্লটে একটি গ্রামের মানুষ বাস করেন। বাংলাদেশের ২০ কিংবা ৫০টি গ্রামের মানুষকে ধানমণ্ডি এলাকায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই পরিস্থিতি গুলশানেও।’

তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত ছিল, মূল যে লেআউটে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেটি কঠোরভাবে মেনে চলা। কিন্তু সরকারি নীতির কারণে সেই ডিজাইন ব্যর্থ হয়েছে। রাজউক তো এখানে অসহায়।’

ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার পরিকল্পনা করা হয় ১৯৬০ সালে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তখন আমরা পূর্ব পাকিস্তান ছিলাম। ধানমণ্ডি এলাকায় ডেকে ডেকে প্লট দিতে পারতো না, বাঙালি অফিসার কয়জন ছিলেন! বেশিরভাগ পেতেন সিএসএস অফিসাররা, পশ্চিম পাকিস্তানের অফিসাররা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সব লোক হুমড়ি খেয়ে ঢাকায় আসা শুরু করলেন। ১৯৬০ সালে তো কেউ ভাবতেই পারেননি যে এতবড় জিনিস বাংলাদেশে ঘটে যাবে। তাহলে পরিকল্পনা করা হবে কোথা থেকে?

‘যখন চাহিদা তৈরি হবে, তখন সাপ্লাইও তৈরি হবেই। এটাই বাস্তবতা। রাজউকের তখন তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার নেই। এ অবস্থায় যখন নগর-পরিকল্পনাবিদদের মতামতকে উপেক্ষা করা হবে, তখন এমন অবস্থা তৈরি হবেই। যে পরিকল্পনা যে আলোকে তৈরি হবে, সেই আলোকে যদি কঠোর অবস্থানে থাকা যায়, তখন সেটা বাস্তবায়ন করা যাবে। রাজউকের হয়ত দায় আছে, কিন্তু আবাসিক থেকে মিশ্র কিংবা বাণিজ্যিক রূপান্তর বন্ধ করে কী করবেন? তাকে বিকল্প সুযোগ দিতে হবে। যদি ধানমণ্ডি এলাকার সব স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন যদি বলে স্কুলের জায়গা দিতে হবে, কিন্তু সেই জায়গা তো অবশিষ্ট নেই।’

তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশে স্কুল জোনের একটি সিস্টেম আছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে তার জনসংখ্যার অনুপাতে স্কুল ও হাসপাতালের সংখ্যা নির্ধারণ করে প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করে হলেও সুষমভাবে ভূমি বিতরণ করা গেলেই এই রূপান্তর বন্ধ করা সম্ভব। এছাড়া এভাবে অপরিকল্পিত উন্নয়ন ঘটতেই থাকবে।’

ঢাকা শহরের আবাসিক চরিত্র হারানো ঠেকাতে সিটি কর্পোরেশন কোনো ভূমিকা নিয়েছে কিনা; জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর-পরিকল্পনাবিদ (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এস. এম. শফিকুর রহমান বলেন, ‘এটার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হচ্ছে রাজউক। আমরা সবসময়ই এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করি। মোহাম্মদপুর এলাকা পুরোপুরি আবাসিক ছিল একসময়, সেটা এখন বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। ন্যাশনাল হাউজিংয়ের যে এলাকাগুলো, গুলশান, বনানী। অপ্রীতিকর কথা হচ্ছে, প্রভাবশালীরা রাজনৈতিক চাপ দিয়ে এগুলো করান।’

তবে রাজউক যতক্ষণ না সজাগ হবে কিংবা পদক্ষেপ নেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটির কোনো সমাধান হবে না বলে জানান এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, রাজউক যদি বলে যে এই অঞ্চলটি পুরো আবাসিক হবে, আমরা তখন পদক্ষেপ নেব। আমরা তো রাজউকের সঙ্গে সমান্তরালভাবে কাজ করি।
সোর্স/ ইউএনবি