আলীয়াবাদের সুগন্ধি ঐতিহ্য গাউলা ফিরনির উৎসবে মাতোয়ারা গ্রাম
- আপডেট টাইম : ০৭:৪২:৪৮ পূর্বাহ্ণ, শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪
- / ১০ ৫০০০.০ বার পাঠক
স্থান: আলীয়াবাদ, চার গ্রাম স্কুল মাঠ প্রাঙ্গন, নবীনগর ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
সূর্যোদয়ের সোনালি আভা তখনও পূর্ব দিগন্তে পুরোপুরি ফোটেনি। এরই মধ্যে আলীয়াবাদ গ্রামের বাতাসে ভেসে আসছে এক সুমধুর গন্ধ – গাউলা ফিরনির সুগন্ধি। শত শত বছর ধরে চলে আসা এই ঐতিহ্যবাহী আয়োজনকে ঘিরে আজ উৎসবমুখর পুরো গ্রাম। কিন্তু এই গাউলা ফিরনির নেপথ্যে রয়েছে অনেক অজানা গল্প, অনেক ইতিহাস, অনেক আবেগ।
উদ্দেশ্য ও পটভূমি:
গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা জনাব ইউনুস পুলিশের সাথে কথা বলে জানা গেল, এই গাউলা ফিরনি আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য হলো গ্রামের মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করা। তিনি জানালেন, “প্রায় দীর্ঘ বছর আগে থেকেই কবরবাসীর আত্মার মাগফেরাত এর জন্য আয়োজন করে আসছিলেন। তারপর থেকেই প্রতি বছর এই আয়োজন হয়ে আসছে। মাঝখান দিয়ে কিছু বছর এই আয়োজন বন্ধ থাকলেও এখন আবার শুরু হয়েছে।
প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা:
এই আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু হয় প্রায় ১০ দিন আগে থেকেই। গ্রামের যুবকরা স্বেচ্ছাশ্রমে ধান সংগ্রহ করে, চাল গুঁড়া করে, দুধ ও গুড় সংগ্রহ করে। ফিরনি রান্নার জন্য বিশেষ চুলা তৈরি করা হয়। গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য জনাব আবুল হোসেন বলেন,“এই আয়োজনের জন্য সম্পূর্ণ অর্থায়ন গ্রামের মানুষ নিজেরাই করে থাকেন। কেউ ধান দেন, কেউ গুড় দেন, কেউ শ্রম দেন। এভাবেই আমরা এই আয়োজনকে সফল করে তুলি।”
গাউলা ফিরনি ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা:
ফিরনি তৈরির মূল কারিগর গ্রামের শাহ আক্তার । তিনি জানালেন, “এই ফিরনি তৈরির গোপন রেসিপি আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া। আমরা এতে চালের গুঁড়া, দুধ, গুড়, এবং বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি মশলা ব্যবহার করি। এই ফিরনির স্বাদ অন্য কোথাও পাবেন না।”
ফিরনি বিতরণের আগে একটি বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামের ইমাম সাহেব মাওলানা রফিকুল ইসলাম দোয়া পরিচালনা করেন। এরপর সবাই একসঙ্গে বসে ফিরনি খান। এই আয়োজনে ধর্মীয় রীতিনীতি থাকলেও, সকল ধর্মের মানুষই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।
গ্রামবাসীর প্রতিক্রিয়া ও প্রত্যাশা:
গ্রামের তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি জনাব ইমাম হোসেন অনিক জানালেন, “এই আয়োজন আমাদের গ্রামের একতার প্রতীক। আমরা সবাই মিলে এই আয়োজন করি এবং এতে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহমর্মিতা বৃদ্ধি পায়। “এই ফিরনি খেয়ে আমাদের মন ভালো হয়ে যায়। আমরা চাই এই আয়োজন যুগ যুগ ধরে চলুক।”
অন্যান্য বিষয়:
এই আয়োজনে এখনও পর্যন্ত কোন সরকারী বা বেসরকারী সংস্থার সহযোগিতা নেওয়া হয়নি। তবে গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য জানালেন, ভবিষ্যতে তারা সরকারী সহযোগিতার জন্য আবেদন করবেন। এই আয়োজনের ফলে গ্রামের মানুষের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে।
তবে, এই আয়োজন নিয়ে কোন বিতর্ক বা সমালোচনা নেই। বরং, এই আয়োজনের মাধ্যমে গ্রামের মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বৃদ্ধি পেয়েছে।
উপসংহার:
আলীয়াবাদের গাউলা ফিরনির আয়োজন শুধু একটি উৎসব নয়, এটি একটি গ্রামের মানুষের একতা, সম্প্রীতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। এই আয়োজন প্রমাণ করে যে, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে মানুষ একত্রিত হয়ে একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে পারে। এই আয়োজন আগামী প্রজন্মের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।