নিজেদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত নিজেই করতে চায় পুলিশ পুলিশের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ তদন্ত করতে ও ব্যবস্থা
- আপডেট টাইম : ০৩:১৪:৩৩ অপরাহ্ণ, রবিবার, ২০ অক্টোবর ২০২৪
- / ৩৩ ৫০০০.০ বার পাঠক
বর্তমান ব্যবস্থা সংস্কারে পুলিশ নিজেই তাদের সদস্যদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলো তদন্ত করার ক্ষমতা চায়। তবে নিয়ম অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ ছাড়া একটি নির্দিষ্ট পদমর্যাদার উপরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা সম্ভব না।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এমন পদক্ষেপ নিরপেক্ষ তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করবে এবং যেসব মামলায় পুলিশ অভিযুক্ত সেখানে ন্যায়বিচারের সম্ভাবনা আরও কমিয়ে আনবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটনের মতে, তদন্তের দায়িত্ব অবশ্যই একটি নিরপেক্ষ সংস্থাকে দিতে হবে, কেননা পুলিশের তদন্তের খুব কম সময়ই তাদের সহকর্মীদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
বর্তমানে সহকারী পুলিশ সুপার বা এর উপরের পদমর্যাদার কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহায়তায় তার তদন্ত করে থাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আর অভিযুক্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক বা এরচেয়ে নিচের পদমর্যাদার হলে সদর দপ্তর নিজেই তার তদন্ত করে।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ৪৪টি সংস্কার প্রস্তাব জমা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। যার একটিতে বলা হয়, ‘অপেশাদার কার্যকলাপ রোধ, পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের দ্রুত নিষ্পত্তি এবং আইন অনুযায়ী উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে পুলিশের শৃঙ্খলা বিভাগকে ঢেলে সাজাতে হবে।’
পুলিশের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ তদন্ত করতে ও ব্যবস্থা নিতে ইংল্যান্ড, ওয়েলস, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশে স্বাধীন তদারকি সংস্থা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরকম ব্যবস্থা প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়ায়।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া সময়ের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা প্রায়ই পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর খবর দেখি। এসব ক্ষেত্রে এক-দুটি ঘটনা ছাড়া কখনোই পুলিশের তদন্তে তাদের সহকর্মীদের দোষী সাব্যস্ত করা হয় না।’
নূর খান লিটন বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, একজন পুলিশ সদস্য কখনো আরেকজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করবে না। পুলিশ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকলে হয়তো এটা সম্ভব হতো।’
জ্যোতির্ময় ও নূর, দুজনই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের মত দেন।
২০০৭ সালে পুলিশ অধ্যাদেশের খসড়ায় একটি পুলিশ কমপ্লেইন কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল, যার প্রধান হবেন হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।
এই খসড়া অধ্যাদেশের লক্ষ্য ছিল পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা; বদলি, পদোন্নতি ও নিয়োগে স্বচ্ছতা আনা এবং সার্বিকভাবে জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
কিন্তু সেই খসড়া কখনোই আর আলোর মুখ দেখেনি।
আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে অনেক পুলিশ কর্মকর্তা কাঙ্ক্ষিত পদ ও পদোন্নতি পাওয়ার আশায় বলতে গেলে দলের কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। বিরোধী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছেন।
গণঅভ্যুত্থানের সময় অনেক পুলিশ সদস্য ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে সরাসরি গুলি চালান। এতে শত শত আন্দোলনকারী নিহত হন, অনেকেই মারাত্মকভাবে আহত হন।
এতে পুলিশের বিরুদ্ধে তীব্র জনরোষ তৈরি হয়। বিক্ষোভকারীরা ৪৪ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে, পুলিশের ২২৪টি অবকাঠামো জ্বালিয়ে দেয় এবং ২৩৬টি অবকাঠামোতে ভাঙচুর চালায়।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর অনেক পুলিশ সদস্যই ধর্মঘট ডাকেন। সেখানে পুলিশ পরিচালনা ও পুলিশকে ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে একটি স্বাধীন কমিশনের দাবি জানানো হয়।
অন্যান্য সংস্কার প্রস্তাব
পুলিশের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদারকি ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে হবে।
বল প্রয়োগ, গ্রেপ্তার, সন্দেহভাজনদের আটক করা, তল্লাশি চালানো এবং কিছু জব্দ করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত।
বৈষম্যমুক্ত নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নের জন্য গাইডলাইন প্রণয়ন; এবং সততা ও দক্ষতাকে উৎসাহিত করার প্রস্তাবও আনা হয়।
বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছানুযায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, পদায়ন ও শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
একটি সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন জাতীয় পুলিশ কমিশন প্রতিষ্ঠা; এবং পুলিশ আইন ১৮৬১, পুলিশ প্রবিধানমালা বেঙ্গল ১৯৪৩ ও বিশেষায়িত পুলিশ ইউনিটগুলোর বিধিমালা সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে- যৌন হয়রানি, লিঙ্গ বৈষম্য এবং নারীদের প্রতি পুলিশের অপেশাদার আচরণ প্রতিরোধে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং আধুনিক সরঞ্জামের মাধ্যমে পুলিশের কাজের দক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
মানবাধিকার, জেন্ডার, পুলিশ কার্যক্রমের উপর উন্নত প্রশিক্ষণ; অপরাধ তদন্ত ও তদারকির উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ; এবং বিশেষায়িত ইউনিটগুলোর জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণের প্রস্তাবও আনা হয়।
আন্তদেশীয় ও সংগঠিত অপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, মাদক, মানব পাচার ও আর্থিক অপরাধ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং সাইবার অপরাধ দমনে লজিস্টিকস বাড়ানোর প্রস্তাব আনা হয়।
এছাড়া আট ঘণ্টা কর্মদিবস, বাড়তি কাজের জন্য ভাতা, ঝুঁকি ভাতা এবং পুলিশ সদস্যদের জন্য আরও হাসপাতাল ও কোয়ার্টার বরাদ্দের প্রস্তাব আনা হয়।