ভারী বৃষ্টি ও ভারতের উজানের পানিতে বন্যাকবলিত হয়েছে দেশের ১১টি জেলা। বন্যায় এখন পর্যন্ত দুইজন নারীসহ ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৪৮ লাখের বেশি মানুষ।
এসব জেলার মধ্যে ফেনী জেলার মানুষের কাছে এবারের বন্যা একদিকে যেমন আকস্মিক অন্যদিকে অকল্পনীয়। শুধু ফেনী নয়, এর পাশের জেলা কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে বন্যা আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। বহু জায়গায় বন্যার পানি ঘরের চাল ছুঁয়েছে কিংবা উপচে গেছে।
ভারত সীমান্তের লাগোয়া এসব জেলায় এই বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। এই জেলাগুলোর বাসিন্দারা বলছেন, এসব জেরায় সচরাচর বন্যা হয় না। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অঞ্চলগুলোতে সচরাচর বন্যা না হবার তথ্যটি সঠিক নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি একটি বড় কারণ হলেও এর বাইরে আরও কিছু উপাদান এসব বন্যার পেছনে কাজ করছে। যেমন, নদীর পানি বহনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া। ওই অঞ্চলের নদীগুলোর নাব্যতা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মেঘালয় বা আসাম থেকে আসা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি নদী পথে হাওর থেকে বের হয়ে মেঘনা বা যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যেতে পারে না। সেই সঙ্গে, সিলেটসহ হাওর এলাকার অপরিকল্পিত উন্নয়নকেও এর জন্য দায়ী করেন অনেকে।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বন্যার এমন ভয়াবহতার কারণ সম্পর্কে পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, ৩০ বছর আগেও কুমিল্লা ও ফেনীতে প্রতি বছর বন্যা হতো। বন্যার কারণে গোমতীকে বলা হতো কুমিল্লার দুঃখ। এখন বন্যা না হবার কারণ হচ্ছে বাঁধ পানি ধরে রাখে। এই বাঁধটা ভারত করেছিল তাদের উপকারের জন্য, তাতে আমাদেরও কিছু উপকার হয়েছিল।
আইনুন নিশাত বলছেন, সারা মাসে যে পরিমাণ বৃষ্টি হবার কথা, অগাস্ট মাসের মাঝের তিনদিনে তার চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া ত্রিপুরা মিজোরামসহ বাংলাদেশের ওই অঞ্চলে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে তা যদি ঢাকায় হতো, তাহলে ঢাকার ৮০ শতাংশ এলাকা ডুবে যেত। ফলে বন্যার জন্য অতিবৃষ্টির বিষয়টিকেই গুরুত্ব দেওয়া যায়।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান জানিয়েছেন, কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রামে ‘বন্যা একেবারে হয় না, তাও না’। তবে অন্য বছরগুলোর তুলনায় এবছর বন্যা বেশি হয়েছে।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লাতে অত বড় বন্যা হয়নি। কিন্তু ফেনী, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারে সাধারণত বন্যা হয়। এ বছর বড় পরিসরে বেশি এলাকাজুড়ে বন্যা হয়েছে, ফলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। ২০০৭ সালের পর কুমিল্লায় এবারই বড় আকারের বন্যা হয়েছে। তবে হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে ২০১৮ সালেও এমন বন্যা দেখা যায়।’
পানি ও পরিবেশ ইন্সটিউটের চেয়ারম্যান ম. ইনামুল হক জানান, এই দুর্যোগ অস্বাভাবিক না। বরং আগের থেকেই ফেনী বন্যাপ্রবণ এলাকা। আর মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া, এই তিনটি নদী জেলাটিকে বেষ্টিত করে রেখেছে।
তিনি বলেন, নদীর পাশে বন্যা প্রতিরোধ বাঁধ আছে। এই বাঁধ অল্প বন্যা প্রতিরোধ করতে পারে, বড় বন্যা নয়। ফলে মিজোরাম ও ত্রিপুরায় যে ভারী বর্ষণ হয়েছে, তা উজান থেকে ভাটিতে নেমে এসেছে। আর এর মধ্যে একটি প্রভাব রেখেছ স্থানিক নিম্নচাপ। কারণ স্থানিক নিম্নচাপ হলে মেঘ উত্তর দিকে সরে যেতে পারে না। ফলে একটি জায়গাতে বৃষ্টিপাত করতেই থাকে। স্থানীয়ভাবে নিম্নচাপ হয়েছে, যার ফলে অতি বৃষ্টি ও বন্যা হয়েছে।
বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে গত বছর আগস্টে গ্রান্থাম রিসার্চ ইন্সটিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য এনভায়রমেন্ট ও সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিসি থেকে একটি সমীক্ষা প্রকাশিত হয়।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ মানুষ বন্যার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া ১৯৭১ থেকে ২০১৪ সাল অর্থাৎ ৪৩ বছরে হওয়া ৭৮টি বন্যায় ৪১ হাজার ৭৮৩ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আর এতে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ১২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) উদ্ধৃতি দিয়ে এতে বলা হয়, কেবল ২০১৪ সালের বন্যায় অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দুই দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার, যা দেশটির মোট জিডিপির প্রায় দেড় শতাংশ।
২০২২ সালের বন্যায় সাত দশমিক তিন মিলিয়ন মানুষ এবং এক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।