আবুু সাঈদ, আপনিই আমাদের জোহা স্যার!
- আপডেট টাইম : ১২:৪০:১৬ অপরাহ্ণ, রবিবার, ২৮ জুলাই ২০২৪
- / ৪৩ ৫০০০.০ বার পাঠক
কোনো শিক্ষক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক কেউই ছাত্রদের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। এই অভাববোধ, ক্ষেদ থেকেই সাঈদ যেন নিজেই হয়ে উঠলেন একজন শামসুজ্জোহা।
আবু সাঈদ, মারা যাওয়ার আগে গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন জোহা স্যারের অভাব। কায়মনে চেয়েছিলেন উনার উপস্থিতি। মৃত্যুর আগের দিন ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘স্যার! এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার, স্যার।’
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী এই ছাত্র, মৃত্যুর আগে হন্যে হয়ে তালাশ করেছিলেন একজন শামসুজ্জোহাকে, কেন? কারণ, উনার প্রত্যাশা ছিল, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে কেউ একজন রচনা করবেন নতুন ইতিহাস। হয়ে উঠবেন এই সময়ের জোহা স্যার! আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়িয়ে বলবেন, ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো যাবে না, যদি চালানো হয়, তা হবে আমার রক্তের ওপর দিয়ে। ১৯৬৯-এর অভ্যুত্থানের সময় যেমনটা বলেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক প্রক্টর মুহম্মদ শামসুজ্জোহা।
কাঙ্ক্ষিত একজন স্যারের দেখা পাওয়ার জন্য আবু সাঈদ আপনি-আপনারা অধীর আগ্রহে পার করেছেন একটা পক্ষ। কী কষ্টের সেই দিনগুলো! প্রতীক্ষার একটা পক্ষ হয়েছে এক বছরের চেয়েও দীর্ঘ, কিংবা তারও অধিক। তারপরও, অপেক্ষা করেছেন, প্রতীক্ষার প্রহর গুনেছেন, এক বুক আশা নিয়ে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন! তাই, একসময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানিয়েছেন, নিজের আকুতি। মেলে ধরেছেন আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার বারতা।
লিখেছেন, ‘স্যার! এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার স্যার।’ কিন্তু না সেই স্ট্যাটাসেও সাড়া মেলেনি কারও। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, দেখা মেলেনি সাঈদের-ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষিত শামসুজ্জোহা স্যারের। কোনো শিক্ষক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক কেউই ছাত্রদের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। এই অভাববোধ, ক্ষেদ থেকেই সাঈদ যেন নিজেই হয়ে উঠলেন একজন শামসুজ্জোহা। রচনা করলেন অমর এক ইতিহাস। যে ইতিহাস আমাদের স্মরণ করাবে ৯০,৮৭,৭১, ৬৯, ৫২-র রক্তঝরা দিনগুলোর মতো ২০২৪ কেও। মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায় ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সাঈদ থাকবেন অনুপ্রেরণার দীপশিখা হিসেবে। কেবল বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর যে প্রান্তে ন্যায়সঙ্গত দাবিদাওয়া ও অধিকারের প্রসঙ্গ হাজির হবে সেখানে দ্ব্যার্থহীনভাবে উচ্চারিত আবু সাঈদের নাম।
শামুসুজ্জোহা স্যারকে সাঈদ যেহেতু গভীরভাবে অনুভব করতে পেরেছিলেন, এ কারণে উনার জানা ছিল নিশ্চয় জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের কথা। ডায়ারের নির্মম-নির্দয় গুলিবর্ষণে অগণন হতাহতের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ব্রিটিশের দেওয়া নাইটহুড উপাধি। সাঈদের আত্মাহুতির সাহস দেখে ইতিহাস সচেতন সকলেরই মনে পড়বে নিশ্চয় ক্ষুদিরামের কথা।
সাঈদ, আমাদের বিশ্বাস, আপনার ও আপনাদের মতো ছাত্রদের ভেতরেই বেঁচে থাকেন একজন নূর হোসেন, একজন রুমি, একজন আসাদ, একজন রফিক-শফিক-বরকত-জব্বারের মতো অগণন সব সাহসী প্রাণ। যারা জীবন বিসর্জন দেন দেশপ্রেম থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে ন্যায় ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায়। যাদের চাওয়া ছিল কেবল একটাই মানুষের মুক্তি-স্বস্তি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা। যেমনটা চেয়েছিলেন আপনি ও আপনারা। যার নাম কোটা সংস্কার। কারণ, কোটার নামে সরকারি চাকরির অর্ধেকেরও বেশি দখলে নিয়েছিল অন্যায় অপকর্মের হোতারা।
বেশিরভাগ কোটা যে লক্ষ্যের জন্য রাখা হয়েছিল, তা তো বাস্তবায়ন হচ্ছিলই না, উপরন্তু সেসবে শেকড় গেড়েছিল সকল প্রকারের ফন্দি-ফিকির আর দুর্নীতি। কোটার ৩০ ভাগ বরাদ্দ ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের জন্য। এসব যে স্বচ্ছভাবে হচ্ছিল না, তার বড় প্রমাণ সনদধারী ৬২ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতি। অন্যের সন্তানকে নিজের পরিচয় দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের কোটায় চাকরি নেওয়ার মতো অপরাধ। এসব গুরুতর অন্যায়-অপকর্মের অবসান চেয়েছিলেন আপনারা। এজন্যেই নেমে ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে।
চাকরির বাজারের এই হাহাকারের দিনে, যেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ বেকার ধুঁকছে চাকরির অভাবে, যেখানে মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনকে করে তুলেছে সঙ্গিন ও জীবন্মৃত, যেখানে শাসক ও প্রশাসক বর্গ কেবলই স্বার্থ দেখছে উপরমহল ও নিজ বৃত্তের ঘেরাটোপে। সেখানে কোটা সংস্কার চাওয়া কি অন্যায় কিছু? মানুষ কি বেঁচে থাকার জন্য শেষ অধিকার হিসেবে এটুকুও চাইতে পারবে না?
সাঈদ ও তার সতীর্থদের চাওয়া ছিল একেবারে যৎসামান্য। সেখানেও যখন তারা হতমান হয়েছেন, নির্দয় নিষ্পেষণের শিকার হয়েছেন, তকমা পেয়েছেন বিশেষ বিশেষ শব্দের। বিপরীতে অবিশ্বাস্যভাবে পাশে পাননি কাউকেই। তখনই সাঈদ মনের ভেতরের আকাঙ্ক্ষাটাকে, একজন জোহা স্যারের প্রত্যাশাকে লিখে দিয়েছেন ফেসবুকের পাতায়। তারপর, এক বুক বেদনা ও হাহাকার নিয়ে দেখেছেন এ সময় কেউ হতে চান না একজন শামসুজ্জোহা। কারণ, আখের গোছানোর সুবর্ণসময় এখনই বুঝি বয়ে যায়!
কেন সাঈদ একজন শামসুজ্জোহাকে গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন? কারণ তিনি জানতেন শামসুজ্জোহারা ন্যায় ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শক্তি যোগায়। যেমনটা করেছিলেন ১৯৬৯-এ। শেখ মুজিব তখনও বঙ্গবন্ধু না হলেও বাঙালির, সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। সবার চাওয়া হয়ে উঠেছিল একটাই, ‘জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো’। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নাম্বার আসামি তিনি।