ঢাকা ০৭:২৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪
সংবাদ শিরোনাম ::
মহাদেবপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় এক শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু বরিশালে দুই মাস পর খুলে দেওয়া হলো খলিলের মাংসের দোকান সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে চোরাইকৃত মিশুকের যন্ত্রাংশ উদ্ধার,তিন গাড়ি চোর গ্রেফতার ফিলিস্তিনের পক্ষে সংহতি জানিয়ে ইবি ছাত্রলীগের বিক্ষোভ-সমাবেশ রাতে কাজ শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন জুতার দোকানের কর্মচারী রাস্তাতে ধরে মাদক মামলায় ফাসালেন পুলিশ অভিযোগ করেন ফরিদ এই মাসে ঘূর্ণিঝড়ের ইঙ্গিত আবহাওয়া অফিসের রাজধানীর যেসব এলাকায় বসবে কুরবানির হাট এমপিদের চেয়ে এগিয়ে চেয়ারম্যানরা অবৈধ সম্পদ বেশি অপকর্ম ঢাকতে আল জাজিরার সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে ইসরাইল ডায়মন্ডহারবার জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ট্রাফিক পুলিশের হাতে তুলে ধরা হল ছাতা গুলোকজ, তোয়ালে

কুরআন-হাদীসের আলোকে মিরাজের বর্ণনা ও শিক্ষা

  • নিজস্ব প্রতিবেদন
  • আপডেট টাইম : ০৭:০৯:০০ পূর্বাহ্ণ, বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
  • ৪৩ ০.০০০ বার পাঠক

বছরের ১২টি মাসই আল্লাহ তায়ালার অশেষ দান আর প্রত্যেকটি মাসই অতীব গুরুত্বপূর্ন। ইসলামে পাঁচটি রাত বিশেষ ফজিলত ও তাৎপর্যপূর্ণ। পবিত্র শবে মেরাজ এর অন্যতম। এই রাতে রাসুলের (সা.) জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুজিজা বা অলৌকিক ঘটনাগুলোর একটি ‘মেরাজ’ সংঘটিত হয়। ২৬ রজব দিবাগত রাতে রাসুল (সা.) আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ঊর্ধ্বাকাশে গমন করেন। ঐতিহাসিক সেই সফরকেই মেরাজ বলা হয়। মেরাজ আরবি শব্দ, শাব্দিক অর্থ ঊর্ধ্বগমন, আকাশপথে ভ্রমণ করা, সোপান ইত্যাদি। রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে উম্মে হানির ঘর থেকে জাগ্রত অবস্থায় বোরাকে করে মসজিদে হারাম থেকে আরশে আজিমে পৌঁছে আল্লাহর দিদার লাভ করার নামই মেরাজ। কোরআনে কারিমে আল্লাহ বলেন, ‘পবিত্র সত্তা তিনি, যিনি বান্দাকে তাঁর নিদর্শনগুলো দেখানোর জন্য রাত্রিকালে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার পরিবেশ পবিত্র, নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১)।

শবে মিরাজকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে বেশ কিছু প্রচলনসহ বিশেষ নামাজ ও রোজা রাখার প্রথাও প্রচলিত রয়েছে। শবে মিরাজ উপলক্ষে কোনো নামাজ বা রোজার বিধান কি আসলেই ইসলামে রয়েছে? আসুন এ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেইৃমেরাজ সংঘটিত হয়েছিল নবুওয়াতের ১১তম বছরের ২৭ রজবে। তখন নবীজির বয়স ৫১ বছর। মেরাজ হয়েছিল সশরীরে জাগ্রত অবস্থায়। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ হলো কাফের, মুশরিক ও মুনাফিকদের অস্বীকৃতি ও অবিশ্বাস। যদি আধ্যাত্মিক বা রুহানিভাবে অথবা স্বপ্নযোগে হওয়ার কথা বলা হতো, তাহলে তাদের অবিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল না। মেরাজের বিবরণ পবিত্র কোরআনের সুরা নাজমে সুরা ইসরায় বিবৃত হয়েছে। হাদিস শরিফ, বুখারি শরিফ, মুসলিম শরিফ, সিহাহ সিত্তাসহ অন্যান্য কিতাবে এই ইসরা ও মেরাজের বিষয়টি নির্ভরযোগ্য বিশুদ্ধ সূত্রে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘শপথ নক্ষত্রের যখন তা বিলীন হয়। তোমাদের সাথি (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিপথগামী হননি এবং বিভ্রান্ত হননি। আর তিনি নিজে থেকে কোনো কথা বলেন না। (বরং তিনি যা বলেন) তা প্রদত্ত ওহি (ভিন্ন অন্য কিছু) নয়। তাকে শিখিয়েছেন মহাশক্তিধর (জিবরাইল আ.)। সে (জিবরাইল আ.) পাখাবিশিষ্ট, সে স্থিত হয়েছে দূর ঊর্ধ্বে। অতঃপর নিকটবর্তী হলো, পরে নির্দেশ করল। তারপর হলো দুই ধনুকের প্রান্তবর্তী বা আরও নিকট। পুনরায় তিনি ওহি করলেন তাঁর বান্দার প্রতি যা তিনি ওহি করেছেন। ভুল করেনি অন্তর যা দেখেছে। তোমরা কি সন্দেহ করছ তাকে, যা তিনি দেখেছেন সে বিষয়ে। আর অবশ্যই দেখেছেন তিনি তাকে দ্বিতীয় অবতরণ স্থলে; সিদরাতুল মুনতাহার কাছে; তার নিকটেই জান্নাতুল মাওয়া। যখন ঢেকে গেল সিদরা যা ঢেকেছে; না দৃষ্টিভ্রম হয়েছে আর না তিনি বিভ্রান্ত হয়েছেন; অবশ্যই তিনি দেখেছেন তাঁর রবের বড় বড় নিদর্শনসমূহ।’ (সুরা নাজম : ১)।

উম্মুল মুমিনিন হজরত খাদিজা (রা.)-এর ইন্তেকালের পরে এবং আকাবার শপথের আগে মিরাজের ঘটনা ঘটে। ৬২১ খ্রিস্টাব্দের (নবুয়তের দ্বাদশ বছরে) হজের সময় নবী মুহাম্মদ (সা.) মিনার কাছে আকাবা উপত্যকায় মদিনার ১২ সদস্যের এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সময় তারা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং কিছু বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। মদিনার ওই লোকদের এ শপথ আকাবার প্রথম শপথ নামে পরিচিত। মিরাজের ঘটনার সুনির্দিষ্ট সালের ব্যাপারে কিছুটা মতভেদ থাকলেও ঘটনাটি হিজরতের এক বছর আগে রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতে (২৬ তারিখ দিবাগত রাতে) সংঘটিত হয়েছিল এ ব্যাপারে অধিকাংশ ইমাম ও ঐতিহাসিকরা একমত। মিরাজের রাতে আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় বান্দা ও রাসুলকে তার একান্ত সান্নিধ্যে নেওয়ার অলৌকিক ব্যবস্থা করেন, তাকে বেহেশত-দোজখসহ অসংখ্য নিদর্শন দেখান, তার সঙ্গে একান্তে কথা বলেন, তার অন্তর নূর, প্রজ্ঞা ও হেকমত দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেন, মানবতার কল্যাণের নিমিত্তে তাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও সুরা বাকারার শেষ তিন আয়াত হাদিয়া প্রদান করা হয়।

মিরাজের ঘটনার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন হযরত জিবরাইল (আ.) ও হজরত মিকাইল (আ.)। তারা ওই রাতে উম্মে হানির ঘরে গভীর ঘুমে থাকা নবী মুহাম্মদকে (সা.) পবিত্র কাবা চত্বরে নিয়ে যান। সেখানে তারা নবী করিমকে (সা.) মহাভ্রমণের উপযোগী করার লক্ষ্যে আল্লাহর হুকুমে আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় ‘সিনা চাক’ করেন। এরপর তারা তাকে বোরাক নামক দ্রুতগামী বাহনে করে বায়তুল মোকাদ্দাসে নিয়ে যান। সেখানে নবী করিম (সা.) অনেক নবীর নামাজের জামাতে ইমামতি করেন। সবাইকে সালাম করে এবার তিনি বোরাকে করে বায়তুল মামুরসহ (ফেরেশতাদের কেবলা) অনেক কুদরত ও নিদর্শন দেখে সিদরাতুল মুনতাহায় উপনীত হন। আল্লাহ যা বলার তা তার বান্দাকে বলেন, যা দেখানোর তা দেখান, যা দেওয়ার তা প্রদান করেন। মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্বোচ্চ সম্মান, আল্লাহর পরম ভালোবাসা, প্রভুর জন্য চরম ত্যাগের অনুভূতি, হিজরতের পরে একটি ইসলামি সমাজ বিনির্মাণের অনুপ্রেরণা, উম্মতের কল্যাণার্থে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং উম্মতে মুহাম্মদির জন্য মহান আল্লাহর বিশেষ করুণাসংবলিত বাণী সুরা বাকারার শেষ তিন আয়াত নিয়ে নবী করিম (সা.) আল্লাহর নির্ধারিত উপায়ে সেই রাতেই ফিরে আসেন পৃথিবীতে।

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মক্কি জীবনের শেষভাগে আকাবার শপথের আগে সংঘটিত হয়েছিল মিরাজ। সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে মিরাজের রয়েছে গভীর যোগসূত্র। কারণ, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মক্কি জীবনের শেষভাগে কাফেরদের বিরোধিতা তীব্র আকার ধারণ করে। এক পর্যায়ে কাফেররা নবী করিম (সা.)-এর বংশের সঙ্গে সব ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। নবুয়তের সপ্তম বছরের এ অবরোধে আবু তালিব উপত্যকায় কার্যত মুসলমানরা বন্দি হয়ে পড়েন। নবুয়তের দশম বছর নবী করিম (সা.)-এর কষ্টের জীবনসাথী এবং তার অর্থনৈতিক বড় অবলম্বন হজরত খাদিজা (রা.) ইন্তিকাল করেন। এ সময় নবী করিম (সা.)-এর অন্যতম অভিভাবক আবু তালেবও ইন্তিকাল করেন। আবু তালেব মুসলমান না হলেও কাফেরদের অত্যাচারের মুখে সব সময় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতেন। মানসিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবলম্বন হাতছাড়া হওয়ার পর রাসুল (সা.) ও সাহাবিদের ওপর কাফেরদের অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। মক্কার ভূমি মুসলমানদের জন্য ক্রমান্বয়ে সঙ্কীর্ণ হতে থাকে।

এমতাবস্থায় মদিনা থেকে একটি আশার আলো দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু সে আলো ছিল বেশ ক্ষীণ। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) এক বুক আশা নিয়ে তায়েফে দাওয়াত দিতে গেলেন। কিন্তু তায়েফবাসী দাওয়াত তো গ্রহণ করলই না, বরং নবীকে মেরে রক্তাক্ত করল। এমন অবস্থায় যখন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জাগতিক সব অবলম্বন হাতছাড়া, মক্কাবাসীদের ইমান গ্রহণের বিষয়ে আশাহত, গোটা আরব তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ, তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে, চরম দুঃখ-কষ্টে সান্ত¡না দেওয়া ও আশার বাণী শোনানো স্ত্রীও পরপারে, বংশের অভিভাবকও ইন্তেকাল করেছেন ঠিক তখন আল্লাহতায়ালা নবী করিম (সা.)-এর সব দুঃখ-কষ্ট ভুলানোর জন্য এবং নবুয়ত-রিসালাতের কঠিন কাজকে আরও সুদৃঢ় করার জন্য তাকে তার পরম সান্নিধ্যে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভে তিনি তৃপ্ত হন, অসংখ্য নিদর্শন দর্শনে তিনি হিকমত ও প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ হন। আল্লাহর সান্নিধ্যে এসে তিনি একটি আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণ এবং বিরুদ্ধবাদীদের মোকাবিলায় ইস্পাতের মতো দৃঢ়তা প্রদর্শনের যোগ্যতা অর্জন করেন। মহান আল্লাহর ভালোবাসায় তিনি সবকিছু করার মনোবল অর্জন করেন। মিরাজের পরই আকাবার শপথের মাধ্যমে হিজরতের পটভূমি তৈরি হয়। মিরাজের পরে নাজিল হয়- মিরাজ সম্পর্কিত বনি ইসরাইল সুরা। এ সুরায় ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ঐতিহাসিক চৌদ্দ দফা নাজিল হয়। এ নির্দেশিকার আলোকে নবী করিম (সা.) সাহাবিদের গড়ে তুলেন এবং হিজরতের পর একটি আদর্শ ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন। (চলবে)

আরো খবর.......

আপলোডকারীর তথ্য

মহাদেবপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় এক শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু

কুরআন-হাদীসের আলোকে মিরাজের বর্ণনা ও শিক্ষা

আপডেট টাইম : ০৭:০৯:০০ পূর্বাহ্ণ, বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বছরের ১২টি মাসই আল্লাহ তায়ালার অশেষ দান আর প্রত্যেকটি মাসই অতীব গুরুত্বপূর্ন। ইসলামে পাঁচটি রাত বিশেষ ফজিলত ও তাৎপর্যপূর্ণ। পবিত্র শবে মেরাজ এর অন্যতম। এই রাতে রাসুলের (সা.) জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুজিজা বা অলৌকিক ঘটনাগুলোর একটি ‘মেরাজ’ সংঘটিত হয়। ২৬ রজব দিবাগত রাতে রাসুল (সা.) আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ঊর্ধ্বাকাশে গমন করেন। ঐতিহাসিক সেই সফরকেই মেরাজ বলা হয়। মেরাজ আরবি শব্দ, শাব্দিক অর্থ ঊর্ধ্বগমন, আকাশপথে ভ্রমণ করা, সোপান ইত্যাদি। রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে উম্মে হানির ঘর থেকে জাগ্রত অবস্থায় বোরাকে করে মসজিদে হারাম থেকে আরশে আজিমে পৌঁছে আল্লাহর দিদার লাভ করার নামই মেরাজ। কোরআনে কারিমে আল্লাহ বলেন, ‘পবিত্র সত্তা তিনি, যিনি বান্দাকে তাঁর নিদর্শনগুলো দেখানোর জন্য রাত্রিকালে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার পরিবেশ পবিত্র, নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১)।

শবে মিরাজকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে বেশ কিছু প্রচলনসহ বিশেষ নামাজ ও রোজা রাখার প্রথাও প্রচলিত রয়েছে। শবে মিরাজ উপলক্ষে কোনো নামাজ বা রোজার বিধান কি আসলেই ইসলামে রয়েছে? আসুন এ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেইৃমেরাজ সংঘটিত হয়েছিল নবুওয়াতের ১১তম বছরের ২৭ রজবে। তখন নবীজির বয়স ৫১ বছর। মেরাজ হয়েছিল সশরীরে জাগ্রত অবস্থায়। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ হলো কাফের, মুশরিক ও মুনাফিকদের অস্বীকৃতি ও অবিশ্বাস। যদি আধ্যাত্মিক বা রুহানিভাবে অথবা স্বপ্নযোগে হওয়ার কথা বলা হতো, তাহলে তাদের অবিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল না। মেরাজের বিবরণ পবিত্র কোরআনের সুরা নাজমে সুরা ইসরায় বিবৃত হয়েছে। হাদিস শরিফ, বুখারি শরিফ, মুসলিম শরিফ, সিহাহ সিত্তাসহ অন্যান্য কিতাবে এই ইসরা ও মেরাজের বিষয়টি নির্ভরযোগ্য বিশুদ্ধ সূত্রে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘শপথ নক্ষত্রের যখন তা বিলীন হয়। তোমাদের সাথি (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিপথগামী হননি এবং বিভ্রান্ত হননি। আর তিনি নিজে থেকে কোনো কথা বলেন না। (বরং তিনি যা বলেন) তা প্রদত্ত ওহি (ভিন্ন অন্য কিছু) নয়। তাকে শিখিয়েছেন মহাশক্তিধর (জিবরাইল আ.)। সে (জিবরাইল আ.) পাখাবিশিষ্ট, সে স্থিত হয়েছে দূর ঊর্ধ্বে। অতঃপর নিকটবর্তী হলো, পরে নির্দেশ করল। তারপর হলো দুই ধনুকের প্রান্তবর্তী বা আরও নিকট। পুনরায় তিনি ওহি করলেন তাঁর বান্দার প্রতি যা তিনি ওহি করেছেন। ভুল করেনি অন্তর যা দেখেছে। তোমরা কি সন্দেহ করছ তাকে, যা তিনি দেখেছেন সে বিষয়ে। আর অবশ্যই দেখেছেন তিনি তাকে দ্বিতীয় অবতরণ স্থলে; সিদরাতুল মুনতাহার কাছে; তার নিকটেই জান্নাতুল মাওয়া। যখন ঢেকে গেল সিদরা যা ঢেকেছে; না দৃষ্টিভ্রম হয়েছে আর না তিনি বিভ্রান্ত হয়েছেন; অবশ্যই তিনি দেখেছেন তাঁর রবের বড় বড় নিদর্শনসমূহ।’ (সুরা নাজম : ১)।

উম্মুল মুমিনিন হজরত খাদিজা (রা.)-এর ইন্তেকালের পরে এবং আকাবার শপথের আগে মিরাজের ঘটনা ঘটে। ৬২১ খ্রিস্টাব্দের (নবুয়তের দ্বাদশ বছরে) হজের সময় নবী মুহাম্মদ (সা.) মিনার কাছে আকাবা উপত্যকায় মদিনার ১২ সদস্যের এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সময় তারা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং কিছু বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। মদিনার ওই লোকদের এ শপথ আকাবার প্রথম শপথ নামে পরিচিত। মিরাজের ঘটনার সুনির্দিষ্ট সালের ব্যাপারে কিছুটা মতভেদ থাকলেও ঘটনাটি হিজরতের এক বছর আগে রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতে (২৬ তারিখ দিবাগত রাতে) সংঘটিত হয়েছিল এ ব্যাপারে অধিকাংশ ইমাম ও ঐতিহাসিকরা একমত। মিরাজের রাতে আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় বান্দা ও রাসুলকে তার একান্ত সান্নিধ্যে নেওয়ার অলৌকিক ব্যবস্থা করেন, তাকে বেহেশত-দোজখসহ অসংখ্য নিদর্শন দেখান, তার সঙ্গে একান্তে কথা বলেন, তার অন্তর নূর, প্রজ্ঞা ও হেকমত দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেন, মানবতার কল্যাণের নিমিত্তে তাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও সুরা বাকারার শেষ তিন আয়াত হাদিয়া প্রদান করা হয়।

মিরাজের ঘটনার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন হযরত জিবরাইল (আ.) ও হজরত মিকাইল (আ.)। তারা ওই রাতে উম্মে হানির ঘরে গভীর ঘুমে থাকা নবী মুহাম্মদকে (সা.) পবিত্র কাবা চত্বরে নিয়ে যান। সেখানে তারা নবী করিমকে (সা.) মহাভ্রমণের উপযোগী করার লক্ষ্যে আল্লাহর হুকুমে আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় ‘সিনা চাক’ করেন। এরপর তারা তাকে বোরাক নামক দ্রুতগামী বাহনে করে বায়তুল মোকাদ্দাসে নিয়ে যান। সেখানে নবী করিম (সা.) অনেক নবীর নামাজের জামাতে ইমামতি করেন। সবাইকে সালাম করে এবার তিনি বোরাকে করে বায়তুল মামুরসহ (ফেরেশতাদের কেবলা) অনেক কুদরত ও নিদর্শন দেখে সিদরাতুল মুনতাহায় উপনীত হন। আল্লাহ যা বলার তা তার বান্দাকে বলেন, যা দেখানোর তা দেখান, যা দেওয়ার তা প্রদান করেন। মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্বোচ্চ সম্মান, আল্লাহর পরম ভালোবাসা, প্রভুর জন্য চরম ত্যাগের অনুভূতি, হিজরতের পরে একটি ইসলামি সমাজ বিনির্মাণের অনুপ্রেরণা, উম্মতের কল্যাণার্থে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং উম্মতে মুহাম্মদির জন্য মহান আল্লাহর বিশেষ করুণাসংবলিত বাণী সুরা বাকারার শেষ তিন আয়াত নিয়ে নবী করিম (সা.) আল্লাহর নির্ধারিত উপায়ে সেই রাতেই ফিরে আসেন পৃথিবীতে।

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মক্কি জীবনের শেষভাগে আকাবার শপথের আগে সংঘটিত হয়েছিল মিরাজ। সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে মিরাজের রয়েছে গভীর যোগসূত্র। কারণ, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মক্কি জীবনের শেষভাগে কাফেরদের বিরোধিতা তীব্র আকার ধারণ করে। এক পর্যায়ে কাফেররা নবী করিম (সা.)-এর বংশের সঙ্গে সব ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। নবুয়তের সপ্তম বছরের এ অবরোধে আবু তালিব উপত্যকায় কার্যত মুসলমানরা বন্দি হয়ে পড়েন। নবুয়তের দশম বছর নবী করিম (সা.)-এর কষ্টের জীবনসাথী এবং তার অর্থনৈতিক বড় অবলম্বন হজরত খাদিজা (রা.) ইন্তিকাল করেন। এ সময় নবী করিম (সা.)-এর অন্যতম অভিভাবক আবু তালেবও ইন্তিকাল করেন। আবু তালেব মুসলমান না হলেও কাফেরদের অত্যাচারের মুখে সব সময় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতেন। মানসিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবলম্বন হাতছাড়া হওয়ার পর রাসুল (সা.) ও সাহাবিদের ওপর কাফেরদের অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। মক্কার ভূমি মুসলমানদের জন্য ক্রমান্বয়ে সঙ্কীর্ণ হতে থাকে।

এমতাবস্থায় মদিনা থেকে একটি আশার আলো দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু সে আলো ছিল বেশ ক্ষীণ। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) এক বুক আশা নিয়ে তায়েফে দাওয়াত দিতে গেলেন। কিন্তু তায়েফবাসী দাওয়াত তো গ্রহণ করলই না, বরং নবীকে মেরে রক্তাক্ত করল। এমন অবস্থায় যখন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জাগতিক সব অবলম্বন হাতছাড়া, মক্কাবাসীদের ইমান গ্রহণের বিষয়ে আশাহত, গোটা আরব তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ, তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে, চরম দুঃখ-কষ্টে সান্ত¡না দেওয়া ও আশার বাণী শোনানো স্ত্রীও পরপারে, বংশের অভিভাবকও ইন্তেকাল করেছেন ঠিক তখন আল্লাহতায়ালা নবী করিম (সা.)-এর সব দুঃখ-কষ্ট ভুলানোর জন্য এবং নবুয়ত-রিসালাতের কঠিন কাজকে আরও সুদৃঢ় করার জন্য তাকে তার পরম সান্নিধ্যে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভে তিনি তৃপ্ত হন, অসংখ্য নিদর্শন দর্শনে তিনি হিকমত ও প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ হন। আল্লাহর সান্নিধ্যে এসে তিনি একটি আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণ এবং বিরুদ্ধবাদীদের মোকাবিলায় ইস্পাতের মতো দৃঢ়তা প্রদর্শনের যোগ্যতা অর্জন করেন। মহান আল্লাহর ভালোবাসায় তিনি সবকিছু করার মনোবল অর্জন করেন। মিরাজের পরই আকাবার শপথের মাধ্যমে হিজরতের পটভূমি তৈরি হয়। মিরাজের পরে নাজিল হয়- মিরাজ সম্পর্কিত বনি ইসরাইল সুরা। এ সুরায় ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ঐতিহাসিক চৌদ্দ দফা নাজিল হয়। এ নির্দেশিকার আলোকে নবী করিম (সা.) সাহাবিদের গড়ে তুলেন এবং হিজরতের পর একটি আদর্শ ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন। (চলবে)