কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার শাহ মাহতাব আলী বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম আশ্রয়শিবির
- আপডেট টাইম : ১১:৪৯:১২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৫ মে ২০২৩
- / ৬৭০ ৫০০০.০ বার পাঠক
মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক,৭১ সালে দেশের অভ্যন্তরে প্রথম শরনার্থী আশ্রয় শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা,১৯৪৭/৪৮ সালে অবৈতনিক আনসার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা শাহ্ মাহতাব আলী ১৯১৪ সালের ১৫ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার অষ্টবর্গ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন ১৫ শতকের সূফি দরবেশ হযরত শাহ্ সাগড়া শাহ্ (রঃ) এবং শ্বশুর ছিলেন শেখ আহমদ আলী মাষ্টার যিনি ভারতের আসামে বসবাস করতেন। জমিদার সুরেন্দ্র নাথ দত্তের সঙ্গে হিন্দু মুসলিম রায়ঠোত্তর কালে সম্পদ বিনিময়ে আসাম থেকে শেখ আহমদ আলী বাংলাদেশে চলে আসেন এবং কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার বেরুয়াইল কলাপাড়া গ্রামে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন। শাহ্ মাহতাব আলী ছোটবেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী। দক্ষ ফুটবলার ও অভিনয়শিল্পী হিসেবেও তিনি সবার নজর কাড়েন।ভদ্র, সুশীল ও পরোপকারী হিসাবেও এলাকায় তাঁর খ্যাতি ছিল। কিশোরগঞ্জের রামানন্দ হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করার পর পিতৃবিয়োগের কারনে লেখাপড়া বেশিদূর এগোতে পারেনি। কিন্তু আজীবন শিক্ষানুরাগী এই কীর্তিমান পুরুষ ১৯৪৩ সালে ধনাঢ্য বন্ধুদের নিয়ে দরিদ্র হিতৈষী ক্লাব গড়ে তোলেন।এ ক্লাবের উদ্দেশ্য ছিল নিম্নবর্ণের হিন্দু ও দরিদ্র মুসলিম পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়ায় সহযোগিতা ও কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাদের সাহায্য করা। এছাড়া ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দুর্ভিক্ষ শুরু হলে তিনি তাঁর পরিবারের খরচ কমিয়ে সমস্ত টাকা পয়সা, ধান চাল ও অন্যান্য সামগ্রী দুর্গতদের মাঝে বিলিয়ে দেন।এটি ছিল তাঁর চিরাচরিত অভ্যাস। শাহ্ মাহতাব আলী ১৯৩৫ সালে ” লাঙ্গল যার জমি তার” প্রজাস্বত্ব আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং ১৯৪৭ সালে জীবন বাজি রেখে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সুরক্ষা দান ও পরবরর্তীতে ১৯৪৮ সালে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা দমন ও সদ্য বিভাজিত দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য অবৈতনিক আনসার বাহিনী নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।এর কিছুদিন পরেই ১৯৪৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আনসার বাহিনী গঠিত হলে যেসকল উৎসাহি যুবক অবৈতনিক কর্মকর্তা হিসাবে এ বাহিনীতে যোগদান করেন শাহ্ মাহতাব আলী তাঁদের অন্যতম। পরবরর্তীতে এই অবৈতনিক আনসার বাহিনী বাংলাদেশ আনসার নামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অধিনস্ত নিয়মিত বাহিনীতে রুপান্তর করেন এবং বেতন ভাতা সহ অন্যান্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা চালু করেন। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে এই আনসার বাহিনী ৫২ এর ভাষা আন্দোলন,৬৯ এর গন অভ্যুথান এবং পরিশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন তৎকালীন রেসকোর্সের মাঠে লাখো মানুষের সামনে ঘোষণা দিলেন “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ” তখনই শাহ্ মাহতাব আলী বুঝে গেলেন যে অদম্য বাঙ্গালীদের আর থামিয়ে রাখা যাবেনা। তিনি তখন তলে তলে মুক্তিবাহিনীতে যোদ্ধা পাঠাতে শুরু করেন এবং সবাইকে সংগঠিত করার জোর তৎপরতা শুরু করেন।৭ই মার্চের নির্দেশনায় সশস্ত্র আনসার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাকালীন সংগঠক ও সাবেক আনসার বাহিনীর কর্মকর্তা হিসাবে নিজ দায়িত্ববোধ থেকেই শাহ্ মাহতাব আলী কিশোরগঞ্জ শহরের আজিম উদ্দিন হাইস্কুলের হেডমাষ্টার মতিউর রহমান, করিমগঞ্জ উপজেলার গুজাদিয়া গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন, ভাষাসৈনিক ডাঃ এ এ মাজহারুল হক, চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ মতিউর রহমান সহ আরো অনেকে আজিম উদ্দিন হাইস্কুলের মাঠে তৎকালীন ইপিআর ও আনসার বাহিনীর সদস্য দ্বারা স্থানীয় যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া এবং তাদের খাবারের ব্যবস্থা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। তবে তাদের এই প্রচেষ্টা এক সপ্তাহের মধ্যেই ভন্ডুল হয়ে যায়। কিশোরগঞ্জ দখল করে নেয় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। তাদের সহযোগীতা করে স্থানীয় বিহারী সম্প্রদায় ও এদেশিয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস গোষ্ঠী। শাহ্ মাহতাব আলী ছিলেন ঐ সময় গৌরাঙ্গ বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি। রাতের মধ্যেই শাহ্ মাহতাব আলীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বেছে বেছে আরো অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আবাসস্থল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী জ্বালিয়ে দেয়।
শাহ্ মাহতাব আলী তাঁর ব্যবসায়ি কম্যুনিটির সদস্য, ঢাকা থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা বিভিন্ন আত্বীয় স্বজন বা যাদের শহরের বাইরে কোন আবাসস্থল নাই, নিজের পরিবার পরিজন সহ তাদের সঙ্গে নিয়ে রাতেই পালিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে আসেন। কিশোরগঞ্জ শহরস্থ রহিম স্টেশনারীর মালিক রহিম সহ তাঁর বড়ভাই তথ্য কর্মকর্তা মজিদ এর পরিবার এবং আরো অনেকেই তাদের সর্বস্ব ফেলে জীবন বাঁচাতে অষ্টবর্গের এই ঐতিহাসিক বাড়িতে এসে আশ্রয় নেয়। সেই বিভীষিকাময় রাতে একদিকে যেমন সবাই প্রাণভয়ে কাঁপছেন, অন্যদিকে তাদের ফেলে আসা সম্পদ রাজাকার আলবদর বাহিনী লুটতরাজ করেছে আর আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে।
শাহ্ মাহতাব আলী বাড়িতে এসেই মহিলাদেরকে ডেকে বললেন ” আমার পরিবার আজ থেকে বড় হলো, তোমরা সকলে মিলে আমার গোলা থেকে ধান এনে ভাঙ্গাবে, টিনের চাল থেকে লাউ এনে দিবে আর পুকুর থেকে মাছ ধরে এনে রান্না করে সবাইকে খাওয়াবে।” শুরু হলো আশ্রয় কেন্দ্রের হাঁটি হাঁটি পায়ে পথচলা। পরবরর্তীতে আরো অনেক পরিবার প্রাণভয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পালিয়ে এসে এই বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন।আর এভাবেই কিশোরগঞ্জ শহরের অষ্টবর্গ গ্রামের শাহ্ বাড়ি হয়ে উঠে দেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম আশ্রয়শিবির।
যুদ্ধের এই বিভীষিকাময় সময়েও শাহ্ মাহতাব আলী নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় মানুষদের আত্মরক্ষায় এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে তাদের যুদ্ধবিদ্যায় প্রাথমিক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং অষ্টবর্গ গ্রামে নিজের বাড়িতে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা মানুষদের জন্য আশ্রয় শিবির নির্মাণ করায় নিজে হানাদার বাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন।
শহর থেকে একটু দূরে বাড়ি হওয়াতে সামনের বিরাট মাঠ হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আত্মরক্ষা ও প্রাথমিক প্রশিক্ষণের নিরাপদ স্থান। এই মাঠেই তাঁর সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেসা তাদের খাবার পৌঁছে দিতেন আর সবাই মিলে এই অল্প খাবার খেয়ে নিতেন পরম তৃপ্তিতে। প্রাক্তন আনসার সদস্য সহ স্থানীয় যুবকদের তিনি উৎসাহিত করতেন দেশ মাতৃকার সম্ভ্রম রক্ষায় মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে। উল্লেখ্য, তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারী খান ভারতে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসাবে কিশোরগঞ্জের উত্তরাঞ্চল সহ বিভিন্ন যুদ্ধে বীরদর্পে অংশ নেন এবং পরবর্তীতে এই অঞ্চলে শান্তি শৃঙ্খলা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক যুবকদের সাংকেতিক চিরকুট লিখে পূর্ন ট্রেনিং এর জন্য পাঠাতেন ভারতের মেঘালয় বর্ডার মহেষখোলা গেরিলা ক্যাম্পে তাঁর বন্ধু সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার আবুল হোসেন ভূঁইয়ার কাছে আর সেখান থেকে ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসে দেশ মাতৃকার সম্ভ্রম রক্ষায় নিজেদের অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন।এই অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক শাহ্ মাহতাব আলী নিজেকে সবসময় গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন।
১৯৭৩ সালের যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে আর্থিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে কালোবাজারি, মুনাফাখোর ও মজুদদার ব্যবসায়িদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তিনি নিজের ব্যবসার লাইসেন্স পারমিট বর্জন করেন। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও সমাজ সংস্করনে তাঁর আমৃত্যু ভূমিকা ছিল।২০১৮ সালে তিনি কিশোরগঞ্জের সমাজ-সংস্কৃতি-সাহিত্য বিষয়ক সমীক্ষাধর্মী ” ঋদ্ধ মননের প্রাগ্রসর ভূমিপুত্র শাহ্ মাহতাব আলী ” শীর্ষক চতুর্থ মাজহারুন নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা লাভ করেন।২০১৮ সালে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৩৮তম জাতীয় সমাবেশে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের বাণীসহ আনসার বাহিনীর স্মরনিকায় ” প্রতিষ্ঠালগ্নের নিরলস কর্মবীর শাহ্ মাহতাব ” শীর্ষক তাঁর জীবনী গুরুত্বের সাথে সংকলিত হয়।
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন নেতা, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ডাঃ এ এ মাজহারুল হক এবং কিশোরগঞ্জ ৪ আসনের সাংসদ প্রকৌশলী রেজওয়ান আহম্মদ তৌফিক এর ইচ্ছায় ২০১৯ সালে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে শাহ্ মাহতাব আলী ফাউন্ডেশন গঠিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালীন এই বীর সেনানীর জীবন ইতিহাস ভারত ও বাংলাদেশ থেকে একযোগে বাংলা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ” বাংলাদেশ -সংগ্রাম,সিদ্ধি,মুক্তি ” নামক বইতে বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে ১৮ই ডিসেম্বর ২০২১ সালে বাংলা একাডেমীতে বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে এই বইটির মোড়ক উন্মোচন করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার এবং ভারতের কলকাতা বইমেলায় বইটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশনা হয় ৪ই মার্চ,২০২২ । এতে শিক্ষা মন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণের পাশাপাশি প্রখ্যাত সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন,কবি কামাল চৌধুরী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ডঃ মশিউর রহমান,অরমা দত্ত, বাংলাদেশ হাইকমিশন উপরাষ্ট্রদূত তৌফিক হাসান উপস্থিত ছিলেন। বইটিতে রাষ্ট্রপতি এডঃআব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বিশেষ বাণী দিয়েছেন। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতি এডঃআব্দুল হামিদ শাহ্ মাহতাব আলী কে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন এবং এখনো পারিবারিক সুসম্পর্ক বজায় রয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা, দেশপ্রেমিক, সমাজসেবক এই মহান ব্যক্তি ২০১৬ সালের ১৫ই মার্চ ১০৩ বৎসর বয়সে অনেকটা সূফি সাধকের মত তাঁর নিজবাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
শাহ্ মাহতাব আলীর পরিবার কিশোরগঞ্জ সদরের অষ্টবর্গ গ্রামে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক বাড়িটির সংযোগ সড়ক নির্মাণসহ সংস্কারের কাজ করছে। এলাকাবাসীর একটাই দাবি ও চাওয়া যেন এই বাড়িটিকে ঐতিহাসিক মূল্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম আশ্রয়শিবির হিসাবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়।