পুরাতন ঢাকার চকবাজারের ইফতার ও তার ঐতিহ্য
- আপডেট টাইম : ০২:১০:১৫ অপরাহ্ণ, রবিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৩
- / ২১২ ৫০০০.০ বার পাঠক
“বড় বাপের পোলায় খায় ঠোঙ্গায় ভইরা লিয়া যায়”
এখন এটি ডাহা মিছা হায়ে গেছে,এই জিনিষ মাইনসে খায়?
কি একটু অবাক হচ্ছেন? অবাক হওয়ার কিছু নেই।
প্রতি বছর রমজান এলেই প্রথম রমজান এবং দ্বিতীয় রমজান এ থাকবে চকবাজারের ইফতার নিয়ে প্রতিটি নিউজ মিডিয়ায় ফ্রন্ট পেইজ কাভার ফটো উইথ নিউজ। আর চকবাজারের ইফতার বলতে গত কয়েক বছর জুড়ে প্রাধান্য পাচ্ছে এই উদ্ভট খাবার ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। কিন্তু আসলে চকবাজারের ইফতার বাজারের ঐতিহ্য কি এবং বর্তমান বাস্তবতা কত টুকু ?
আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা পুরাতন ঢাকার চকবাজার এলাকার পাশের এলাকায়। যার ফলে ছোট বেলা থেকে চকবাজারের ইফতার বাজার সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল ছিলাম।
চকবাজারের দুটো বিখ্যাত খাদ্য বিক্রেতা তথা দোকান ছিল খুবই নিকট আত্মীয়ের,
এবং আমার এলাকার প্রতিবেশীর
তাই কমবেশী কিছু ব্যাপার জানি এবং নিজ চোখে দেখেছি।
তাদের কোয়ালিটি নিয়ে দুটো কথা বলি। আমি প্রথম রোজায় তাদের দোকানে গেলাম, প্রথম অভিজ্ঞতা, এতো এতো মানুষের ভিড়ে প্রথম দোকানি সেজে দাঁড়ানো। তাই একটু নার্ভাস ছিলাম, আমার হাত লেগে কিছু খাবার আইটেম রাস্তার পিচে পরে যায়, যা ছিল দোকানের ভেতরের দিকে। আমি সেগুলো তুলে দেখি কোন ময়লা তাতে তেমন নেই, দু একটিতে একটু ধুলো লেগেছে। দোকান শুরুতেই ভালো করে রাস্তার যে অংশে দোকান বসে তা পরিস্কার করে নেয়া হয়, ফলে কোন ময়লা দোকানের ভেতরের রাস্তায় থাকে না। কিন্তু আমি ওগুলো তুলে সেখানে রাখতে গেলে উনি আমাকে বাঁধা দিয়ে একটা ঝুড়ি দেখিয়ে দেন, বলেন ওখানে রাখো। আমি অবাক হলাম, কেন? উনি উত্তরে যা বললেন তার সারমর্ম হল তার বাবা তাদের শিখিয়ে গেছেন… তুমি সেই জিনিষই বিক্রি করবে যা তুমি নিজে এবং তোমার পরিবার খেতে পারবে।
আরেকটা ঘটনা বলি,
তাদের দোকানের সিঙ্গারা আর সমুচা ছিল খুব বিখ্যাত। সিঙ্গারা মুখে দিলে গলে যেত, এতই সফট এন্ড টেস্টি ছিল যে তা না চাখলে বোঝানো যাবে না।
আর সমুচা!
মাংস’র দাম বেড়ে যাওয়ায় সমুচা বিক্রি বন্ধ করে দেন, কারণ? কিমার (মাংসের কিমা) সমুচা বলে অন্য কিছু বিক্রি করতে পারবে না তারা। আমি বললাম দাম বাড়ান তাহলে…।
উনি হেসে দিলেন, বললেন তুমি নিজে কয়েকদিন থাকলেই বুঝতে পারবে। বুঝতে পেরেছিলাম। ভুঁইফোঁড় সব অতিথি খাদ্য বিক্রেতারা কীভাবে চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী খাবারের সুনাম ধুলোয় মিটিয়ে দিচ্ছিল তা নিজ চোখে দেখেছি। ঢাকা শহরের পাড়া গলির খাবার হোটেলের আলুচপ, পেয়াজু, বেগুনীও সেগুলোর থেকে অনেক ভালো।
এবার আসি মূল কথায়।
আপনি যদি চকবাজারে যান ইফতারি কিনতে তো কি করবেন? আপনি অবশ্যই বোম্বে কনফেকশনারি, আনন্দ কনফেকশনারি, আমানিয়া হোটেল ইত্যাদির মত ঐতিহ্যবাহী দোকান থেকে ইফতার কিনবেন। কোন রাস্তার উপর বসা দোকান থেকে নয়। না হলে আপনি ঠকবেন। আর ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ যদি কেউ খেতে চান, খেয়ে দেখেন, একবার খেলে আর দ্বিতীয়বার খাবেন না। এই খাবারের কথা ইতিহাসে কোথাও পাবেন না। হাকিম হাবিবুর রহমান বা এরকম কোন ইতিহাসবেত্তার লিখনিতো বাদ দিলাম, পুরাতন ঢাকার অরিজিনাল আদি বাসিন্দা যারা চকবাজারের ইফতার সম্পর্কে খোঁজ রাখেন, তারা কেউ এই খাবারের কথা বলবে না আপনাকে। এই খাবারের ইতিহাস হল, একজন মুড়ি ভর্তা (পুরাতন ঢাকায় মুড়ি মাখানোকে মুড়ি ভর্তা বলে) বিক্রেতার উর্বর মস্তিস্কের ফসল এই ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ খাবারটি।
আপনি চক বাজার গেলে কাবাব কিনবেন, নামেই সেগুলো কাবাব। রেশমি কাবাব, সুতি কাবাব, জালী কাবাবা, বটি কাবাব ইত্যাদি নামের কাবাবগুলো আসলে কোন কাবাবের কোয়ালিটিতে পরে না। আপনি একান্তই যদি কিনতে চান, তবে আনন্দ বেকারি যা চকবাজার মসজিদের নীচে অবস্থিত সেখানে ঢুকে পড়েন। চকবাজারে জিলাপি কিনবেন বোম্বে কনফেকশনারি থেকে, আর না হয় চকবাজার শাহী মসজিদের পেছনে ‘চুড়িহাট্টা’ নামের যে গলি আছে সেখানকার ‘নিয়াজের জিলাপি’ থেকে। ভুলেও রাস্তার উপরের ‘দই বড়া’ কিনবেন না, না হলে বাসায় গিয়ে নিজেকে গালি দিবেন, আর গালি দিবেন পুরাতন ঢাকার খাবার দাবার’কে।
হাবিবুর রহমান বা এরকম কোন ইতিহাসবেত্তার লিখনিতো বাদ দিলাম, পুরাতন ঢাকার অরজিনাল আদি বাসিন্দা যারা চকবাজারের ইফতার সম্পর্কে খোঁজ রাখেন, তারা কেউ এই খাবারের কথা বলবে না আপনাকে।
এই খাবারের ইতিহাস হল, একজন মুড়ি ভর্তা (পুরাতন ঢাকায় মুড়ি মাখানোকে মুড়ি ভর্তা বলে) বিক্রেতার উর্বর মস্তিস্কের ফসল এই ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ খাবারটি।
দোষ কি আসলে পুরাতন ঢাকার খাবারের? আপনি নান্না আর হাজীর বিরিয়ানি নাম শুনলেই ঢুকে পড়ছেন লোভনীয় কোন খাবারের আশায়। নান্না বিরিয়ানি নামে এখন যে বিরিয়ানি বিক্রি হয় তার যাত্রা ২০০০ সালের দিকে লালবাগ চৌরাস্তায়, অরিজিনাল নান্না মিয়া’র আত্মীয়র দ্বারা। তখনো বেচারাম দেউড়ীর অরিজিনাল নান্না’র মোরগ পোলাও টিকে ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে নান্না মিয়ার ছেলেদের কোন্দল এবং আর্থিক ঋণের কারণে তাদের ব্যাবসা গুটিয়ে নেয় এবং এই নতুন নান্না তা কিনে নেয়। যদিও এই নতুন নান্না মিয়ার বিরিয়ানি’র মানও খুব ভালো। কিন্তু তা সব শাখায় পাওয়া যায় না, আসল স্বাদ পেতে হলে আপানাকে লালবাগ চৌরাস্তার নান্না বিরিয়ানি’র মূল দোকানে আসতে হবে।
আচ্ছা আপনি কি ‘পালোয়ানের পোলাও’ এর নাম শুনেছেন? অথবা চকবাজারের ‘শাহ্ সাহেব এর খাসির বিরিয়ানি’র নাম? আপনি অধুনা প্রতিষ্ঠিত রয়েল, আফতাব, মামুন, শমসের এদের খাবার খেয়ে পুরাতন ঢাকার সেই ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ খুঁজতে যাবেন না যেন। পুরাতন ঢাকায় দোকান দিলেই তা পুরাতন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার হয়ে যায় না। এই সব কয়টি দোকান আমার চোখের সামনে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে রয়েল সবচেয়ে নাম করেছে, বিশেষ করে রয়েলের বাদামের শরবত। কিন্তু ১৯৯৮ এর দিকে যখন এরা যাত্রা শুরু করে সে সময়কার বাদামের শরবতের কাছে এখনকারটা নস্যি।
তাই শেষ কথা যেটা বলতে চাই, পুরাতন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ইফতার নামে যে সব অখাদ্য এবং কুখাদ্য এখন চকবাজারে বিক্রি হচ্ছে তা নিয়ে হাইলাইট করে ইতিহাসকে নষ্ট করবেন না।
পুরাতন ঢাকার খাবার সম্পর্কে জানতে হাকিম হাবিবুর রহমান সহ অনেক ইতিহাসবেত্তার বই পড়ে দেখেন, কিন জৌলুশ আর জাঁকজমকপূর্ণ ছিল সেই খাবারের আয়োজনগুলো।
ঢাকার রমজান ও ঈদের বড় আকর্ষণ ছিল খাবার। রোজায় ঘরে অনেক রকম ইফতারি থাকলেও সবাই একবার চকে ছুটে যেতেন। চক সেই মোগল আমল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য, খাবার-দাবার আড্ডার কেন্দ্র।
চকের ইফতারির কিছু বিবরণ রেখে গেছেন আবু যোহা নূর আহমেদ। খাবারগুলো ছিল_শিরমলি, বাকেরখানি চাপাতি, নান রুটি, কাকচা, কুলিচা, নানখাতাই, শিক কাবাব, হান্ডি কাবাব, মাছ ও মাংসের কোফতা, শামী ও টিকা কাবাব, পরাটা, বোগদাদী রুটি, শবরাতি রুটি, মোরগ কাবাব, ফালুদার শরবত ও নানারকম ফল।
একদিন চকবাজার গিয়ে খুঁজে দেখতে পারেন এই হারিয়ে যাওয়া খাবারের ইতিহাসকে, কোথাও খুঁজে পেলে জানাবেন প্লিজ।
নামে পেলে চলবে না কিন্তু,
আপনাকে সেই স্বাদেও পেতে হবে।